পর্ব-৩
সরওয়ার আহমদঃ
তৎকালীন গ্রামীণ পরিপাটি বাড়ীঘরের পাশাপাশি ব্যতিক্রমী অবস্থাও ছিল প্রায় প্রতিটি গ্রামে। হাল আমলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মতো সে আমলেও গ্রামীণ এলাকার রায়ত বা প্রজা শ্রেণী ছিলো। জমিদার ও মিরাশদার শ্রেণীর “কবুলিয়তী” জমি জমার উপর তারা ছিলো নির্ভরশীল। এমতাবস্থায় “কবুলিয়তী” জমির উপর কোনক্রমে ভিটে বাড়ী নির্মাণকরে বসবাস ছাড়া কোন বিকল্প ছিলোনা তাদের। ফসলী মাঠের উপর ডিবি সদৃশ বাড়ীর মধ্যে একপ্রকার ঝুঁপড়িঘর তৈরী করে বসবাসই ছিলো তাদের নিয়তি লিখন। বর্ষা মৌসুমে চারিদিক পানিতে সয়লাব হলে এসমস্থ বাড়ীঘরকে ক্ষুদ্র দ্বীপের মতো মনে হতো। বাড়ীতে গাছ গাছালীর সংখ্যাও ছিলো কম। গাছে ফল ধরলে সেই ফলের একটি অংশ মিরাশদার বাড়ীতে পৌছে দেয়া হতো। বার্ষিক খাজনাতো ছিলো প্রচলিত বিধান। খাজনা বাকী থাকলে মিরাশদাররা রায়তের উঠানে হাল জড়ে দিতেন।
গ্রামীণ যোগাযোগের ক্ষেত্রে রাজআইল ছিলো প্রধান বাহন। জমির সিমানা নির্ধারনী আইলের চাইতে এ আইলটি দ্বিগুন ত্রিগুন বড় থাকায় বোধ হয় নামকরণ করা হয়েছিলো রাজআইল। রাজআইল যেদিকে ধাবিত ছিলো তার আশপাশের জমি মালিকরা নিজ উদ্যোগে মাটি কেঁটে আইলের বড়ত্ব ধরে রাখতেন গ্রামীণ বিধান অনুসারে। এই রাজআইল বেয়েই গ্রামীণ লোকজন এখান থেকে সেখানে, এ গ্রাম থেকে সেগ্রামে আসা যাওয়া করতেন। গ্রামীণ যোগাযোগের ক্ষেত্রে অন্য আরেকটা বাহন ছিলো “হালট” অথবা গোপাট। এটি রাজআইলের আদলের মতো হলেও প্রশস্ত ছিলো দ্বিগুণ বা ত্রিগুণ। এই গোপাট ছিলো মাঠের মতোই সমতল। গোপাটে মাটি ভরাটের প্রয়োজন ছিলোনা। গ্রামীণ আন্ত:যোগাযোগ এর ক্ষেত্রে এধরণের গোপাটই “রাজপথ” বলে গণ্য হতো। তাছাড়া এসমস্থ গোপাট ব্যবহৃত হতো গরু চলাচলের পথ হিসেবে। গোপাট বেয়ে গৃহপালিত গরুর দলের গমন নির্র্গমণের দৃশ্যটা পশু মিছিলের মতোই প্রতীয়মান হতো। বর্ষা মৌসুমে ধানক্ষেত না ছুঁয়ে নৌকা চলাচল করতো গোপাট দিয়ে। তখন গোপাটের শেষ সীমানা কে মনে হতো ক্ষুদ্র নৌবন্দরের মতো।
গ্রামীণ সংযোগ রক্ষার্থে বাঁশের সাকোঁর ভূমিকান্ড কম ছিলোনা। অধিকাংশ গ্রামেই ছিলো পানি সিস্কাশনের জন্য খাল বা ছোট নালা। এসমস্থ খাল পারাপারের জন্য তৈরীকরা হতো বাঁশের সাঁকো। সাঁকো পার হতে গিয়ে সাবধানতা অবলম্বন করা হতো। নতুবা পাঁ ফসকে গিয়ে প্রপাতধরনীতলের অবস্থা দাড়াতো কোন কোন পারাপারকারীদের।
(——–চলবে)
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
দিন গুলো মোর সোনার খাঁচায় রইলো না
