সরওয়ার আহমদ
২০১৬ সনে অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনকালীন একটি স্মৃতির জাবর কেঁটে আজকের লিখাটির সূচনাকরছি। পারিবারিক বিয়ে উপলক্ষে সহনীয় মূল্যে ফার্ণিচার ক্রয়ের লক্ষ্যে দৌড়ঝাঁপ শেষে একপর্য্যায়ে কুলাউড়া উপজেলার রবির বাজারে গিয়েছিলাম। বনাঞ্চল ঘেরা রবির বাজার ইতিমধ্যে ফার্ণিচার ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে। ইউনিয়ন পরিষদের জনৈক মেম্বারের মালিকানাধীন একটি কারখানা কাম শো-রুমে গিয়ে যাচাই বাছাই শেষে তার ক্যাশ টেবিলে বসে আলাপ চলছিলো। তারমধ্যে দোকানে ঢুকে একজন আওয়াজ ছাড়লেন- ও মেম্বার সাব, “ভোটের বাকী আর পাঁচদিন। কুছতা দেখি কওনা। বিশে ভিড়তাম, না তিরিশে উঠতাম? একদিকতো লওন লাগবো”। আমার সামনে বসা মেম্বার সাহেব কিঞ্চিত ইশারা দিতেই স্বাগতিক বক্তা সুর পাল্টিয়ে বল্লেন- আচ্ছা তাহলে পরে আলাপ হবে। বুঝলাম- আগত ব্যক্তি নিজ পরিষদের মেম্বার। ভোট সংক্রান্ত আসয়-বিষয় নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে আমি প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছি। তাই মুচকি হাসি দিয়ে মহাজনরূপী ইউ.পি মেম্বার সাহেবকে বলেছিলাম- বিশ-ত্রিশের হিসাব আগে আপনারা মিলান। আর আমিও পরবর্তীতে ফার্ণিচারের রেট অনুযায়ী নিজের সঙ্গতির হিসাব কষে আপনার সাথে যোগাযোগ করবো।
প্রিয় পাঠক, বিশ-ত্রিশের মাজেজা সম্পর্কে এখানে ব্যাখ্যা দেওয়ার কি কোন প্রয়োজন আছে? আজকাল কেউ আর বে-আক্কেল নন। আর কথায় বলে- আক্কেলবন্দ ছে ইশারাভি কাফী। নির্বাচনের লেনদেন এবং টাকার ক্ষেত্রেও এমন তরো যোগসাজন আছে। নইলে নির্বাচনোত্তর প্রেক্ষাপটে দল বা জোট নেতানেত্রীরা পেশী শক্তি এবং কারচুপির সাথে কালো টাকার প্রভাব সম্পর্কে অভিযোগ উত্থাপন করতেন না। অন্যদিকে নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রার্থীর আর্থিক ভিত্তির উপরও গুরুত্ব দেয়া হয়। ফলে আর্থিক সঙ্গতির অভাবে যোগ্যতা সম্পন্ন অনেক ত্যাগী এবং নিবেদিত প্রাণ নেতৃবর্গও ছিটকে পড়েন। এমতাবস্থায় “অর্থ অনর্থের মূল” প্রবাদের চাইতে বাজিমাতের জন্য অর্থই নিয়ামক শক্তি হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে।
নির্বাচনে টাকার খেলাতো নতুন কিছু নয়। ১৯৬৪ সনের স্থানীয় নির্বাচন যখন স্ব-গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় তখন লেখক পাঠশালার ছাত্র। নির্বাচনী দামামা তখন কিভাবে সুর তুলেছিলো তা স্মরণে আছে। দুই প্রার্থীর মধ্যে একজন ছিলেন ঠিকাদার এবং অপর জন লন্ডন থেকে আগত। লন্ডনীর দেয়া জিন্নাহর ছবি সম্বলিত ১শ টাকার নোটের বিনিময়ে পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভেঙ্গেঁ আমাদের ঘরের “বুবু” ও তার পরিবারের তিনভোট লন্ডনীর বাক্সে পড়েছিলো। অকপটে আমার মা,চাচীর নিকট এটি স্বীকার করেছিলো ঐ কাজের মেয়ে। ষাটের দশকে শুরু হওয়া এই টাকার খেলা বর্তমান ভোট বাজারে কতটুকু ছায়া ফেলেছে, সেটি বোদ্ধাজনরা বলতে পারবেন ভালো ভাবে।
প্রসঙ্গ হচ্ছে- নির্বাচনে টাকার লেনদেন প্রশ্নে কেউ যদি চ্যালেঞ্জ করে, তাহলে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা অসম্ভব। কারণ বিষয়টি দৃশ্যমান নয়। পরকীয়া যেভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে নিভৃতে সম্পন্ন হয়, তেমনি ভোটের লেনদেনও হয় গোপনে। তবে এই উপসর্গ দৃশ্যমান না হলেও অনুমানযোগ্য। পরকীয়া সমাজে এখনও নাজায়েজ এবং ঘৃণিত। কিন্তু ভোট বেচা-কিনি বা ভোটের লেনদেন সে পর্য্যায়ে এখনও উপনীত হয়নি। তবে দুর্মুখ এক সমজদারের মতে- সমাজে Give and Take কথাটি যদি প্রতিষ্টিত হতে পারে এবং সংস্কৃতি বা দর্শনের ক্ষেত্রে “দেবে আর নিবে, মিলিবে মেলাবে” উক্তিটি যদি প্রভাব বিস্তারে সক্ষম তাহলে ভোটের লেনদেন নিয়ে এতো মাতামাতির কি আছে। ভোট দিলাম। এই দেওয়ার বিনিময়ে কিছু পেলাম। দেনা পাওনার তো এটিই সরল সমাধান। বিষয়টিতো এখন ওপেন সিক্রেট। একটু সবুর করুন, দেখবেন ওপেন শব্দটির পেছন থেকে সিক্রেট শব্দটি এক সময় উঠে যাবে অবলীলায়। কথা শুনে ভাবলাম, যুক্তির সমান্তরালে কুযুক্তিও আছে। এছাড়া তর্কে বহুদূর কথাটিকে তো উড়িয়ে দেয়া যায়না। তবে কথা আছে- ফাও পথের কঁড়ি, উড়ে তাড়াতাড়ি। ভোট বিক্রয়ের লব্দ টাকা থিতু হবার পরিবর্তে বায়বীয় টানে মিলিয়ে যায়। টাকা খর্চ হয় আনে আর বানে। ভোট বিক্রির টাকা দিয়ে কেউ ঘর তৈরী করেছে-জমি কিনেছে বা F.D.R করেছে এমন নজির বোধহয় নেই। ব্যতিক্রম হিসেবে একটি খবর জেনেছিলাম গত জেলা পরিষদ নির্বাচনের মাসদিন পর। কোন এক ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত মহিলা সদস্য “কইতরের মা” তার ভোটের ট্রাম্পকার্ড প্রদর্শন করে মোটামুটি অংকের টাকা হাতে জমিয়েছিলেন। টেরপেয়ে তার দাদন ব্যবসায়ী স্বামী এই টাকাগুলো নিজ ব্যবসাতে বিনিয়োগের জন্য উঠেপড়ে লাগেন। কিন্তু ভদ্র মহিলা এ প্রস্তাব নাকচ করে বলেছিলেন- বিয়ের সময় গলার চেইন দেবার মুরোদ হয়নি তোমার। এখন আমি আমার ক্ষমতাবলে যে টাকা ইনকাম করেছি, তা দিয়ে গলার হার বানাবো। তোমার ফালতু প্রস্তাব মানিনা। এই গলার চেইন স্মৃতি স্বরূপ থাকবে আজীবন। এ খবরটি নিয়ে আমরা কয়েকজন যখন রসালাপে মগ্ন তখন ইথারে কেযোনো গাইছিলো- আমার মুর্শিদ পরশমনিগো…..লোহারে বানাইলো কাঞ্চা সোনা…। এবার উপ-নির্বাচনী বাতাস বসার সাথে সাথেই পরিচিত সেই সোর্সকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোমার কইতরের মার খবর কি? জবাব এসেছে- মূল নির্বাচনে গলার হার জুটেছিলো, উপ-নির্বাচনে আর কিছু না হোক কানবালাতো জুটবেই।