-শ্রদ্ধাঞ্জলী-
মোঃ আবু তাহের
যা কিছু মোর সঞ্চিত ধন/এত দিনের সব আয়োজন। চরম দিনে সাজিয়ে দিব উহারে-মরণ যে দিন আসবে আমার দুয়ারে। রবীন্দ্রনাথের এই পংত্তিমালাকে সত্যে পরিণত করে সোমবার ১৭ আগষ্ট ২০২০ রাত আড়াইটায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাষ ত্যাগ করেছেন বীরমুক্তিযোদ্ধা, বর্ষীয়ান রাজনীতিবীদ বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর, স্বাধীনতা পদকে মনোনীত, মৌলভীবাজার জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান। তাঁর মৃত্যুতে দলমত নির্বিশেষে মৌলভীবাজারে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এ বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতা মরণকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেননি। বর্ণাঢ্য জীবন সাজিয়ে তা মরণের হাতে তুলে দিয়েছেন। গত ৫ আগষ্ট বিকালে বর্ষীয়ান এ রাজনৈতিক নেতার শরীরে করোনা পজেটিভ ধরা পড়ে। আজিজুর রহমান ছিলেন সাবেক গণপরিষদ সদস্য, সাবেক দুই বারের সংসদ সদস্য, সাবেক বিরোধী দলীয় হুইফ, বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম স্বাক্ষরদানকারী, কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের সাবেক যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক, মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। সর্বশেষ মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি মৌলভীবাজার ইউনিটের দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় তিনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন।
আজিজুর রহমান ১৯৪৩ সালে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের গুজারাই গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক, ১৯৬২ সালে মৌলভীবাজার কলেজ থেকে আইকম এবং পরবর্তীতে হবিগঞ্জের বৃন্দাবন কলেজ থেকে বি-কম পাশ করেন। তিনি একাধিক বার বর্বর পাকবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন এবং পাক হানাদারদের হাতে নির্যাতনের শিকার হন। দীর্ঘ প্রায় ৭৭ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনে মৌলভীবাজারের স্থানীয় রাজনীতিতে নিজেকে অপরিহার্য করে তুলে ছিলেন আজিজুর রহমান। জাতীয় রাজনীতিতে তিনি গতিশীল অবদান রেখে মৌলভীবাজারবাসীর মুখ উজ্জ্বল করেছেন। মৌলভীবাজার সহ বৃহত্তর সিলেটে অসংখ্য গুণগ্রাহী শুভাকাংখী ও সমর্থক রেখে গেছেন আজিজুর রহমান। তাঁর মৃত্যুতে পরিবারের পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ও বৃহত্তর সিলেটের মানুষের মাঝে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্ধিতা থাকলেও ব্যক্তিগত জীবনে বীর মুুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান শত্রুতার মুখামোখি ছিলেন না। একজন রাজনীতিবীদের এমন অর্জন অনেক গৌরবের অনেক সম্মানের ও অনেক ব্যতিক্রমধর্মী। আজিজুর রহমান তাঁর গনতান্ত্রিক চেতনা ও ভালোবাসা দিয়ে মৌলভীবাজারবাসীকে করেছেন সমৃদ্ধ। মৌলভীবাজারের মানুষ দীর্ঘকাল তার অভাববোধ করবে বলে আমি মনে করি। সমাজে এমন কিছু মানুষ জন্ম গ্রহণ করেন তাদের কাজ ও চিন্তার বহুমুখিতা অনুকরনীয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমানের ¯েœহ ও ভালোবাসা জ্ঞান ও দক্ষতা ছিল সূর্যের মতো। যা সব খানেই পড়ে। তার চরিত্রের প্রধান দিক হচ্ছে আজীবন তিনি ছিলেন হিংসা বিদ্বেষ মুক্ত। তিনি মানুষকে ভালো বাসতেন। মানুষকে সম্মান করতেন, ¯েœহ করতেন। গণমানুষের রাজনীতি করতেন। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক ভালো মানুষ। সামাজিক সংগঠনের অনেক সমাবেশে তিনি প্রধান অতিথি থাকতেন, আমিও তার সাথে অনেক সমাবেশে অংশ গ্রহণ করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে গর্বিত মনে করছি। ২০১৭ সাল, আমি তখন ব্যাংক অফিসার্স এসোসিয়েশন মৌলভীবাজারের নির্বাচিত সভাপতি। মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ বন্যা কবলিত। আজিজ ভাই জেলা ব্যাপি ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেছেন। জেলা পরিষদের সাথে ত্রাণ কার্যক্রমে আমাদেরকে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানালেন। সকল ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ও কর্মকর্তাগন আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে ত্রাণ কার্যক্রমে যুক্ত হলেন। আজিজ ভাই ছিলেন একজন মানবতাবাদী নেতা। তিনি সবধরনের কল্যাণমূলক কাজে নিজেকে যুক্ত রেখে প্রথম কাতারে থাকতেন। বেশ কিছু সামাজিক সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। শত ব্যস্থতার মাঝে এবং অসুস্থ অবস্থায়ও তিনি সামাজিক সংগঠনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের যোগ দিয়েছেন। তিনি একজন উচু মানের বক্তা ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযোদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার ও সাংবাদিকতা, সংবাদপত্র ইত্যাদি বিষয় নিয়ে জ্ঞানভিত্তিক, অনুপ্রেরণা মূলক ও দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখতেন। তিনি মানুষের দুঃখ দুর্দশা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন। অপরিনত বয়সে চলে গেছেন আজিজুর রহমান একথা হয়তো বলা যাবে না। কিন্তু একটি মহীরূহ তার ছায়া দেওয়া বন্ধ করে চিরতরে হারিয়ে গেলে শূন্যতা বড় হয়ে দেখা দেয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান ছিলেন ছায়া দিয়ে যাওয়া এক মহীরূহ। তার কর্ম ও সৃজনশীলতা অসংখ্য রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সমাজকর্মী সহ অনেক মানুষের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। আজিজুর রহমান ছিলেন রাজনীতিনীষ্ট খাঁটি মানুষের প্রতিকৃতি। বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান একটি নাম একটি অনন্য ব্যক্তিসত্ত্বার পরিচয়। তিনি ছিলেন একজন একনিষ্ট আদর্শবাদী রাজনীতিবীদদের উজ্জ্বল প্রতিকৃতি। তার ব্যক্তি জীবন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল রাজনীতির গভীরে। জীবনভর তিনি ছিলেন একজন খাটি মানুষ। তিনি শুধু রাজনীতিবীদই নন। তিনি ছিলেন মৌলভীবাজারবাসীর অভিভাবকতুল্য। বিভাজনের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন আস্তার প্রতীক। দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিযাত্রায় অপরাজেয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত অবশেষে পরাজিত হলেন করোনা মহামারির কাছে, পরাজিত হলেন মৃত্যুর কাছে। দেশ বিদেশে অবস্থানরত বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আজিজ ভাইয়ের অসংখ্য গুণের কথা প্রকাশ করেছেন। আজিজ ভাই সম্পর্কে মৌলভীবাজারের সাবেক জেলা প্রশাসক বেগম নাজিয়া শিরিন ফেইসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন “জীবন যেমন সুন্দর, মৃত্যুও মনে হয় সুন্দর”। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়- যখন তুমি এসেছিলে ভবে, কেঁদেছিলে তুমি, হেসেছিল সবে। এমন জীবন তুমি করিও গঠন। মরণে হাসিবে তুমি, কাঁদিবে ভুবন। সত্যিই তিনি মানুষকে কাঁদিয়েছেন। তাঁর জানাযার নামাজে অনেক মানুষ অংশ গ্রহণ করেছেন, করোনা মহামারিও মানুষকে আটকাতে পারেনি। মহান আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন-যিনি মৃত্যু ও জন্ম সৃষ্টি করেছেন, যাতে করে এর দ্বারা তিনি তোমাদের যাছাই করে নিতে পারেন, কর্মক্ষেত্রে কে তোমাদের মধ্যে বেশি ভালো (সূরা আল-মুলক, আয়াত-২)। বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান তার কর্ম ও সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমেই মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন দীর্ঘকাল। তিনি পবিত্র হজব্রত পালন করেছেন। সকল মৃত্যুই আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা সকলই একই পথের পথিক। আমাদের সকলকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। হিংসা বিদ্বেষ মুক্ত একটা যাপিত জীবন সকলেরই কাম্য হওয়া উচিত। এ পৃথিবী খুবই ক্ষণস্থায়ী, মৃত্যু আমাদের চারপাশে ঘুরছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনা মহামারি জীবন ও মৃত্যুকে দাঁড় করিয়েছে পাশাপাশি। করোনা পৃথিবীর স্বাভাবিকতাকে হারিয়ে দিয়েছে। হুমায়ূন আহমদ মানুষের ক্ষণস্থায়ী জীবন নিয়ে একবার বলেছিলেন সামান্য একটা খচ্ছপের আয়ু সাড়ে তিনশ বছর। মানুষ কে কখন মরে যায় কেউ কিছু জানে না। প্রতিটি জন্মের পর মৃত্যু ও যে অনিবার্য সে বাস্তবতা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তবু কিছু মৃত্যু মানুষকে শোকাহত করে অনেক বেশি। বীর মুক্তিযোদ্ধ আজিজুর রহমান নিজের দল ও দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা এখন খুব বেশি দেখা যায় না। পরম করুনাময় আল্লাহ তায়ালার কাছে তার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
লেখকঃ কলামিষ্ট, ব্যাংকার ও গবেষক।