সরওয়ার আহমদঃ
সুস্থ বিবেক ও প্রখর দৃষ্টির আলোকে এ কথাটি প্রশ্নাতীত ভাবে সত্য যে, ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্টে সপরিবারে বঙ্গঁবন্ধু হত্যা বিশ্ববাস্তবতার মধ্যে একটি নিকৃষ্ট ও কলংকিত ঘটনা হিসেবেই গণ্য। সাম্রাজ্যবাদের ইন্ধনে এবং তাদের দেশীয় বশংবদ তথা কেনা ভারবাহীদের যোগসাজসে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্র নায়ক হত্যা এবং ক্ষমতার পট পরিবর্তন কোন নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো সপরিবারে রাষ্ট্রনায়ক হত্যার এমন নারকীয় ও নৃশংসতম ঘটনা বিশ্বের মধ্যে বিরল এবং নজির বিহীন। ঘাতক আনুকূল্যে এই নৃশংসতম ঘটনার আইনী প্রতিকারের পথ রুদ্ধকরণের বিষয়টিও নজির বিহীন। কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতার দেয়ালও যে ভেঙ্গে যায় এবং ঘাতক তার কৃত অপরাধের সমুচিত শাস্তি বিলম্ব হলেও ভোগ করে, সেটিও প্রমানিত সত্য। নিয়তি এবং ইতিহাসের অভ্রান্ত পরিক্রমার নিকট অশুভ পরাক্রম পদানত হয়ে আসছে কাল থেকে কালান্তরের ধারায়। এই বাস্তবতা অস্বীকারের কোন বিকল্প নেই। যে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (এবং পরবর্তীকালে আইন) দ্বারা বঙ্গঁবন্ধু হত্যা মামলার পথ রুদ্ধ করা হয়েছিলো, ১৯৯৬ সনে সেই রুদ্ধ কপাট খুলে গিয়েছিলো। ইনডেমনিটি আইন বাতিল হবার পর ১৯৯৬ সনে বঙ্গঁবন্ধুৃ হত্যা মামলা শুরু হয়েছিলো আর তার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছিলো ২০০৯ সনে। মামলাটি বিচারাধীন ছিলো প্রায় একযুগ পর্যন্ত। অথচ মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী এবং ইন্ধিরা গান্ধী হত্যা মামলা নিষ্পত্তি হতে বছর দিনও সময় লাগেনি। কিন্তু বাংলাদেশের স্থপতি ও প্রেসিেিডন্ট হত্যা মামলাটি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে একযুগ বিলম্বের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থারও একটি মন্দ নজির হিসেবেই গণ্য।
১৯৯৮ সনে ঢাকার যেমন জজকোর্টে মামলাটির রায় ঘোষিত হবার পর দন্ডপ্রাপ্তদের ডের্থরেফারেন্স হাইকোর্টে পাঠানো হলে রেফারেন্সটি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চের উপর শুনানীর দায়িত্ব বর্তায়। কিন্তু বেঞ্চের তৎকালীন বিচারপতি আমীরুল কবীর ডের্থরেফারেন্সটি শুনানীর ক্ষেত্রে বিব্রতবোধ করেন। তারপর মামলাটি অপর বেঞ্চে স্থানান্তরিত হলে সেই বেঞ্চের দুই বিচারপতি রুহুল আমিন ও আব্দুল মতিন একইভাবে বিব্রতবোধ করেন। বিচারপতি পদটি অবশ্য তার আগেই বিতর্কিত হয়ে উঠেছিলো। এই দেশে দুই বারের সামরিক শাসনকে জায়েজকরণ, সামরিকশাসক কর্তৃক দল গঠনের ক্ষেত্রে বিচারপতিদেরকে ব্যবহার করা, কিংবা পাতানো নির্বাচন কে সিদ্ধ ঘোষণার ক্ষেত্রে বিচারপতিদেরকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে বসানোর দিকটি ধারণায় নিলে বিচারপতি কর্তৃক বঙ্গঁবন্ধু হত্যা মামলার শুনানীর ব্যাপারে বিব্রত বোধ কোনো অসম্ভব বিষয় নয়। যারা বিব্রতবোধ করেছিলেন তারা হয়তো পাকিস্তান পন্থী নয়তো ঘাতকচক্রের পক্ষশক্তি ছিলেন বলেই একটি দেশের স্থপতি ও প্রেসিডেন্ট হত্যা মামলার শুনানীর ক্ষেত্রে তাদের অনীহা ছিলো। অবশ্য সব বিচারপতিকে একই মানদন্ডে পরিমাপ করা সঙ্গঁত নয়। বঙ্গঁবন্ধু হত্যা মামলার ডের্থরেফারেন্স শুনানীর ক্ষেত্রে বিব্রত বোধের নাটকের পর অপর বেঞ্চে মামলাটির শুনানী হয়। শুনানী শেষে ২০০০ সনে মামলাটির বিভক্ত রায় ঘোষিত করেন বেঞ্চের দুই বিচারপতি। এমতাবস্থায় তৃতীয় বিচারপতির বেঞ্চে মামলাটি নীত হয় ২০০১ সনের ফ্রেবুয়ারি মাসে। বিচারপতি জনাব ফজলুল করিম একই সনের ৩০ এপ্রিল তারিখে তার রায়ের মাধ্যমে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। কিন্তু রায়ের বিরুদ্ধে আপীলের সুযোগ ছিলো। কিন্তু আপীল কোর্টে মামলাটি নীত হলে সেটি পড়ে থাকে হিমাগারে। কারণ তখন ক্ষমতায় এসেছিলো বি.এন.পি জামায়াত জোর্ট। হাইকোর্টের আপীল বিভাগে বিচারক সংকটের অজুহাতে বঙ্গঁবন্ধু হত্যা মামলাটি পড়ে থাকে পাঁচ বছর । তাতে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফায়দা ভোগী ছিলো বি.এন.পি, জামায়াত এবং তাদের পক্ষ শক্তি। তাই মামলাটিকে স্থির মস্তিস্কেই চেপে রাখা হয়েছিলো। কিন্তু ন্যায়ের দন্ড এবং নির্দোষ রক্তের ধারা আপনমহিমা বলে প্রতিবন্ধকতা টপকে স্বমূর্তিতে আর্বিভূত হয়। তাই ২০০৭ সনে তত্ত্ববধায়ক সরকারের আমলে পুনরায় আপীল বিভাগে মামলাটি চালু হয় এবং শেষ হয় ২০০৯ সনে। মামলায় ২০ জন আসামীর মধ্যে ১২ জন সামরিক অফিসারের মৃত্যু দন্ড দেয়া হয়। তন্মধ্যে আটক পাঁচ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়। বাকি ৭ জন পলাতক অবস্থায় বিদেশে রয়েছে।
এখানে প্রাসঙ্গিত যে, বঙ্গঁবন্ধু হত্যার পর ২১ বছর পুন:পৌণিক সামরিক এবং স্বৈরশাসনের পর ১৯৯৬ সনে বঙ্গঁবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচন বিজয়ী হয়ে আওয়ামীলীগ ক্ষমতাসীন হলে বঙ্গঁবন্ধু হত্যার বিচারের দাবীটি জাতীয় দাবি হিসেবে উত্থিত হয়। এ প্রেক্ষাপটে জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইনটি বাতিল হয়ে যায়। এমতাবস্থায় বঙ্গঁবন্ধুর রেসিডেন্সিয়াল পি.এস.আ.ফ.ম মোহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে ফৌজদারী আইনে ১৯৯৬ সনের ২ অক্টোবর তারিখে ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এই মামলাতে দৃশ্যমান আসামী হিসেবে ২৩ জনকে শনাক্ত করা হয়েছিলো। এই মামলার বিচারিক নিষ্পত্তি এবং দন্ডপ্রাপ্তদের একাংশের দন্ড কার্যকর হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তারপরও শেষ হয়ে হইলো না শেষ” এর একটি অন্তরাল আর্তি গোঠাজাতি সত্তার মধ্যে নীরবে নিভৃতে অনুরণ তুলেছে। সপরিবারে বঙ্গঁবন্ধু হত্যার ক্ষেত্রে কি কেবল দন্ডপ্রাপ্ত আসামীরাই জড়িত? তার বাইরে নেপথ্য শক্তি হিসেবে আরো কারা এবং কোনশক্তির যোগসাজস বা ইন্ধন ছিলো, তাদেরকে শনাক্তকরণ ও মুখোশ উন্মেচন কালের বাস্তবতার আলোকে প্রয়োজন। এ ব্যাপারে নির্বিকার থাকলে অনাগত দিনের ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে গবেষক, বুদ্ধিজীবী, এবং অনুসন্ধিৎসু মহলকে। (চলবে)