সরওয়ার আহমদঃ
১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধ কালে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হানাদার বাহিনীর সারিবদ্ধ কবরের উপর তৈরী হয়েছে পাবলিক টয়লেট তথা গণ পায়খানা। এই বাস্তবতার নেপথ্যে নিয়তির বিচার নাকি অবচেতনা নিহিত, তা নিয়ে কৌতুহল আছে বিভিন্ন মহলে। তবে কালের সিড়ি ভেঁঙ্গে এই বাস্তবতা ইতিহাসের সাক্ষ্যবহন করছে মৌলভীবাজারস্থ জেলা কালেষ্টরের কমপ্লেক্স লাগোয়া পূর্বদিকের অবকাঠামোতে।
১৯৭১ সনের এপ্রিল মাসে তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমা হানাদার বাহিনীর পূনদর্খলে চলে যাবার পর মৌলভীবাজার কলেজ এবং নিকটবর্তী পি.টি.আই ইন্সটিউটে গড়ে তোলা হয় ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার। সেনা বাহিনীর স্থান সংকুলান না হওয়াতে বর্তমান দিষ্ট্রিক্ট কালেক্টরেট বিল্ডং লাগোয়া আনসার ক্যাপটাওর সেনা ইফনিট হিসেবে ব্যবহৃত হত। সে সময়ে বর্তমান কালেক্টরেট বিল্ডংস্থলে ছিলো ফাঁকা মাট। কালের অগ্রযাত্রায় সেই বাস্তবতা ডেকে গেছে মাটিভরাট এবং ইট পাথরের গাঁথুনীতে।
৭১ সনের জুলাই মাস থেকে মহকুমার সীমান্ত অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেলে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নিহতের কলেবর বৃদ্ধি পেতে থাকে। সে সময়ে হানাদার বাহিনীর হাতে আটককৃতদের মতে-নিহত সেনাদের লাশ বিভিন্ন এলাকা থেকে এনে জড়ো করা হতো- মৌলভীবাজার কলেজ এবং পি.টি.আই ইন্সিটটিউটে। অত:পর রাতের আধারে আটকৃতদের দ্বারা কবর খনন করে নিহতদের সমাধিস্থ করা হতো কলেজ ও পি.টি.আই সংলগ্ন পাহাড়ী টিলাতে এবং ঢালোতে। হানাদার বাহিনীর হাতে ধৃত শ্রীমঙ্গল উপজেলার মাইজদিহি চা-বাগানের ইসমাইল সর্দ্দার জানান- তিনি নিজেও প্রতি রাতে কবর খনন করেছেন অন্যান্যদের সাথে। একই কবরে ৪/৫ টি কওে লাশ সমাহিত করা হতো উর্দ্দিপরা অবস্থায়। তারমতে, অক্টোবর থেকে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। প্রতি রাতে ৪০/৫০ জন নিহত সেনার লাশ দাফন করতে হতো। এমতাবস্থায় নতুন কবরস্থানের সন্ধান করতে হয়। বর্তমানে কোর্ট মার্কেট এর পেছন দিক এবং ডিষ্ট্রিক্ট কালেকক্টরেট বিল্ডং এর সম্মুখের বিস্তৃত জায়গাটি ছিলো ঢালু এবং জঙ্গঁলকীর্ণ। এই জায়গাটিকেই হানাদার বাহিনীর কবরস্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিলো। ঐতিহাসিক ধলইযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালীন ডিসেম্বরের চুড়ান্ত যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের অধিকাংশকেই এখানে সমাহিত করা হয়। আটককৃত ইসমাইল সর্দ্দারের সাথে হানাদার সুবেদার খোয়াজির খানের ঘনিষ্টতা জমে উঠেছিলো পর্য্যায়ক্রমে। মধ্য নভেম্বরের একসন্ধ্যায় খোয়াজির খাঁন ইসমাইল সর্দ্দারকে ডেকে একটি জীপে তোলেন এবং শহরতলীয় জগন্নাথপুরের একটি পাহাড়ি টিলার নিকট গাড়ী থামিয়ে তাকে আড়ালে ডেকে নেন। অত:পর সুবেদার তাকে বলেন- এখান থেকে তুমি পালাতে পারবে? থতমত খেঁয়ে যাওয়া ইসমাইল সর্দ্দার প্রথমে কিছু না বললেও শেষে হ্যাঁ সূষ্ক সম্মতি জানান। অত:পর খোয়াজির খান তাকে বুকে জড়িয়ে বলেছিলেন- সাত ভাইয়ের মধ্যে আমিই অবশিষ্ট আছি। বাকী ছয়জন মারা গেছে- আখাউড়া, কশবা এবং ভৈরব বাজারের যুদ্ধে। আমার জন্য দোয়া করো বলে- ইসমাইল সর্দ্দারের হাতে পঞ্চাশ টাকা ও দশ টাকার বান্ডিল গুজি দিয়েছিলেন এই সুবেদার। ইসমাইল সর্দ্দার বলেন- খোয়াজির স্যার বেঁচেছিলো নাকি- কোট প্রাঙ্গঁণের ২/৩ শ সমাধিস্থলে অন্তিম শয়ানে আছেন, জানিনা। ডিষ্ট্রিক্ট কালেক্টরেট বিল্ডিং সম্মুখস্থ এলাকায় হানাদার বাহিনীর সমাধিস্থলের কথা স্বীকার করে মুক্তিযোদ্ধ দেওয়ান আবুল খয়ের চৌধুরী বলেন- মৌলভীবাজার শহর মুক্ত হবার সাথে সাথেই রাতে মাটি খুঁড়ার তান্ডব চলতো। তিনি বলেন- হানাদার বাহিনীর কবরের ছাঁদ দেয়া হতো বিভিন্ন এলাকার পুড়ে যাওয়া ঘরের ঢেউ টিন দিয়ে। হানাদার মুক্ত হবার পর এক শ্রেনীর মানুষ এই কবরের মাটি সরিয়ে ঢেউটিন গুলো নিয়ে যেতো। সামরিক শাসক এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৪ সনে মৌলভীবাজার মহকুমা জেলাতে রুপান্তরিত হবার পর আনসার অফিস সম্মুখস্থ বিস্তৃত খেলার মাঠে কালেক্টরেট কমপ্লেক্স নির্মাণ শুরু হলে সংলগ্ন এলাকায় আরম্ভ হয় মাটি ভরাট। এ প্রক্রিয়ায় মাট সংলগ্ন ঢালু এলাকা ভরাটকরা হলে ঢেকে যায় হানাদার সেনার কবরস্থান। ভরাটকৃত জমির দক্ষিণাংশে নব্বুই দশকের সূচনায় তৈরী হয় উকিলবার। বার ভবনের কিনার ঘেষে ২০১২ সনে পৌরসভার উদ্যোগে তৈরী হয় পাবলিক টয়লেট তথা গণ পায়খানা। নতুন প্রজন্ম জানেনা এ সমস্থ স্থাপনার নিচে নিভৃতে পড়ে আছে হানাদার বাহিনীর সারিবদ্ধ কবর।
Post Views:
0