সরওয়ার আহমদঃ আবহমান বাংলায় নৌকার অপরিহার্য্যতা নিয়ে লিখা যাবে অনেক কিছু। কিন্তু সে পরিসর এখানে নেই। পানসী নৌকা, খেয়া নৌকা, খেলুয়া নৌকা নিয়ে কিংবদন্তী আছে অনেক। কৈশোরে কর্ণকহারে যে গান বা জারি-সারি কর্ণকৃহরে অনুরণ তুলতো বর্তমানে বাস্তবতায় সেটি অপসৃত হলেও, মর্মমূলে তার অনুভূতি এখনও অমলিন। “ আষাঢ় মাসের ভাসা পানিরে, আসে বাড়ীর পাশে, পানসী নায়ের মাস্থুল দেখি, মনে হয়রে আমার নি কেউ আসে…। ভাসান পানিতে পালতোলা পানসী নৌকা নাও ঘাটে ভিড়লেই বাড়ীর অবলা বধুর মন আকুলি বিকুলি করে উঠতো। হয়তো দল বেধে নিজের স্বজনরা তাকে দেখতে কিংবা নিতে এসেছে। এক কালে আত্মীয় বাড়ী বেড়ানোর মোক্ষম সময় ছিলো বর্ষা কাল। পরিবারের সবাই পানসী নৌকাতে চড়ে “পানিছয়ের” করতে করতে স্বজনদের বাড়ীতে হাজির হতেন। তাও-আবার খালি হাতে নয়। সামর্থ্য অনুযায়ী নিয়ে যেতেন ফল ফলারী, পাটালী গুড়, কিংবা হাতের তৈরী সন্দেশ পিঠা। আগত মেহমানদেরকে আদর আপ্যায়নেরও কমতি ছিলো না অন্যপক্ষের।
বর্ষা মৌসুমে নৌকাবাইচ আবহমান বাংলার লোক সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ বলেই গণ্য ছিলো। গ্রামের অবস্থা সম্পন্ন সৌখিন গৃহস্থরা লম্বা “খেলুয়া নৌকা” বানাতেন। বাড়ীর ঘাটে খেলুয়া নৌকা বাঁধা থাকলে গৃহস্থদের নাকি আলাদা গৌরব অনুভূত হতো। তাই বর্ষায় গ্রাম গ্রামান্তরের খেলুয়া নৌকার সমাহার ঘটতো নৌকাবাইচ উপলক্ষে হাওরে কিংবা নদীতে। নৌকাবাইচের উদ্যোক্তা পক্ষ টিঠির মাধ্যমে খেলুয়া নৌকার মালিককে নিজ নৌকা নিয়ে যথাসময়ে যথাস্থানে উপস্থিত হবার জন্য আমন্ত্রণ জানাতেন। আমন্ত্রণ অনুসারে নৌকার মালিকপক্ষ খেলুয়া নায়ের “বাইছা” (মাল্লা) দেরকে দাওয়াত করতেন। গ্রামের এসমস্থ বাইছাগণও সাগ্রহে সাড়া দিতেন। বাইছাদেরকে নায়ে উঠার আগে একবার আপ্যায়ন করানো হত। একই ভাবে বাইচ শেষে বাড়ীতে ফেরার পর পুণরায় আপ্যায়নের ব্যবস্থা থাকতো। বাইছারা সবাই নায়ে উঠে খোল করতাল ও ঢুলের তালের সাথে তাল মিলিয়ে বৈঠা চালিয়ে গন্তব্য অভিমুখে রওয়ানা দিতেন। খেলুয়া নৌকার পেছনে পেছনে দর্শকদের ছোট নৌকাও ছুটতো। খেলুয়া নৌকার মাঝামাঝিতে অবস্থান নিতেন গায়েন। মন্দিরা হাতে নিয়ে তিনি সুর তুলতেন। “এসকের খেলুয়া নাও মিরাশে দৌড়াও, মনরে মাসুকের ঘাটে জলদি লয়াই যাও”। গায়েনের সুরের সাথে বাইছারাও- কন্ঠ মিলাতো। গায়েনের জারি গান ছিলো হরেক ঢং এর। কিছু কিছু জারি সারির কলি এখনও মরমে বিঁধে আছে। যেমন- মনের সাধ মিঠাইলায়নি, করিফুল নেছাগো…. নেছা মনের সাধ মিটাইলায়নি। এই করিফুনেছা কর্তৃক স্বামী দেওয়ান কটু মিয়া হত্যার কাহিনী অবলম্বনে জারিটি রচিত হয়েছিলো বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে। আরেকটি জারির কলি ছিলো- বামনের মাইয়া ভর যুবতী তা-ই কাঞ্চা রাড়ি, দুই হাত উঠাইয়া ডাকে আইসো আমার বাড়ী…। বিধবা ব্রাহ্মণ কন্যা এবং গাংএর জেলের মাধ্যে গড়ে উঠা অসম প্রেমের বর্ণনা ছিলো জারিতে। গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে খেলুয়া নৌকার পাশাপাশি ছোট নৌকার দৌড়ও জমে উঠতো। কিশোর বয়সে দেখেছি মৌলভীবাজার শহরস্থ বেরী লেইকে ছোট নৌকার বাইচ জমে উঠতো।
নদী পারাপারের জন্য খেয়াঘাট ছিলো প্রতিটি এলাকায়। লোকাল বোর্ড থেকে ঘাট ইজারা দেয়া হতো। এসমস্থ খেয়া পারাপারের জন্য নৌকা এবং মাঝি নিয়ে অনেক কিংবদন্তী আছে। ভাদ্র আশ্বিন মাসে উজান অভিযাত্রার মাছ লাফ দিয়ে নৌকাতে আছড়ে পড়তো। এ মাছ ধরা নিয়ে ধস্তাধস্তি কালে কোথাও নৌকা ডুবি ঘটতো। খেয়া ঘাট একালের বার্তা সংস্থারও ভূমিকা রাখতো। এলাকার যাবতীয় খবরা খবর প্রথম চাউর হতো খেয়া ঘাটে। খবরের বাহক ছিলেন বিভিন্ন এলাকার পারাপারকামী লোকজন। বর্ষাকালে গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে নৌকার পাশাপাশি কলাগাছের ভেলার অবস্থানও ছিলো। যারা গরীব, তাদের পক্ষে গাছ নৌকা তৈরী অসম্ভব থাকায় নৌকার বিকল্প হিসেবে কলাগাছ কেঁটে ভেলা তৈরী করতেন ঘাস কাটা কিংবা চলাচলের জন্য। কৌতুক বশতঃ অনেকে এই ভেলাকে জাহাজ বলতেন।