কমলগঞ্জ প্রতিনিধি:
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় সর্বত্র বাণিজ্যিকভাবে মধু চাষের ব্যাপকতা বাড়ছে। পূর্ব থেকেই এখানে সীমিত আকারে মধু চাষ করা হচ্ছিল। অল্প পুঁজিতে বেশি টাকা আয়ের সন্ধানে এলাকার মানুষ এখন মধু চাষে বেশ আগ্রহ প্রকাশ করছে। তবে বছর দশেক ধরে বাণিজ্যিক ভাবে মধু চাষের ব্যাপকতা বাড়ছে। এখন কমলগঞ্জ উপজেলা পৌর এলাকায়, আলীনগর,ইসলামপুরও আদমপুরের একেকটি বাড়িতে ২টি থেকে ৩০টি পর্যন্ত বাক্স রাখা হয়েছে। সবচেয়ে বেশী রাখা আছে আদমপুর এলাকায়। জানা যায়, গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে চোখে পড়ে ছোট বড় কাঠের বাক্স। বিভিন্ন রকমের নকশা করা ছোট ছোট ছিদ্রওলা কাঠের বাক্স টিনের চাল, বারান্দা, কার্নিশসহ যত্র-তত্র ফেলে রাখা হয়েছে। গুনগুন শব্দ তুলে বাক্সের ছোট ছোট ছিদ্র দিয়ে আসা-যাওয়া করছে মৌমাছি। ফুলে ফুলে ঘুরে সংগ্রহ করা মধু তারা জমা রাখছে ঐসব কাঠের বাক্সে। বিন্দু বিন্দু করে জমা হওয়া মধু মিলে যখন ভরে উঠছে বাক্স, সেগুলো বিক্রি করে বাড়তি টাকা পকেটে তুলছেন বাড়িওয়ালারা। কিভাবে এই মধু চাষে উৎসাহিত হলেন তা জানতে চাইলে কয়েকজন স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, আদমপুর এলাকার পাশেই পড়েছে ঘন জঙ্গলে ভরা রাজকান্দি বনাঞ্চল। বিস্তৃত এই বনের গাছে গাছে মধুর চাক তৈরি করে মৌমাছি। পেশাদার মধুশিকারীরা সেখান থেকে মধু সংগ্রহ করে হাট-বাজারে বিক্রি করেন। খাঁটি এই মধুর খোঁজে এলাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আদমপুরে ছুটে আসেন ক্রেতারা। তবে প্রাকৃতিক মধু দিয়ে সবার চাহিদা মেটানো যায় না। তাই এলাকায় দু-চারটা কাঠের বাক্স বানিয়ে মৌমাছির কলোনি সৃষ্টি করে মধুর চাষ শুরু হয়। লাভজনক হওয়ায় ১০-১২বছর ধরে এই মধু চাষ বাণিজ্যিকভাবে এলাকার ঘরে ঘরে সম্প্রসারিত হয়েছে। প্রায় বাড়িতেই আছে এক-দুটি বাক্স। মধুচাষিরা জানান, রাজকান্দি পাহাড়ের কাছে কাঁঠালকান্দি গ্রামে বেশ কয়েকজন মধু মধুশিকারি রয়েছেন। তারা গাছের ঝুলন্ত চাক থেকে মধু সংগ্রহ করেন। তারা পাহাড় থেকে ‘রানি মৌমাছি’ ধরে আনেন। কাঠের বাক্সে কলোনি তৈরি করেন। এরপর সেই রানি মৌমাছিসহ কলোনি বিক্রি করেন। এ বিষয়ে মৌয়াল আজাদ মিয়ার সাথে কথা বললে তিনি জানান, আমরা পাহাড় থেকে ‘রানি মৌমাছি’ এনে কাঠের বাক্সে কলোনি তৈরি করি। তারপর রানি মৌমাছিসহ কলোনি বিক্রি করি। এতে করে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে মধু চাষ। এখন আরও অনেকেই এই কাজে যুক্ত হয়েছেন। কলোনি থেকে মধু চাষের প্রক্রিয়া সর্ম্পকে জানতে চাইলে মধুচাষি সুমন দাশ জানান, কলোনিতে থাকা একটি রানি মৌমাছিকে ঘিরে শ্রমিক মৌমাছিরা চাক বোনা শুরু করে। এরপর শুরু হয় মধু সংগ্রহ। রানি মৌমাছি না থাকলে মৌমাছিরা সেখানে থাকে না। আবার একটি চাক বা কলোনিতে একটিই রানি মৌমাছি থাকে। একাধিক রানি মৌমাছি হলে ঝগড়াঝাঁটি শুরু হয়। যা বুঝতে পারেন চাষিরা। তখন রানিদের আলাদা করে না দিলে একজন দলবল নিয়ে আশপাশের গাছের ডালে গিয়ে আশ্রয় নেয়। দিনে দিনে কলোনিটি মৌমাছিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে। মধুতে ভরে ওঠে কলোনি। একটা কলোনিতে পাঁচ থেকে সাত হাজার মৌমাছি থাকে। এই মৌমাছির একটি নাম আছে, দাসকুলি। এই দাসকুলি জাতের মৌমাছিরই শুধু চাষ করা যায়। এ ছাড়া রাজমধু, মাছি মধু, ঘামি মধু ও মধুমালতী জাতের মৌমাছিরা প্রকৃতিকভাবে বনে-জঙ্গলে মৌচাকে মধু জমায়। একটি বাক্স থেকে বছরে কম করে হলেও তিনবার মধু সংগ্রহ করা যায়। বছরে যার পরিমাণ প্রায় ১০-১৫ কেজি। প্রতি কেজি মধু এক হাজার টাকা করে বিক্রি করে আয় হয় দশ-বারো হাজার টাকা। যাদের আট-দশটা কলোনি আছে, তারা বছরে বাড়তি কোনো পরিশ্রম ছাড়াই লাখ টাকা আয় করেন। একটি কাঠের তৈরি বাক্স বা কলোনি বানাতে খরচ পড়ে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। যাঁদের কাছ থেকে এই বাক্স কেনা হবে, তাঁরাই রানি মৌমাছিসহ কলোনিটি সাজিয়ে দেবেন। শুধু জায়গামতো বাক্সটি রেখে দিয়ে মাঝেমধ্যে পরিচর্যা এবং মধুতে ভরে উঠলে সংগ্রহ করতে হয়। খবর নিয়ে জানা যায়, আদমপুর ইউনিয়নের মধ্যভাগ, উত্তরভাগ, বনগাঁও, কোনাগাঁও, নোয়াগাঁও, আধকানি, জালালপুর, নইনারপাড় এবং ইসলামপুর ইউনিয়নের কাঁঠালকান্দি, ছয়ঘরি, নোয়াগাঁও, রাজকান্দি, কানাইদেশি ও কলোনি এলাকায় প্রায় ৪শ মধুচাষি আছেন। সারা বছরে এই এলাকায় এখন প্রায় কোটি টাকার মধু উৎপাদন ও বিক্রি হচ্ছে। কমলগঞ্জ ক্ষুদ্র কুটির শিল্পোদ্যোক্তা উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ও উপজেলা মধুচাষি উদ্যোক্তা উন্নয়ন পরিষদের উপদেষ্টা লেখক আহমদ সিরাজ বলেন, ‘এই এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে মধু চাষ হতো। এখন অনেক ব্যাপকতা পেয়েছে। চার শতাধিক মধুচাষি। এটি এলাকায় ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন উৎপাদিত মধু প্রক্রিয়াজাত করার একটি উদ্যোগ নেওয়া দরকার।’ বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) থেকে এলাকার ১০ জন মধুচাষিকে প্রশিক্ষণ ও ঋণ দেওয়া হয়েছে। আরও প্রশিক্ষণ ও সরকারি আর্থিক সহযোগিতা দরকার। আদমপুর ও ইসলামপুর এই অঞ্চলে মধু চাষের জন্য একটি প্রাকৃতিক অনুকূল পরিবেশ আছে বলে চাষিরা মনে করেন। বিসিক শিল্প নগরী মৌলভীবাজারের উপব্যবস্থাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা আদমপুর এলাকার মধুচাষিদের কিছু প্রশিক্ষণ ও ঋণ দিয়েছি। ভবিষ্যতেও এই কার্যক্রম চলবে।’
কমলগঞ্জে বাণিজ্যিকভাবে মধু চাষের ব্যাপকতা বাড়ছে
