বিশেষ প্রতিনিধিঃ
মৌলভীবাজার জেলা অটো টেম্পু, অটোরিক্সা, মিশুক ও সিএনজি পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি-সম্পাদকের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের শ্রমিকদের চাঁদার দেড় কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে শ্রম আইনে মামলা হয়েছে। বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ নাহিদুল ইসলাম বাদী হয়ে সিলেট শ্রম আদালতে ২১ সেপ্টেম্বর এ মামলা (মামলা নং ৩০/২০) দায়ের করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সভাপতি আওয়ামীলীগ কর্মী পাবেল মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক বিএনপি নেতা আজিজুল হক সেলিমের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে শ্রমিক সংগঠনটি। রাজনীতিতে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক দুই মেরুর হলেও শ্রমিক সংগঠনে একই। আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে কার্যকরি কমিটির অন্যান্য সদস্যদের কোনো গুরুত্বই দেয়নি তারা। অনৈতিক লেনদেনে উপজেলা পর্যায়েও নিজেদের খেয়াল খুশি মতো দেয়া হয় কমিটি। ইতিমধ্যে শ্রমিকদের গামের টাকায় আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছেন সভাপতি-সাধারন সম্পাদক। ১ কোটি ৮৬ লক্ষ ১৫ হাজার টাকা অর্থ আতœসাতের অভিযোগে শ্রমিক ইউনিয়নের (রেজি. নং- চট্ট-২৩৫৯) এই দুই নেতার বিরুদ্ধে এ মামলা দায়ের করা হয়।
মামলা সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলা অটো টেম্পু, অটোরিক্সা, মিশুক ও সিএনজি পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নের (রেজি. নং- চট্ট-২৩৫৯) সভাপতি পাবেল মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক সেলিমের কাছে ২০১৮ সালের সংগঠনের আয় ব্যয়ের সঠিকতা যাছাইয়ের জন্য যাবতীয় কাগজপত্র শ্রীমঙ্গল বিভাগীয় শ্রম দপ্তরে নিয়ে আসার জন্য পরপর দুই বার নোটিশ দেয় শ্রম দপ্তর। কিন্তু সভাপতি-সম্পাদক আয়-ব্যয়ের রিটার্ন জমা দেননি।
পরবর্তীতে শ্রমিক ইউনিয়নের ২০১৮ সালের দাখিলকৃত বার্ষিক আয়-ব্যয়ের সত্যতা সরেজমিন তদন্তের জন্য শ্রম দপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. সোহেল আজিম ও ইউসুফ আহমদ চৌধুরী’র সমন্বয়ে ১২ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এর প্রেক্ষিতে সংঠনের প্রধান কার্যালয়ে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারী সরেজমিনে তদন্ত করে ওই কমিটি। তদন্তকালে সভাপতি পাবেল মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক সেলিম উপস্থিত ছিলেন। এসময় দাখিলকৃত ২০১৮ সালের রিটার্নে আয় দেখানো হয় ৫১ লক্ষ ৩২ হাজার ১’শ ৫০ টাকা এবং ব্যয় দেখানো হয় ৫১ লক্ষ ২০ হাজার ১’শ ৫০ টাকা। অবশিষ্ট ছিল ১২ হাজার টাকা। তদন্তকালে আয়ের স্বপক্ষে চাঁদা আদায়ের রশিদসহ চাঁদা দাতাদের সদস্য তালিকা বহি তারা প্রদর্শন করতে পারেননি এবং ব্যয়ের পক্ষে প্রদর্শিত ভাউচারাদিসহ সভার নোটিশ, সভার কার্যবিবরনী, ক্যাশ রেজিস্টার কাগজ দেখাতে পারেননি বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তদন্ত কমিটির সদস্যরা আরও বলেন, এগুলো দেখে মনে হয়েছে সব কাগজপত্রই সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সৃজনকৃত।
এদিকে অনিয়মের সত্যতা যাছাইয়ের জন্য চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারী ইউনিয়নটির শ্রীমঙ্গল শাখার আওতাধীন সিন্ধুরখান ও হবিগঞ্জ রোড অফিসে সরেজমিনম যায় তদন্ত কমিটি। তদন্তে ইউনিয়ন কর্তৃক চাঁদা সংগ্রহের রশিদ পাওয়া যায়। তদন্তকালে জানা যায় ইউনিয়নে মৌলভীবাজার জেলার ৭ টি উপজেলায় কম-বেশী ৯০টি রোডে কমিটির মাধ্যমে ইউনিয়নের ১৭ হাজার সদস্যের কাছ থেকে প্রতিদিন রশিদ বহির মাধ্যমে ২০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। আদায়কৃত ২০ টাকা হতে ইউনিয়নের জেলা কমিটি পায় ৩ টাকা। সে অনুযায়ী প্রতিদিন জেলা কমিটির আয় ৫১ হাজার টাকা এবং বছরে ১ কোটি ৮৬ লক্ষ ১৫ হাজার টাকা। ইউনিয়নের দাখিলকৃত ২০১৮ সালের রিটার্নে উল্লেখিত পরিমাণ অর্থ প্রদর্শন করা হয়নি। যা অর্থ আত্মসাৎ এর অসৎ উদ্দেশ্যে করা হয়েছে বলে তদন্তে প্রতীয়মান হয়।
ইউনিয়নের ২০১৮ সালের দাখিলকৃত রিটার্নে সদস্য চাঁদা হতে বছরে ৫১ লক্ষ ৩২ হাজার ১’শ ৫০ টাকা আয় হয়েছে উল্লেখ করা হলেও উক্ত টাকা ব্যয়ের উপযুক্ত কোন ভাউচারাদি প্রদর্শন করা হয়নি এবং ব্যয়ের স্বপক্ষে কোন রেকর্ডপত্র সংরক্ষণ করা হয় না মর্মে সরেজমিন নিশ্চিত হয় তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির সদস্যরা আরও বলেন, ২০১৮ সালের রিটার্নে শুধুমাত্র ইউনিয়নের সভাপতি পাবেল মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক সেলিমের স্বাক্ষরিত। সরেজমিন তদন্তকালে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ব্যতীত কার্যকরী কমিটির অন্য কোন সদস্যকে উপস্থিত পাওয়া যায়নি।
এবিষয়ে অভিযুক্ত কমিটির অধিনস্থ মৌলভীবাজার-শমসেরনগর রোডের সাধারণ সম্পাদক শাহনাজ বলেন, শ্রমিকদের টাকায় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ইতিমধ্যে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছেন। শ্রমিক নেতা হওয়ার আগে তাদের কিছু না থাকলেও সভাপতি এখন মোজাইক দিয়ে বাড়ি মানিয়েছেন এবং সাধারণ সম্পাদক শহরে জায়গাও কিনেছেন। কিন্তু শ্রমিকদের দুর্দিনে তাদের কাছে পাওয়া যায়নি।
মৌলভীবাজার জেলা অটো টেম্পু, অটোরিক্সা, মিশুক ও সিএনজি পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নের প্রচার সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক আমাদের কিছুই জিজ্ঞাসা করেননি। টাকা পয়সা সবই তাদের পকেটে ডোকে। তাদের যা ইচ্ছা তাই করছেন।
শহরের একাটুনা রোডের সভাপতি ইমন মিয়া বলেন, মাঝে মধ্যে জেলা কমিটি আমাদের সহযোগীতা করেন। তবে যেভাবে সহযোগীতা করার কথা ছিল সেভাবে পাচ্ছি না।
বিষয়টি নিয়ে জেলার একাধিক শ্রমিকনেতা ও শ্রমিকদের সাথে কথা হলে তারা বলেন, জেলা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক তাদের ইচ্ছা মতো সংগঠন পরিচালনা করছেন। জেলার টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের গাফলা রয়েছে।
এবিষয়ে জেলা অটো টেম্পু, অটোরিক্সা, মিশুক ও সিএনজি পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোঃ পাবেল মিয়া বলেন, আমাদের হয়রানি করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এ মামলা করা হয়েছে। টাকা অনিয়মের বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা। টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে জেলা কমিটির অন্যান্য সদস্যদের পরামর্শ নেননি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা যোগ্যতা সম্পন্ন না থাকায় অনেক বিষয় তারা সমাধান করতে পারেনি। যার কারনে আমাদেরকে সব কিছু করতে হয়। ফলে জেলা কমিটির কিছু লোক আমাদের উপর মনক্ষুন্ন। সর্বশেষ তিনি বলেন, সাবেক শ্রমিক নেতা শিবলু মিয়ার প্ররোচনায় বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নাহিদুল ইসলাম এ মামলা দায়ের করেছেন বলে আমরা ধারণা করছি।