সরওয়ার আহমদঃ
স্বাবলম্বী কৃষক পরিবারের অন্যতম অবলম্বন ছিলো মাছ ধরা। মাছে ভাতে বাঙ্গালীর প্রবচনকে যথার্থ করার জন্য ভাতের সাথে মাছ অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলো। প্রতিদিন মাছের যোগান দেওয়ার বন্দোবস্তও ছিলো বারোমাসী রুটিনের অঙ্গঁ তুল্য। বর্ষা মৌসুমের আগমণী নির্ঘন্ট হিসেবে বৈশাখী ঢল ছিলো গ্রাম বাংলায় আরাধ্য। ঝড়ো বৃষ্টির সাথে দেয়া ডাকের যোগ সাজসে জলাশয়ের মাছ যেনো হ্যামিলমের বংশীর সূরাচ্ছন্ন হয়ে অবস্থান ত্যাগের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠতো। সব প্রজাতির জিওল মাছ তখন পুকুর কিংবা দীঘির বেষ্টনী অতিক্রম করে বৈশাখী ঢলের পানিতে অবগাহনে উন্মুখ হয়ে পড়তো। এ সুযোগে ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিকারী মানস মাছ ধরার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ার দশা। রাতের বেলায় টর্চ লাইট কিংবা কেরোসিনের “বুমা” হাতে নিয়ে প্রতি বাড়ীর মানুষ উজাইর মাছ ধরার জন্য নেমে আসতো। কৈ, টাকি, শিং ও মাগুর মাছ তখন ধরা পড়তো পুকুর পাড়ে, খালে এবং জলমগ্ন ধানী জমিতে। বৈশাখ থেকেই শুরু হতো জাল, পলো, চাঁই (ডরি) পারণ এবং উকা দিয়ে মাছ ধরার প্রবণতা। গ্রামীণ খালের পানি নিসৃৃত হতো নিকট বর্তী নদী কিংবা হাওড়ে। হাওড় এবং নদীর মাছ তখন উজানের ¯্রােত ঠেলে এবং প্রজননলীলার টানে উজান মুখী হয়ে উঠতো। আবার কখনও ভাটির উদ্যোশে ধাবিত হতো। এই আগমণ নির্গমণের সুযোগ নিত পেশাদার এবং অপেশাদার জেলেরা। কিশোর বয়সে স্বগ্রামের প্রত্যেক ঘরে ঘরে দেখেছি হরেক প্রকৃতির জাল। তন্মধ্যে “পেলইন” আঁফা, মণিপুরী (টানাজাল) ও ছিটাকী জাল ছিলো উল্লেখ যোগ্য। লোহার কাটি সংযুক্ত উড়াল জাল থাকতো সম্পন্ন গৃহস্থ ঘরে। বৈশাখ শেষে প্লাবন ভূমি যখন জলমগ্ন হয়ে উঠতো, তখন মাছের প্রাচুর্য্যও বেড়ে যেত। দিনের একটি নিদিষ্ট সময়ে অর্থাৎ হয়তো সকালে কিংবা বিকালে কৃষকরা জাল নিয়ে নেমে পড়তো প্লাবন ভূমিতে। তিন বেলার খাবার উপযোগী হরেক প্রজাতির মাছ নিয়ে সকলেই ঘরে ফিরতো। ধৃত টাটকা মাছের স্বাদই ছিলো আলাদা।
গ্রাম বাংলায় বৈশাখ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত মাছ ধরার ক্ষেত্রে ও কৌশল ছিলো বহুমুখী। ভাদ্র মাস থেকে প্লাবনের পানি নামতে শুরু করলে মাছ ধরার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেতো। সমুদ্র উপকূলের ঘেরের আদলে কয়েকজন উদ্যোগী মিলে গ্রাম বাংলার ধানী জমির আইল’কে কাঁদা তুলে উঁচু করতো। তাতে জমির মাছ আটকা পড়ে যেতো। গ্রামীণ পরিভাষায় এই পদ্ধতিকে বলা হতো “ডাঁক”। রাতে এই ডাঁকের উচুকরা কিয়দংশ অপসারণ করে তাতে পাতানো হতো ডরি উঁকা ও পারণ। সকালে এ সমস্থ উপকরণে ধরা পড়তো হরেক প্রজাতির ছোট মাছ। বিশেষত দিনে ধরা পড়তো টাকি, পুঁটি ও বাইন মাছ বেশী মাত্রায়। তখন খাওয়ার অতিরিক্ত মাছকে শুটকি করার ব্যবস্থা নেয়া হতো। প্রতি বাড়ীতে শুটকির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ফলে বাতাস ভারি হয়ে উঠতো শুটকির গন্ধে।
যে এলাকায় নদী বা খাল রয়েছে, সে এলাকার অবস্থা ছিলো তথৈবচ। ভাসান এলাকার মাছ প্লাবন ভূমি থেকে নদী বা খালেই নি:সৃত হতো। তাই ভাদ্র মাস থেকেই নদী বা খালের তীরবর্তী জনপদে মাছের রাজ্য বিরাজ করতো।
(——–চলবে)
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক