সরওয়ার আহমদ
গ্রামীণ প্রান্তিক চাষী আকবর উল্লার কপালে বলিরেখার ভাঁজ কেবল প্রচ্ছন্ন হচ্ছে। বর্গাচাষ করে যেটুকু ধান পেয়েছিলেন সে ধান থেকে ৩ মাসের খোরাকী রেখে বাকী ধানগুলো ধারদেনা শোধের লক্ষ্যে ৫’শ টাকা মণে বিক্রি করে মাত্র অর্ধেক ঋণ শোধ করেছেন। বাকী ঋণের বোঝা যখন মাথায় তখন শাঁকের আঁটি হিসাবে গর্দ্দানে চেপেছে আরেক উপসর্গ। এক মেয়ে এবং এক ছেলে পড়ে মাদ্রাসায়। অপর ছেলে স্কুলের ছাত্র। তিন জনের সেশন ফি সহ আনুসাঙ্গিক খর্চ দাড়ায় পাঁচ হাজার টাকার উপরে। এ টাকা যোগাড় করবেন কোত্মেকে? এ সমস্যাটি নজদিক। সমাধান না করলে ছেলে মেয়েদের শিক্ষা বিপন্ন হবে। গ্রামে গ্রামে খোঁজ নিলে উল্লেখিত আকবর উল্লার মতো অনেক মিয়া উল্লা পাওয়া যাবে যারা সন্তানদের শিক্ষার দায়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও ভারাক্রান্ত। রাষ্ট্র যেখানে খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, বস্ত্র ও চিকিৎসার মতো মৌলিক বিষয়ে সহনুভুতীশীল, সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের কায়েমী স্বার্থের খড়গহস্ত নিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলে পড়েছে। শিক্ষার প্রসারে সরকার যেখানে বিনামূল্যে পুস্তক বিতরণ এবং উপবৃত্তি প্রদানে দরাজহস্ত, সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথিত কর্তৃপক্ষ ছাত্রছাত্রীদের পকেট হাতড়িয়ে অর্থকড়ি কেঁড়ে নিতে তৎপর। এমন নির্জলা বাস্তবতা বিরাজ করছে অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এটা কি তবে বাড়তি রোজগারের ধান্ধা? পর্যবেক্ষণ কিংবা অনুসন্ধানের জাল প্রসারিত করলে এ প্রশ্নের যথাযথ জবাব উঠে আসবে। শিক্ষাবর্ষের সূচনা কালটি হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রুটিরোজগার কিংবা বাড়তি আয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ। বিশেষত মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই ধারণাটি যথাযথ।
বার্ষিক পরীক্ষা শেষে শিক্ষাবর্ষে শ্রেনী উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে সেশন ফি এবং ক্ষেত্র বিশেষে নতুন করে ভর্তি ফি, প্রকাশনী ফি (বার্ষিক প্রকাশনা না থাকলেও) মসজিদের চাঁদা, মিলাদ মাহফিলের চাঁদা সহ নানান উপলক্ষ খাড়া করে পাইকারীভাবে টাকা আদায় করা হচ্ছে। যার সাকুল্য অর্থ কোথাও দুই হাজার কোথাও তিন হাজার বা তারও বেশি টাকা আদায় করা হচ্ছে প্রতি ছাত্রছাত্রীদের নিকট থেকে। এম.পি.ও ভূক্ত প্রতিটি মাধ্যমিক স্কুল এবং মাদ্রাসার ক্ষেত্রে একই স্থির চিত্র দৃশ্যমান। এমতাবস্থায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে জমা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এ ব্যাপারে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার মধ্যেও আছে বিভ্রান্তি। জেলা শিক্ষা অফিসারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ইউনিয়ন ভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেশন ফি বা ভর্ত্তি ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫’শ টাকা। উপজেলা কিংবা জেলা সদরে অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ধার্য্য করা হয়েছে এক হাজার টাকা। অন্যদিকে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে সেশন ফি কিংবা ভর্তি ফি আদায়ে কোনো নির্ধারিত নীতিমালা নেই। তাহলে শিক্ষার্থীদের উপর চাপ প্রয়োগ করে এবং অভিভাবকদেরকে সংকটে ফেলে এ বাড়তি টাকা আদায়ের হেতু কি? এদিকে শিক্ষা বিভাগের আওতাবহির্ভূত কে.জি স্কুল গুলোতে সেশন ফি এবং ভর্তি ফি নিয়ে “গলা কাঁটা” নীতি অবলম্বন করা হয়েছে। ফ্রি ষ্টাইলে আদায় করা হচ্ছে হরেক প্রকৃতির ফি। স্কুলে ভর্তি বাণিজ্য ছাড়াও আরেক বাণিজ্যের নাম হচ্ছে মাধ্যমিক ও দাখিল পরীক্ষার ফি আদায়। বোর্ড নির্ধারিত ফিকে পাশকাটিয়ে ইচ্ছামতো আদায় করা হয় পরীক্ষার ফি। তার সাথে যুক্ত করা হয় কোচিং ফি। যার ফলে অভিভাবক মহলে ত্রাহি ত্রাহি সূর উঠে। এ ফ্রিষ্টাইলে টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের “ডুপ্লিকেট” ভাউচার হচ্ছে মূল হাতিয়ার। অডিটকালে ভাউচার এবং তথ্য গোপন করে আয়ব্যয়ের হিসাব উত্তরণ করা হয় নির্দিষ্ট ছকের ভিত্তিতে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে- ভর্ত্তি মৌসুম এবং পরীক্ষার ফি আদায়ের সুযোগ অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গড়ে উঠা ফান্ডের নিয়ন্ত্রক হচ্ছেন প্রাতিষ্ঠানিক প্রধান এবং ম্যানেজমেন্ট কমিটির প্রভাবশালী পক্ষ। এই দুইপক্ষের যোগসাজসেই স্বার্থান্বেষী শিক্ষা বাণিজ্যের রমরমা ভাব চলছে এবং চলবে। মধ্যখানে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক মহলের ভোগান্তি কি তবে ললাট লিখনই হয়ে থাকবে?
লেখকঃ সম্পাদক, মৌলভীবাজার প্রতিদিন।