সরওয়ার আহমদঃ
পর্ব-২
মানুষের পরিচিতির ক্ষেত্রে প্রথমে আসে নাম। তারপর ধাম। পিতৃপরিচয় কিংবা অন্যান্য আনুষাঙ্গিক সমাচার আসে পরবর্তী স্তরে। লেখক হিসেবে নামোল্লেখের প্রসঙ্গঁ চুঁকে গেছে। ধামের প্রসঙ্গঁ আসলে বলা যায় ৪/৫শ বছর আগে মনু এবং কাউয়াদীঘির মধ্যবর্তী এলাকার যে চর জেগে উঠেছিল এবং সেই বিস্তৃত চরের একাংশ যে জনবসতি গড়ে উঠেছিলো সেই জনবসতীর নাম উলুয়াইল। বৃটিশ আমলের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার আলোকে পূর্ব পুরুষরা বসবাসের জন্য যে বাড়ী তৈরী করেছিলেন, সেই বাড়ীটির আয়তন ছিলো ১৮ বিঘারও অধিক। সেই বাড়ীর একাংশের একটি ভিটায় জন্ম হয়েছিলো পঞ্চাশের দশকের সূচনাকালে। বোধোদয়ের পর চর্ম্মচক্ষে ভেসে উঠেছিল দশটি ভিটা সম্পন্ন লম্বা একটি বাড়ী। বাড়ীর সম্মুখে বড় একটি পুকুর এবং তাতে ছিলো ৪টি ঘাট। পেছনে এবং বাড়ীর বামদিকে ছিলো আরোও দু’টি ছোটপুকুর বৌ-ঝিঁদের জন্য বরাদ্দ করা। সামনের বড় পুকুরে মহিলাদের যাতায়াত ছিলো নিষিদ্ধ। বাড়ীর গৃহ কাঠামো ছিলো সুধিন্যস্ত। এক লাইনে ছিলো পূর্ব এবং পশ্চিমের ঘরগুলো। পূর্বের গৃহের ২০/২৫ ফুট সামনে ছিলো গোয়াল ঘর। গ্রামের অন্যান্য বাড়ীর কাটামোও ছিলো অনুরূপ এবং কিঞ্চিত ব্যাতিক্রম।
ছয় দশকের আগে গ্রামের বাড়ীঘর গুলোর যে চিত্র মানসপটে গেঁথে আছে তার অবিকল চিত্রাঙ্কন সম্ভব না হলেও দৃশ্যপট তুলে ধরা যায় নির্বিঘেœ। গ্রামের ৯৫% শতাংশ ঘরে ছিলো ছনের ছাউনী। এই ছনের মধ্যেও ছিলো ভিন্নতা। যাদের আর্থিক অবস্থা কিছুটা ভালো ছিলো, তারা পৌষ মাসে পাহাড়ী ছন দ্বারা ঘরের ছাউনী দিতেন। গরীব জনরা অগ্রাহায়ণ মাসেই শাইল কিংবা বোনা আমনের লম্বা নেড়াকে ছোট আঁটি বেঁধে শুকিয়ে পাহাড়ী ছনের বিকল্প হিসেবে ঘরের ছাউনীতে লাগাতেন। ঘরের বেড়াতে মুলি কিংবা জাই বাশ ব্যবহার করতেন অবস্থা সম্পন্নরা। বাকীরা স্থানীয় ভাবে গজানো প্রাকৃতিক “ইকর” দিয়ে বেড়া তৈরী করতেন। “ইকরের” বেড়াও টেকসই ছিলো। ইকরের ফাঁক দিয়ে যাতে বাতাস না ঢুকে সে জন্য হাল আমলের সিমেন্ট প্লাষ্টারের মতো কাঁদামাটি দিয়ে ইকড়ের উপর প্রলেপ বসাতেন গৃহিনীরা নিপুঁণ হাতে। অধিকাংশ ঘরের দরজা জানালা ছিলো সেকেলে। রাতে ঘরের দরজা বন্ধ করার জন্য ব্যবহৃত হতো দরজার মাপে বাঁশের তৈরী ঘাটা। ঘাটার মধ্যভাগে পাটের তৈরী গোলাকৃতির রসি লাগানো হতো। এই রসির মধ্যে ঘাটার মাপের আস্ত বাশের “বেন্দা” দিয়ে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করার সিষ্টেম ছিলো। একই পদ্ধতিতে ঘরের জানালাও তৈরী করা হতো। যাদের আর্থিক অবস্থা কিছুটা সংহত ছিলো তাদের দরজা জানালা কাঠের চৌকাটের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো হাল আমলের কব্জার সমন্বয়ে। গ্রামের সম্ভ্রান্ত বাড়ী গুলোর মধ্যে “ইসপল্টু’র” ঘর ২/১টি ছিলো। ইসপল্টু’র অভিধানিক অর্থ উদ্ধার সম্ভব হয়নি। ইসপল্টুর ঘর বলতে সে সময়ে “রানী মার্কা” ঢেউ টিনের ঘরকেই বুঝাত। কাটের পেটি-বর্গার উপর প্রতিষ্ঠিত ঢেউটিনের চালা সূর্য্যরে আলোকে যখন চিক চিক করতো, তখন সেই ঘরের মর্যাদা ছিলো আলাদা। বিশেষত: তৎকালীন মিরাশদার এবং জাহাজের সারেংরা নিজ নিজ অভিজাত্য জাহিরের লক্ষ্যে এ ধরনের ঘর বানাতেন। বাড়ীর বাসিন্দারা এই ঘরকে টঙ্গী অথবা বাংলাঘর বলেই ডাকতো। এই টঙ্গী কিংবা বাংলা ঘরে গ্রামীণ সালিশ বৈঠক বসতো। বাড়ীর ছোট আচার অনুষ্ঠানও সম্পন্ন হতো। বাড়ীতে মেহমান আসলে অথবা দূরগামী কোন পথিক তথা মুসাফির রাত্রী যাপন করতে চাইলে টঙ্গীঘরই ছিলো তাদের যথোপযুক্ত স্থল।
(——–চলবে)
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক