স্টাফ রিপোর্টারঃ সুন্দরবন ও সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের পর এবার মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর রামসার সাইট (বিশ্বব্যাপী জৈবপরিবেশ রক্ষার একটি সম্মিলিত প্রয়াস) হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে। এশিয়ার বৃহত্তম এই হাওর রামসার সাইটের অন্তর্ভুক্ত হলে মৎস্য অভয়াশ্রম, পাখির অভয়াশ্রম, উদ্ভিদ ও জলাভূমি সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রামসার সম্মেলন বিশ্বব্যাপী জলীয় পরিবেশ রক্ষার একটি সম্মিলিত প্রয়াস। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ইরানের রামসার শহরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশসমূহ ‘কনভেনশন অন ওয়েটল্যান্ডস’ নামক একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে এই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ মোট ১৫৮টি দেশ স্বাক্ষর করে। রামসার নিয়মানুযায়ী জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ জলাভূমিগুলো জলচর পাখিদের জন্য সংরক্ষণ, পরিবেশগত, অর্থনৈতিক ও বিনোদনমূলক গুরুত্ব তুলে ধরে এ ধরনের স্থানগুলোকে রামসার এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর লক্ষ্য হলো- স্থানীয়, এলাকাভিত্তিক এবং জাতীয় পর্যায়ের কার্যক্রম এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে জলাভূমিসমূহ রক্ষা ও বুদ্ধিদীপ্ত উপায়ে ব্যবহার নিশ্চিত করা, যাতে বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়।
বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যে ভরপুর সুন্দরবন ১৯৯২ সালের ২১ মে রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। মিষ্টি জলের ধু ধু সাগর সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর ২০০০ খ্রিস্টাব্দে ২০ জানুয়ারি রামসার অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নয়নাভিরাম এ দুটি জায়গার পর বাংলাদেশের তৃতীয় স্থান হিসেবে রামসার অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওর।
জানা যায়, ছোট-বড় ২৩৮টি বিল নিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ হাওর হাকালুকি হাওরের আয়তন ১৮১.১৫ বর্গকিলোমিটার। হাওরটি ৫টি উপজেলা ও ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত। হাওরের শতকরা ৪০ভাগ বড়লেখা, ৩০ভাগ কুলাউড়া, ১৫ভাগ ফেঞ্চুগঞ্জ, ১০ভাগ গোলাপগঞ্জ এবং ৫ ভাগ বিয়ানীবাজার উপজেলার অন্তর্গত।
হাকালুকি হাওরের বিশাল জলরাশির মূল প্রবাহ হলো জুড়ী এবং পানাই নদী। এই জলরাশি হাওরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত কুশিয়ারা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়। বর্ষাকালে হাওর সংলগ্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে বিশাল রূপ ধারণ করে। এই সময় পানির গভীরতা হয় ২-৬ মিটার। হাওরের আয়তন দাঁড়ায় ২৪ হাজার ৭শ’ হেক্টরে। হাকালুকি হাওরকে মিঠা পানির অন্যতম প্রজনন কেন্দ্রও বলা হয়। হাওর তীরের প্রায় দুই লাখ মানুষ জীবন ও জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই হাওরের ওপর নির্ভরশীল। হাওরে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। বাংলাদেশে জলজ উদ্ভিদ প্রজাতির অর্ধেকেরও বেশি হাকালুকি হাওরে জন্মে। সরকার ১৯৯৯ সালে হাকালুকি হাওরসহ দেশের মোট ৮টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া-ইসিএ) ঘোষণা করে। এরপর পরিবেশ অধিদফতর হাওরের উন্নয়নে ‘উপকূলীয় ও জলাভূমি জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’র মাধ্যমে কাজ করে। উন্নয়ন কাজের অংশ হিসেবে ২৭টি গ্রাম সংরক্ষণ দল (ভিলেজ কনজারভেটিভ গ্রুপ-ভিসিজি) গঠন করে। এছাড়া জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ইসিএ কমিটি গঠন করা হয়। পরিবেশ অধিদফতরের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে হাওর তীরের মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি হয়।
স্থানীয়রা জানান, হাকালুকি হাওরে প্রায় ২৩৮টি বিল রয়েছে। সারাবছরই বিলগুলিতে পানি থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিল হলো- চাতলা বিল, চৌকিয়া বিল, ডুল্লা বিল, পিংলার কোণা বিল, ফুটি বিল, তুরাল বিল, তেকুনি বিল, পাওল বিল, জুয়ালা বিল, কাইয়ারকোণা বিল, বালিজুড়ি বিল, কুকুরডুবি বিল, কাটুয়া বিল, বিরাই বিল, রাহিয়া বিল, চিনাউরা বিল, দুধাল বিল, মায়াজুরি বিল, বারজালা বিল, পারজালা বিল, মুছনা বিল, লাম্বা বিল, দিয়া বিল। হাকালুকি হাওরের বিলগুলিতে বিভিন্ন জাতের বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। তবে এক সময়ের অন্যতম আকর্ষণীয় সোয়াম ফরেস্ট (জলময় নিম্নভূমির বনাঞ্চল এখন কমে যাচ্ছে।
সম্প্রতি পরিবেশে ও জলবায়ু বিষয়ক এক জরীপ থেকে জানা যায়, হাকালুকি হাওরে ১৫০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ, ৫২৬ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ২০ প্রজাতির সরীসৃপ রয়েছে। এগুলোর অধিকাংশ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এখানে প্রতি বছর শীতকালে প্রায় ২০০ বিরল প্রজাতির অতিথি পাখির সমাগম ঘটে। হাকালুকি হাওর টেকসই উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, ইকোট্যুরিজম শিল্প বিকাশের এক অসাধারণ আধার।
জেলা প্রশাসক বেগম নাজিয়া শিরিন বলেন, এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওরকে রামসার সাইট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। হাওরের নির্ধারিত তথ্যাদি রামসার সচিবালয়ের চাহিদা অনুসারে নির্ধারিত ছকে পূরণ করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
তিনি আরও বলেন, শুক্রবার মৌলভীবাজারের একটি হোটেলে কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. একেএম রফিক আহাম্মদের সভাপতিত্বে কর্মশালায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীর চৌধুরী প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন। কর্মশালায় তিনি বিষয়টি আলোচনা করেন।