মোহাম্মদ আবু তাহের
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের কালো থাবা। প্রতিদিন মৃত্যু ও সংক্রমনের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। স্থবির হয়ে পড়ছে বিশ্ব। এর প্রভাব পড়ছে বিশ্ব অর্থনীতিতেও। করোনার প্রভাব থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশও। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে অর্থনীতিকে সচল রাখার তাগিদে বাংলাদেশেও সবকিছু চলছে আগের মতোই। তবে সভা সমাবেশ আগের মতো করা যাচ্ছে না। ভার্চুয়ালী স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সভা সমাবেশ করতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় সারাবিশ্বে ২৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস পালিত হবে। বাংলাদেশেও এ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হবে।
জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষনায় বলা হয়েছে প্রত্যেকেরই মতামত ঘোষনা করা ও প্রকাশ করার অধিকার রয়েছে। তথ্য জানার অধিকার চিন্তা বিবেক ও বাক স্বাধীনতার অংশ। চিন্তা বিবেক ও বাক স্বাধীনতার অধিকার অন্যতম মৌলিক অধিকার। দেশের প্রতিটি মানুষ তার সকল মানবাধিকার নিয়ে সম্মানের সঙ্গে বসবাস করতে হলে মানুষের অধিকারের বিষয়গুলি সম্পর্কে জানতে হবে। আর অধিকার সম্পর্কে জানতে হলে তথ্য অধিকার আইন এর প্রয়োজন রয়েছে। জনগনের তথ্য অধিকার নিশ্চিত হলে দেশে সুশাসন প্রতিষ্টিত হবে। জনগন যাতে তথ্য জেনে সমৃদ্ধ হতে পারে সে লক্ষ্যেই প্রণীত হয়েছে ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন। এ আইন অনুসারে দেশের মানুষ সরকারী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য উদঘাটন করে দেশের উন্নয়নে নিজেদের নিয়োজিত করতে পারবে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ (ক) অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিকের চিন্তা, বিবেক, বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। সরকারী বেসরকারী কর্মচারীদের জবাবদিহীতা নিশ্চিত হবে, গনতন্ত্র প্রাতিষ্টানিক রূপ পাবে, বন্ধ হবে দুর্নীতি, প্রতিষ্টিত হবে সুশাসন। সরকারের কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বশীল অঙ্গ হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ। নির্বাহী বিভাগকে অনেক বেশী গতিশীল ও কার্যকর করার জন্য সরকার সচেষ্ট রয়েছে। একটি দেশের উন্নয়নের জন্য নির্বাহী বিভাগই সবচেয়ে বেশী ভ’মিকা রাখে। দক্ষ ও উন্নত প্রশাসনের জন্য জবাবদিহিতার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আর জবাবদিহিতার জন্য তথ্য অধিকার আইন গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রাখতে পারে। তথ্য অধিকার আইনের মূল চেতনা হচ্ছে সাধারন মানুষের স্বার্থ রক্ষা করা। প্রতিদিন জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যেতে হয় দেশের নাগরিকদের। আর সেখানে কাজের সুবিধার্থে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে অনেক তথ্য জানার প্রয়োজন হয়। তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সকল নাগরিকেরই জানা থাকা দরকার। আইন অনুযায়ী তথ্য হলো কোন কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের গঠন কাঠামো ও দাপ্তরিক কর্মকান্ড সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়। তথ্য অধিকার বলতে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য লাভের অধিকার থাকবে এবং যে কোন নাগরিকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাকে তথ্য প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। আর কর্তৃপক্ষ হলো সংবিধান অনুযায়ী সৃষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। কোন প্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়ার জন্য আইনে নির্ধারিত বিধি অনুযায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে লিখিতভাবে তথ্যের জন্য আবেদন করতে হবে। কর্তৃপক্ষ অনধিক ২০ কার্যদিবস, একাধিক কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টতা থাকলে অনধিক ৩০ কার্যদিবস এর মধ্যে তথ্য প্রদান করতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোন কারনে তথ্য প্রদানে অপারগ হলে অপারগতার কারন উল্লেখ করে আবেদন প্রাপ্তির দশ কার্যদিবসের মধ্যে তিনি ইহা আবেদনকারীকে অবহিত করবেন।
তথ্য জানার অধিকারকে আন্তর্জাতিকভাবে অন্যতম মানবধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় দেশের অধিকাংশ জনগন এখনো জানেনা দেশে যে তথ্য জানার বিষয়ে একটি আইন রয়েছে। সরকারি বেসরকারী পর্যায়ে উদ্যোগের মাধ্যমে “তথ্য অধিকার আইন-২০০৯” সম্পর্কে ব্যাপক জনগোষ্টিকে জানাতে হবে। তা না হলে এ আইনের বাস্তবায়ন কোন ক্রমেই সম্ভব নয়। আইনের সুফলও দেশের নাগরিকগন পাবেনা। তথ্য অধিকার আইনের ৩২ ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কাজে নিয়োজিত সংস্থা বা প্রতিষ্টানের ক্ষেত্রে এ আইন প্রযোজ্য নয়। তাদের কাছে জনগন কোন তথ্য চাইতে পারবে না। তথ্য অধিকার আইনে তথ্য প্রদানে বাধ্য কর্তৃপক্ষ হিসেবে সরকারী প্রতিষ্টানের পাশাপাশি বেসরকারী প্রতিষ্টানকেও অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে তারা যে অঞ্চলে বাস করেন সে অঞ্চলের বরাদ্ধকৃত ভিজিএফ কার্ড, রাস্তাঘাট তৈরীসহ অন্যান্য সেবা সংক্রান্ত তথ্য সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। তথ্য অধিকার আইন জনগনকে সমস্ত অধিকার জানার অধিকার দিয়েছে। মানুষ সচেতন হলেই এ অধিকারগুলো প্রয়োগ করতে পারবে নিঃসন্দেহে। সাধারণ মানুষকে তথ্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে সংবাদপত্র, সাংবাদিক, লেখক ও গণমাধ্যমের বিশেষ ভ’মিকা প্রয়োজন। এ আইনের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্টি সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য জেনে নিজেদের তথ্য সমৃদ্ধ করতে পারবে। তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে সাধারন মানুষ এখনো সচেতন নয়। এ আইনের মাধ্যমে তথ্য পাওয়ার যে সুযোগ রয়েছে সে জন্য ব্যাপক জনসচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। তথ্য জনগনকে সমৃদ্ধ করে এবং তথ্য সমৃদ্ধ জনগন দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগের মাধ্যমে আইনটির অগ্রযাত্রা জনগনের সচেতনতার মাধ্যমে অব্যাহত রাখতে হবে। তথ্য আইন অনুযায়ী তথ্য প্রদান না করলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সর্ব্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা আরোপ করা হতে পারে।
তথ্য অধিকার আইনের ৭ ধারা মোতাবেক কিছু কিছু ক্ষেত্রে তথ্য গোপন রাখা যাবে, যেমনঃ-
(ক) যে সকল তথ্য প্রকাশের ফলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা, অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের ক্ষতিসাধন হতে পারে।
(খ) যে সকল তথ্য প্রকাশের ফলে অন্য কোন দেশ বা আন্তর্জাতিক/আঞ্চলিক প্রতিষ্টানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষতি করতে
পারে।
(গ) কোন বিদেশী সরকারের নিকট হতে প্রাপ্ত কোন গোপনীয় তথ্য।
(ঘ) কোন তথ্য প্রকাশের ফলে কোন বিশেষ ব্যক্তি বা সংস্থাকে লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে এরূপ নিম্নোক্ত তথ্য,
যথাঃ-
(অ) আয়কর, শুল্ক, ভ্যাট ও আবগারী আইন, বাজেট বা করহার পরিবর্তন সংক্রান্ত কোন আগাম তথ্য;
(আ) মুদ্রার বিনিময় ও সুদের হার পরিবর্তন জনিত কোন আগাম তথ্য;
(ই) ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিচালনা ও তদারকি সংক্রান্ত কোন আগাম তথ্য।
(ঙ) প্রচলিত আইনের প্রয়োগ বাধাগ্রস্থ হতে পারে বা অপরাধ বৃদ্ধি পেতে পারে এরূপ তথ্য।
(চ) জনগণের নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে বা বিচারাধীন মামলার সুষ্টু বিচার কার্য ব্যাহত হতে পারে এরূপ তথ্য।
(ছ) যে সকল তথ্য প্রকাশের ফলে কোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা ক্ষুন্ন হতে পারে এরূপ তথ্য।
(জ) কোন ব্যক্তির জীবন বা শারীরিক নিরাপত্তা বিপদাপন্ন হতে পারে এরূপ তথ্য।
(ঝ) তদন্তাধীন কোন বিষয় যার প্রকাশ তদন্ত কাজে বিঘœ ঘটাতে পারে এরূপ তথ্য।
(ঞ) যে সকল তথ্য কোন অপরাধের তদন্ত প্রক্রিয়া এবং অপরাধীর গ্রেফতার ও শাস্তিকে প্রভাবিত করতে পারে।
(ট) কৌশলগত ও বাণিজ্যিক কারনে গোপন রাখা বাঞ্ছনীয় এরূপ কারিগরি বা বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ কোন তথ্য।
(ঠ) কোন ব্যক্তির আইন দ্বারা সংরক্ষিত গোপনীয় তথ্য।
(ড) পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বা পরীক্ষায় প্রদত্ত নম্বর সম্পর্কিত আগাম তথ্য।
কোনো তথ্য প্রকাশের ফলে আইনের প্রয়োগ ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে বা জনগনের নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে। এ ধরনের তথ্য কোনো কর্তৃপক্ষ দেশের কোন নাগরিককে সরবরাহ করতে বাধ্য নয়। এ আইনটি একটি সময়োপযোগী গুরুত্বপূর্ন আইন। এ আইনটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মানে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে নিঃসন্দেহে। দেশের নাগরিকদের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আইনটি যুগান্তকারী প্রয়াস। এ আইনের কঠোর প্রয়োগের মধ্যেই আইন প্রনয়নের সার্থকতা নির্ভর করবে। তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়ন করতে সরকারী বেসরকারী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব অত্যন্ত প্রয়োজন।
লেখক- কলামিস্ট, গবেষক ও ব্যাংকার।