সরওয়ার আহমদ: সাদামাটা কথাও যে অনেক সময় গবেষণার চর্বিত চর্বনের চাইতে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে সেটি বাস্তবতার আলোকে বুঝে নেয়া যায় সহজে। কথা প্রসঙ্গে এক প্রবাসী বলেছিলেন- প্রবাসে উপার্জন মানে কাকড়া কিংবা কুচিয়ার গর্তে হাত ঢুকিয়ে মাছ ধরার মতো। এ প্রক্রিয়ায় মাছ মিলে, ঝাঁপি ভরে না। বরং প্রবাসের চাইতে এই বাংলা ভূখন্ড ব্যতিক্রমী। এখানে ভাগ্য বদলের সিঁড়ির সন্ধানে মিললে রাতারাতি সিঁড়িবেয়ে মার্গে আরোহন কোন বিষয়ই নয়। যারা চালাক বা চক্ষুষ্মান এবং পথ সন্ধানে দক্ষ তাদের কপালে ‘চান্দরাইত’ এসে সব কিছুকে উজালা করেদেয়। যারা আহাম্মক, বেকুব এবং চোখ থাকতে অন্ধ তাদের কপালে অমানিশার দশক বা শতক নিরন্তন লেগেই থাকে। এই মুল্লুকে শেষোক্ত পক্ষেরই সংখ্যাধিক্য বেশী এবং কলুর বলদের গোল চককরে ঘোরাই হচ্ছে তাদের নিয়তি। এদেশের ভাগ্যন্বেষীদের রাতারাতি ভাগ্যবদল হয়েছে কিভাবে এবং কোন পদ্ধতিতে ও কোন খাতে সে হিসাব কষতে অভিসন্দর্ভ রচনার প্রয়োজন। তবে আলাদীনের প্রদীপ যে ঘাটে ঘাটে জ্বলছে এবং সেই প্রদীপের ছোয়ায় হাজার হাজার নায়কের অধিষ্ঠান যে ঘটছে তাহা অনুমান করা যায় সহজে। ১৯৭৫ সনে গোটা দেশে ব্যাংক আমানতকারী কোটিপতির সংখ্যা ছিলো ৪৭ জন। ২০২১ সনে সে সংখ্যা উন্নীত হয়েছে ৯৯ হাজার ৯১৮ জনে। ৪৬ বছরে সংখ্যানুপাতিক এমন উল্লম্ফল বিশ্বের কয়টি দেশে হয়েছে! দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার না হলে উল্লেখিত পরিসংখ্যানের আরও উর্দ্ধবিকাশ ঘটতো নিঃসন্দেহে। জনশ্রæতি আছে- গত দুবছরে শুধু পিঁয়াজের তেজারতি মাধ্যমে পাঁচ শতাধিক নব্য কোটিপতির উত্থান ঘটেছে। সেলুকাস- কি বিচিত্র এই দেশ কথাটি কি এমনি এমনি গুরুত্ব পেয়েছে। কোটিপতিদের উত্থানে আপত্তি নেই। কিন্তু সে উত্থান যদি দেশের আম পাবলিকের পকেট কেটে ও তাদের ভাগ্যনিয়ে ছিনিমিনি খেলে হয়ে থাকে তাহলে আফসোস আছে বৈকি। কবি কন্ঠে বহু আগেই উচ্চারিত হয়েছে- রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি। রাজ রাজুড়ার রাজত্বের অবসান হয়েছে বহু আগেই। কিন্তু তাদের প্রেতাত্মার উত্থান ঘটেছে নতুনরূপে নতুন আঙ্গিকে। সেই একই স্বভাব নিয়ে তারা জনগণের মাথায় কাঠাল ভেঙ্গে খাচ্ছে এবং পকেট কেটে নিয়ে নিজেদের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে নানান কৌশলে। শ্রেণি চিহ্নিত করা গেলে এই লুটেরা শ্রেণি বগুভাগে বিভক্ত হলেও মূল চরিত্র অভিন্ন এবং একে অন্যের পরিপূরক। তার বিশ্লেষণে যাচ্ছিনা। প্রসঙ্গ এসেছে পিঁয়াজ সিÐিকেটের নব্য কোটিপতিদেরকে নিয়ে। তারা ব্যবসায়ী এবং সামাজিক ভাবে প্রভাবশালী। আমাদের মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এক সময় ব্যবসা বা তেজারতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ব্যবসা কিংবা তেজারতিকে একপ্রকার ইবাদতের মতো গণ্য করতেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন ব্যবসায়ী বলতে মুনাফাবাজ হিসেবেই গন্য এবং স্বীকৃত। এই মুনাফাবাজী যখন চরম আকার ধারন করে, তখন সেটি গণ্য হয় লুটেরাপণায়। এই মুনাফাবাজী ও লুটেরাপণার নগ্ন নৃত্যে ভোক্তামহল প্রত্যক্ষ করেছে পিঁয়াজ ক্রাইসিসের সময়। আমদানী নির্ভর এ পণ্যের রফতানির উপর যখন ভারতের নিষেধাজ্ঞার খবর চাউর হলো, তখনও দেশে কয়েক হাজার টন পিয়াজ মজুদ ছিলো। কিন্তু পিঁয়াজ সিÐিকেট এই মজুদকে লাপাত্তা করে কৃত্রিম সংকট তৈরীতে মেতে উঠে। ফলে ২৫ টাকা কেজি দরের পিঁয়াজ লাফিয়ে লাফিয়ে দু’শ টাকাতে উন্নীত হলো। মুনাফার ক্ষেত্রে সেঞ্চুরীর পরিবর্তে ডাবল সেঞ্চুরিতে পৌঁছালো পিয়াজ। এমতাবস্থায় শুধু পিয়াজ তেজরতি দিয়ে কোটিপতির কোঠায় পৌছানো কোন অসম্ভব ব্যাপার নয়। গোদামজাত পিয়াজ পচে গলে নষ্ট হয়েছে। তবু ক্রাইসিসের বাজার ধরে রাখতে সিÐিকেট ব্যবসায়ীরা ছিলো বেপরোয়া।
পিঁয়াজ ক্রাইসিসের সময় বোধকরি একটি এক্সপেরিমেন্টও সম্পন্ন হয়েছে ব্যবসায়ী মহলের তরফে। ২৫ টাকা কেজি দরের পিঁয়াজ যদি ভোক্তামহল দু’শ টাকা দিয়ে কিনতে পারে তাহলে অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়লেও তারা ক্রয় করতে সক্ষম। এই ধারনা থেকেই তেল, চিনি, আটা, ময়দা থেকে আরম্ভ করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি শুরু করা হয়। তা থেকে রেহাই পায়নি তরিতরকারিও। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা একাট্টা। ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দিতা থাকলেও মুনাফার ক্ষেত্রে তারা পরস্পর সহযোগী এবং নাছোড় বান্দা। এমতাবস্থায় অসংগঠিত ভোক্তামহল যাবে কই? তারাতো সিÐিকেট গঠন করতে পারবেনা। সুতরাং প্রয়োজনের তাড়নায় এঘর নাহয় অন্য ঘর থেকে মালামাল কিনতেই হবে। এমন যদি হতো- দেশের সব ভোক্তামহল সংঘবদ্ধ হয়ে একবাক্যে দুসপ্তাহ পন্য বর্জন করে কষ্টে-সৃষ্টে দিনাতিপাত করতো তাহলে মুনাফালোভী ব্যবসায়ী সিÐিকেট তাসের ঘরের মতো উড়ে যেতো। কিন্তু কিভাবে তারা সংগঠিত হবে? কে তাদেরকে নেতৃত্ব দেবে? এই উদ্যোগ সম্ভব না হওয়াতে পকেটের টাকা অবলীলায় পাংচার হচ্ছে। এক দিক ঢাকতে গিয়ে গ্রাহকের অন্যদিক উদোম হচ্ছে। জীবন হয়ে উঠছে দুঃসহ। একদিকে ভোক্তা মহলের নীরব হাপিত্যেস, অন্যদিকে মুনাফাবাজদের মুখে মুনাফার সতৃপ্ত হাসি নিয়েই আবর্তিত হচ্ছে বাজারের দিনলিপি। ব্যবসায়ী এবং বাজারের এই চরিত্র নতুন নয়। স্বাধীনতা উত্তরকালে বাজারের কৃত্রিম সঙ্কট ও মুনাফাবাজী চরম আকার ধারণ করেছিলো। লব্ধ স্বাধীনতার আমেজকে ¤øান করে ফেলেছিলো বাজারিদৌরাতœ্য। এ অবস্থা মোকাবেলার জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার ন্যায্য মূল্যে পণ্য বিপণণের লক্ষ্যে স্থানে স্থানে ভোগ্যপন সংস্থা ‘কসকর’ চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু সিষ্টেমটি চালু হতে না হতেই এক শ্রেনীর মিডিয়া এবং স্বার্থন্বেষী বৃদ্ধিজীবিরা গেলো গেলো আওয়াজ তুলেছিলো। সকল অনিষ্টের মূল হিসেবে কসকরকে দায়ী করে শুরু হলো অপপ্রচারণা। অতঃপর ৭৫ সনের পট পরিবর্তনের সাথে সাথেই কসকরকে বিলুপ্ত করা হয়েছিলো। তারপরও বাজারের ভারসাম্য রাখার জন্য অবশিষ্ট ছিলো সরকার নিয়ন্ত্রিত রেশন সপ। মুক্তবাজার তত্বের তাত্তি¡কদের চাপে সামরিক সরকার এই রেশনিং সিষ্টেমকে আশির দশকে উঠিয়ে দিয়ে বাজার এবং ভোক্তামহলকে মুক্তবাজারীদের হাতে সোপর্দ করে দিয়ে ছিলো। মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল দর্শন হচ্ছে মুনাফার অবাধ কর্তৃত্ব। দুমুর্খদের ভাষায় যাকে বলে- কলা ছুলাইয়া দে, ইচ্ছামত গিলি। এহেন প্রেক্ষাপটে মুনাফার দাবানলে ভোক্তামহলকে আহুতি হওয়া ছাড়া অন্য কোন পথ নাই। সার্বিক উন্নয়নের সুবাদে প্রান্তিক জনগোষ্টির পকেটে যা কিছু সঞ্চিত হয় তা লুটে নিচ্ছে মুনাফাবাজরা। মাথাতুলে দাড়াবার পথ তাই রুদ্ধ। বাজারি এই লুটেরাপনা নিয়স্ত্রণে সরকারি প্রশাসন ব্যর্থ। শহরের বিভিন্ন বাজারে মাকেটিং অফিসার কালোভদ্রে ঢুঁ মারলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। অন্যদিকে গ্রামীণ হাট বাজার থাকে তদারকীর বাইরে। বাজারের এই নৈরাজ্যকে আংশিক নিয়স্ত্রণের একমাত্র পথ হচ্ছে টি.সি.বির অবকাঠামো সংহত করণ এবং বিপনন ব্যবস্থাকে সম্প্রসারিত করণ। বর্তমানে যে বিপনন ব্যবস্থা বিদ্যমান তাতে প্রতীয়মান হয় যে, টি,সি,বির উপরে বাজারি চক্রের পরোক্ষ নিয়স্ত্রণ রয়েছে। জেলা সদরের চিহ্নিত পয়েন্টে সপ্তাহে দু তিন দিন এবং উপজেলা শহরে কালেভদ্রে টি,সিবির ট্রাক দেখা যায়। এমতাবস্থায় ভোক্তাদের পাঁচ শতাংশ টি,সি,বির পণ্য পাচ্ছে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। এই সিষ্টেমের আমূল পরিবর্তন করে গ্রাম পর্য্যায়ে টি,সি,বির পন্য বিপনন নিশ্চিত হলে দুর্দশাগ্রস্ত ভোক্তা মহল কিছুটা হলেও স্বস্তি পেতে পারে।