হোসাইন আহমদঃ
মৌলভীবাজার জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বর্ষিয়ান রাজনীতিবীদ, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ও স্বাধীনতা পদকে মনোনীত আলহাজ্ব আজিজুর রহমান করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ আগষ্ট রাত আড়াইটার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে মৌলভীবাজারে শোকের ছায়া বিরাজ করছে। দলমত নির্বিশেষে সবাই শোকাহত। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচরের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, রাষ্ট্রপ্রতি আব্দুল হামিদ ও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন প্রমুখ।
এই মহান মানবের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নানা দিক পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
জন্ম ও শিক্ষা জীবনঃ
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের গুজারাই গ্রামে মরহুম আব্দুস সত্তার এর ঘর আলোকিত করে ১৯৪৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন মরহুম আজিজুর রহমান। মৌলভীবাজার শ্রীনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক, মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও হবিগঞ্জের বৃন্দাবন সরকারি কলেজ থেকে বিকম পাস করেন।
রাজনৈতিক জীবন:
১৯৭০ সালের নির্বাচনে গনপরিষদ সংসদ সদস্য, ১৯৭২ সালে সংবিধানে স্বাক্ষরকারী গণ পরিষদ সদস্য, ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য, ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য ও বিরোধী দলীয় হুইপ এবং সংসদীয় সেচ, বন্যা ও পানি সম্পদ কমিটির সদস্য ছিলেন। এসময় তিনি সংবিধানের একাদশ এবং দ্বাদশ সংশোধনীতে হুইপ হিসেবে বিশেষ অবদান রাখেন। ১৯৯১ সালে কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য ও ১৯৯৬ সালে যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখন যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী এবং চীন ও হংকং একত্রীকরনের সময় চীন সরকারের আমন্ত্রণে বেইজং যান। মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামীলীগের ২ বারের সভাপতি ও ২ বারের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৪ দলের মৌলভীবাজার জেলা সমন্বয়ক ছিলেন এবং মৌলভীবাজার থেকে ঢাকা অভিমুখে লং মার্চ কর্মসূচিতে নেতৃত্ব প্রদান করেন।
সামাজিক কার্যক্রমঃ
মৌলভীবাজার সরকারি মহিলা কলেজ এবং সৈয়দ শাহ মোস্তফা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মৌলভীবাজার কাশীনাথ আলাউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ এবং রাজনগর ডিগ্রী কলেজের সাবেক সভাপতি ছিলেন। ১৯৯১ সালে প্রলয়ংকারী ঘুর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত বৃহত্তর চট্রগ্রামে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ১২ সদস্য বিশিষ্ট সংসদীয় ত্রাণ দলে সক্রিয় ভূমিকা রেখে সংসদে গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি দেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের যে কোন অপচেষ্টার বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেন। সাংস্কৃতিক সংগঠক, আন্দোলন এবং জনসেবায় সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।
প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বঃ
২০১১ সালের ২০ ডিসেম্বর হতে ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের প্রশাসক এবং ২০১৭ সালের ২৬ জানুয়ারী হতে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত জেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পদাধিকার বলে ২০১৭ সালের ২৬ জানুয়ারী হতে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মৌলভীবাজার রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি’র চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ পাক আর্মি কর্তৃক গ্রেফতারের পর অমানুষিক শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করা হয়। ৭ এপ্রিল মুক্তিবাহিনী কর্তৃক জেল ভেঁঙ্গে সিলেট কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ২ মে মৌলভীবাজার পাক আর্মি কর্তৃক পুনদখলের পর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলাশহরে ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও মোজাহিদদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। একই সাথে বিভিন্ন শরনার্থী ক্যাম্প ও দেশের ভিতর থেকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য রিক্রুট করে প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে মুজিব নগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক আহুত পশ্চিম বঙ্গের বাগডুগা (দার্জিলিং) তে প্রথম পার্লামেন্ট অধিবেশনে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রবাসী সরকার কিছু সংখ্যক সংসদ সদস্যকে সামরিক প্রশিক্ষণে পাঠান। সিলেট বিভাগ থেকে তিনি একমাত্র সংসদ সদস্য হিসেবে বিশেষ ট্রেনিং গ্রহণ করেন এবং সাথে সাথে ৪নং সেক্টরে রাজনৈতিক সমন্বয়কারী এবং কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন অপারেশনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। ০২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় পাক বাহিনীর উপর আক্রমণ ও শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ০৩ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ক্রমান্বয়ে একটার পর একটা আক্রমনের ধারাবাহিকতায় ০৬ ও ০৭ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারে সাড়াশি আক্রমণ করে তার নেতৃত্বে পাক বাহিনীর ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার দখল করা হয় এবং ০৮ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে মৌলভীবাজারকে হানাদারমুক্ত ঘোষণা করেন। এ বিষয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ”বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র” পঞ্চদশ খন্ডে গণপরিষদ সদস্য (সাবেক এম.পি.এ) মোহাম্মদ আজিজুর রহমানের লিখা মুক্তিযুদ্ধের কিছু কথা প্রকাশিত হয়েছে।
বর্তমান পেশিশক্তি নির্ভর রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার এক অনুকরনীয় নাম আজিজুর রহমান। তিনি সততা, অসাম্প্রদায়িকতা ও অহিংস রাজনীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মৌলভীবাজার জেলায়। পাশাপাশি তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থেকেও দেশ ও সাধারণ গরীব দু:খী মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য সবসময় কাজ করে গেছেন। এতসব গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার পরও কোন অহংকার ছিলনা। ছিলনা তার ব্যক্তিগত ষ্টাফ ও গানম্যান। সরকারি সুযোগ সুবিধেও কখনও ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেননি। এছাড়াও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি সরকারি কাজ ছাড়া সরকারি গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন না। তিনি ছিলেন প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক অহিংস রাজনীতিবিদ ও সাংস্কৃতিক মনা একজন মানুষ।