হোসাইন আহমদ
সরকারি কর্মচারীদের কর্মস্থল পরিবর্তন হবে এটাই স্বাভাবিক। এমনকি সরকারের নির্দেশনা রয়েছে সর্বোচ্চ ৩ বছরের মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের বদলি করতে হবে। এ বদলির আদেশ করবে সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।
গত কয়েক বছর যাবত জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা বদলি হয়ে নতুন কর্মস্থলে যোগ দেয়ার আগেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ বিভিন্নভাবে তাদের অভিনন্দন কিংবা শুভেচ্ছা বার্তা জানানো হয়। ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতারা নতুন পদায়নকৃত কর্মকর্তার ছবির সাথে নিজের ছবি যুক্ত করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিনন্দন জানান। আবার কেউ কেউ ভুঁইফোড় অনলাইন নিউজ পোর্টালে একটি সংবাদ প্রকাশ করে নিজের ফেইসবুক আইডিতে শেয়ার দেন। দুই তৃতীয়াংশ মানুষই ওই কর্মকর্তার সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলতে যোগদান করার আগেই এই অভিনন্দন জানান। পরবর্তীতে অভিনন্দনের ছবি দেখিয়ে অবৈধ নানা সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করেন। অতীতে এরকম একাধিক প্রমাণও রয়েছে। জেলা প্রশাসন কিংবা তার অধীনস্থ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সুবিধা পাওয়ার জন্য তারা এমন কর্মকান্ড করেন। আবর উনি কর্মস্থলে যোগদানের পরপরই ফুল দিয়ে বরন করা হয়। শতশত ব্যক্তি, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী, ব্যবসায়ীরা ও সামাজিক সংগঠনের নেতা উনার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। নতুন কর্মস্থলে আসা ব্যক্তি যদি জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার বা সম-পর্যায়ের হলে অনেক সময় সাক্ষাৎ করতে আসা এজেলার অনেক নাগরিককেই পাত্তা দেন না। ওয়েটিং রুমে ফুল রেখে ফিরে যেতে হয় অনেককে। এমন নজির রয়েছে মৌলভীবাজারে।
তবে আমি একথা বলছি না যে, নতুন কর্মকর্তা আসার পরে তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করা যাবে না। নিয়মতান্ত্রিক ভাবে অতিরিক্ত তৈলমর্দন না করে তার সাথে সাক্ষাৎ করা যেতে পারে। জেলার বিভিন্ন সমস্যা কিংবা সম্ভাবনার বিষয়ে তাকে পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। কিন্তু তার সাথে যে সাক্ষাৎ করতে হবে এমনটি নয়। তিনিই প্রয়োজনে ধারাবাহিক ভাবে জেলার বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের সাথে মতবিনিময় করবেন। নতুন কর্মস্থলে যোগ দেয়ার পর এটা উনার প্রধান দায়িত্ব। সম্প্রতি এধারায় অনেকটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। জেলার বয়স্ক নাগরিকরা মন্তব্য করছেন অতিরিক্ত তৈলমর্দন করার কারনে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার কিংবা উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অনেককে এড়িয়ে যাচ্ছেন।
তৈলমর্দন বেশি করলে এজেলার মানুষের ক্ষমতা, চিন্তাধারা, প্রতিবাদী কন্ঠসূর ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ভুমিকা নিয়ে নতুন কর্মকর্তাকে বেশি চিন্তা করতে হয়না। অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জেলার এমপি, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান ও কিংবা অন্যান্য নেতাদের পাত্তা না দিয়ে নিজেই একক সিদ্ধান্ত নেন। চরম আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়তে হয় জনপ্রতিনিধিদের। আমলাতান্ত্রিক চাপে অনেক সময় জেলার উন্নয়ন করা জনপ্রতিনিধিদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কখনও কখনও জিম্মি হয়ে যান তারা।
সদ্য বদলি হওয়া মৌলভীবাজারের সাবেক জেলা প্রশাসক বেগম নাজিয়া শিরিনকে ২৫ জুন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের পরিচালক হিসেবে বদলী করে। তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নতুন জেলা প্রশাসক হিসেবে মীর নাহিদ আহসানকে পদায়ন করা হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এই আদেশ দেয়ার সাথে সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নতুন জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসানের ছবি সহ অভিনন্দনের জোয়ার জেলাব্যাপি বইতে শুরু করে। ৩/৪ দিন জেলার অধিকাংশ মানুষের ব্যক্তিগত ফেইসবুক আইডিতে অভিনন্দন বার্তা জানানো হয়। নিউজ ফিডে এটাই বারবার আসতো। জেলা আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ সহ অঙ্গ সংগঠনের অনেক নেতাকর্মীরা শুভেচ্ছা জানান। এছাড়াও শহরের প্রতিষ্ঠিত বড় বড় ব্যবসায়ীরাও তাকে শুভেচ্ছা জানান। এ কয়েক দিনে এতো শুভেচ্ছা বার্তা জানানো হয়েছে যা লেখে শেষ করার মতো নয়।
মনে হয়েছে নতুন জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসানকে মৌলভীবাজার নামে একটি প্রদেশের গভর্নর করে পাঠানো হয়েছে। আমরা উনার প্রজা। উনার অত্যাচার কিংবা নির্যাতন থেকে বাঁচতে আমরা অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
এই শুভেচ্ছা বার্তা গুলো হয়তো ভাইদা ভাই কোনো মাধ্যমে নতুন জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসানের কাছে পৌঁছিয়েছে। এতো অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা পেয়ে হয়তো উনি আনন্দে টইটুম্বুর। এতো তৈলমর্দন দেখে এ জেলার মানুষ সম্পর্কে উনার প্রাথমিক ধারণা হবে। উনার কাছ থেকে মৌলভীবাজারবাসী কতটুকু কাজ আদায় করে নিতে পারবে সেটাও উনি অনুমান করতে পেরেছেন। এজেলার মানুষের ক্ষমতা সম্পর্কে অনেকটা উনার ধারণা হয়ে গেছে।
সদ্য বিদায়কৃত জেলা প্রশাসক বেগম নাজিয়া শিরিনকে মৌলভীবাজারে পদায়নের পরপর নানা গুনে গুনান্নিত করে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানো হয়েছিল। যোগদানের পর শতাধিকের উপরে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে বরন করা হয়। অতিরিক্ত তৈলমর্দনে উনার দায়িত্বকালিন সময়ে আমরা কি পেয়েছি এবং উনি কতটুকু সৃজনশীল কাজ করতে পেরেছেন এটা কমিবেশি মৌলভীবাজারবাসী জানেন।
জেলাবাসীর কাছে আমার অনুরোধ উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে জেলা প্রশাসককে আমরা সম্মান করব। উনার সাথে কখনও খারাপ আচরণ করব না। নিজের সামর্থের আলোকে উনাকে সহযোগীতা করব। কিন্তু কোনো অবস্থাতে এজেলাবাসীর ব্যক্তিত্ব ক্ষুন্ন করে অতিরিক্ত তৈলমর্দন করর না।
লেখকঃ সংবাদকর্মী, মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি, দৈনিক যুগান্তর, hussain.press89@gmail.com
Post Views:
0