কমলগঞ্জ প্রতিনিধি:
“দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ” বৃহত্তর সিলেটের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্যতম বিশ্বনন্দিত সাংস্কৃতিক ধারক মণিপুরী সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব “রাসলীলা” আজ ২৩ নভেম্বর। কার্তিকের পূর্ণিমা তিথিতে তুমুল হৈ চৈ আনন্দ উল্লাস, বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা, ঢাকঢোল, খোল-করতাল আর শঙ্খধ্বনির মধ্য দিয়ে মৌলভীবাজারের সীমান্তবর্তী কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরে মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধানতম ধর্মীয় উৎসব মহারাসলীলা শুরু হতে যাচ্ছে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে অনুষ্ঠানের শুরু হবে। এ বছর মাধবপুর জোড়ামান্ডবে ১৭৬ তম রাসোৎসব এবং আদমপুর সানাঠাকুর মন্ডবে ৩৪ তম রাসোৎসব অনুষ্টিত হবে।
এ উৎসবকে কেন্দ্র করে মণিপুরীদের মাঝে বিরাজ করছে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা। উৎসব উপলক্ষ্যে উভয় স্থানে বসবে বিরাট মেলা। নেয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মনিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও মেতে উঠেছে। মহারাত্রির আনন্দের পরশ পেতে আসা হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দেশী-বিদেশী পর্যটক, বরেণ্য জ্ঞাণী-গুণী লোকজনসহ প্রশাসনিক উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠবে মনিপুরী পল্লী। রাসোৎসবের জন্য তৈরী সাদা কাগজের নকশায় সজ্জিত মন্ডপগুলো একটি রাত্রির জন্য হয়ে উঠে মানুষের মিলনতীর্থ। মনিপুরী শিশু নৃত্যশিল্পীদের সুনিপুন নৃত্যাভিনয় রাতভর মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের। রাত ভর চাঁদের আলোয় মায়াবী জোৎনায় নূপুরের সিঞ্চনে মুদ্রা তুলবে সুবর্ণ কঙ্কন পরিহীতা রাধা ও গোপিনী রূপের মণিপুরী তরুনীরা। সুরের আবেশে মাতাল হয়ে উঠবে কমলগঞ্জের প্রকৃতি ও মানুষ। দিন দিন রাসোৎসবের আকর্ষণ বাড়ছে, সেই সঙ্গে পালা দিয়ে বাড়ছে উৎসবে দর্শনার্থীর সমাগম। তুমুল হৈচৈ, আনন্দ উৎসাহ ঢাক-ঢোল, খোল-করতাল আর শঙ্খ ধ্বনীর মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্মের অবতার পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ ও তার সখি রাধার লীলাকে ঘিরে এই এক দিন বছরের আর সব দিন থেকে ভিন্ন আমেজ নিয়ে আসে কমলগঞ্জবাসীর জন জীবনে।
রাসলীলা দুই ভাগে বিভক্ত :
গোষ্ঠলীলা ও রাসলীলা। গোষ্ঠলীলায় কৃষ্ণের বাল্যকালে মাঠে মাঠে বাঁশি বাজিয়ে ধেনু চড়াবার মুহূর্তগুলো অনুকরণ করা হয়। গোষ্ঠলীলাকে ‘রাখালনৃত্য’ বা ‘রাখোয়াল’ বলা হয়ে থাকে। রাসলীলায় অভিনীত হয় ‘গোপীনৃত্য’। গোপীদের নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের লীলাখেলাকেই এই পর্বে অভিনয় করে দেখানো হয়। রাসলীলাকে ‘পূর্ণিমারাস’ও বলা হয়ে থাকে। স্থানীয়ভাবে এখানে বেলা সাড়ে ১১টায় একযোগে ৩টি গোষ্ঠলীলা অনুষ্ঠিত হয়। রাত ১১টায় থেকে শুরু হয় জোড়ামন্ডপের ৩ টি রাস।
মহারাসলীলানুকরণ জোড়ামন্ডপের বাইরের মাঠে কলাগাছে সুসজ্জিত ৩ টি মঞ্চে ৩ টি গোষ্ঠলীলা অনুষ্ঠিত হয়। বালকেরা রাখাল সেজে নৃত্য ভঙিমায় শ্রীকৃষ্ণের বাল্যজীবনের বহু ঘটনাই এই নৃত্যানুষ্ঠানে ফুটিয়ে তোলে। গোষ্ঠলীলায় অংশগ্রহণকারী বালক রাখালদের মাথায় বেশভূষা থাকে অপূর্ব সুন্দর। মাথায় কারুখচিত ময়ূরপুচ্ছে সুশোভিত কৃষ্ণচূড়া, হাতে কারুকার্য্যময় বাঁশি থাকে। রাসলীলায় পোশাক থাকে শ্রীকৃষ্ণের মতোই। খোল-মৃদঙ্গের তাল আর রাখাল বালকদের ললিত নৃত্যে সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে ভরা দুপুরের টকটকে সূর্য। রাসলীলায় ৩ টি মন্ডপ তৈরি করা হয়, বাঁশ এবং বিভিন্ন রঙের কাটা কাগজের নকশা দিয়ে। এই নকশাখচিত মন্ডপে যুবতী গোপীনীদের নৃত্যে প্রাণময় হয়ে ওঠে সারা রাত। ভক্ত-পুণ্যার্থীরা গোষ্ঠলীলা ও রাসলীলা দেখে আবেগে আপুত হয়ে বাতাসা, টাকা-পয়সা ‘পুষ্পবৃষ্টি’ বা হরিলুট করতে থাকেন নৃত্যরত রাখাল ও শ্রীকৃষ্ণ-শ্রীরাধা এবং গোপিনীদের ওপর।
মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ বলেন, ‘আমাদের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ। এখন পুরো এলাকায় উৎসবের আমেজ। আদমপুর মহারাস উদ্যাপন কমিটির নেতা ইবুংহাল সিংহ শ্যামল বলেন, ‘আমাদের সকল আয়োজন এখন শেষ । উৎসব সুন্দরভাবেই সম্পন্ন হবে।’
যে ভাবে যাওয়া যাবে :
এই মহারাসলীলাকে কেন্দ্র করে গোটা কমলগঞ্জ উপজেলা উৎসবে পরিনত হয়। বিভিন্ন শ্রেণী ও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রায় অর্ধ-লক্ষাধিক মানুষ সমবেত হন। তাদের পদচারণায় দিনরাত অপূর্ব এক মিলনমেলায় পরিণত হয় মাধবপুরের জোড়ামন্ডপ প্রাঙ্গণ এবং গোটা শিববাজার এলাকা। কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়ামন্ডপে যেতে হলে কমলগঞ্জ সদর থানার সম্মুখ থেকে ভানুগাছ/পাত্রখোলা সড়ক ধরে ৩/৪ কিলোমিটার অগ্রসর হলেই হাতের বামে দেখা যাবে ললিতকলা একাডেমী। একাডেমীর পাশেই শিববাজার নামে একটি বাজার রয়েছে। রাসলীলার ভক্ত পুণ্যার্থীদের সাথে একটু সামনে গেলেই দেখতে পাবেন পর পর ৩টি মন্ডপ। ৩ টি মন্ডপের নামই জোড়ামন্ডপ। রাসলীলা দেখে মাধবপুর চা বাগানে যেতে পারেন। মাত্র দু কিলোমিটার পথ এবং চা বাগানের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া এক সুদীর্ঘ লেকও দেখতে পারেন।