সরওয়ার আহমদঃ কুমিল্লায় দূর্গা পূজামন্ডপের দেবীর পদতলে পবিত্র কোরআনের অবস্থান বা আবিস্কার নিয়ে উড়নচন্ডী ঝড়ের দোলা দেশব্যাপী অনুরণিত হলেও এ ঝড় যতটুকু গতিবেগ সম্পন্ন বা বিধ্বংসী হবার কথা ছিলো, তদ্রæপ হয়নি। কারণ চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে হৈ হল্লার পরিবর্তে নিজদেহে কানের অস্তিত্ব খোঁজে দেখার প্রবণতা সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা এদেশে দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চাঁদে সাঈদীর মুখদেখা গেছে- এমন বার্তাশুনে ভক্ত অনুরাগীরা ঘর থেকে বেরিয়ে চাঁদের উদ্দেশ্যে সালাম ঠুকেছে এমন নজির খুঁজে পাওয়া যায়নী কোথাও। পোড় খাওয়া লব্ধ অভিজ্ঞতা এবং জাগ্রত বিবেকের ব্যারিকেডের মুখে ধর্ম্মীয় উন্মাদনার পরিবর্তে আম জনতা মনে হয় সাম্প্রদায়িক সুঁড়সুঁড়িতে তেমন ভাবে উস্কে উঠবে না। রাজনীতির ক. খ জ্ঞান বিবর্জিত গ্রামীণ এক মহিলা ( যার বসবাস হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায়) কুমিল্লাকান্ডের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন- আশি বছরের বয়সে এমন ঘটনাতো শুনিনি। হিন্দুদের বারোমাসে তেরো পার্বন থাকে। এসমস্থ পার্বন অনুষ্ঠানে নিজেদের আচার-অর্চনা ব্যতীত অন্য ধর্মের প্রতি রা শব্দও তারা করে না। মসজিদে আযান ধ্বনি উঠলে মুসলমান মেয়েদের অনুকরণে হিন্দু মেয়েরাও মাথায় আচল টানে। অপর একজনের মন্তব্য- তারা শুধু দেবতাকেই পূঁজা করে বসে থাকে না, পীর ফকিরের মাজারেও মানত পাঠায়। সুযোগ পেলে নিকটে গিয়ে করজোড়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এমতাবস্থায় পবিত্র কোরআন নিয়ে নিকৃষ্ট খেলা তারা খেলতে পারেনা। তাহলে খেললো কে? নিশ্চয় খেলোয়াড় আবিস্কৃত হবে। তবে এটি যে ধর্মব্যবসায়ী, লুটেরা এবং রাজনৈতিক ভাবে দেউলিয়াদের সম্মিলিত ও পরিকল্পিত খেলা, তাহা ঠাহর করতে অসুবিধা হচ্ছে না। ধর্মকে বর্মের সাজ দিয়ে রাজনৈতিক সামাজিক এবং ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্যের ঘটনা এ দেশে নতুন নয়। ধর্মকে নানান রঙ্গে রাঙ্গিয়ে এবং সাম্প্রদায়িক অনুভূতিতে যুৎসইভাবে সুঁড় সুঁড়ি দিয়ে ১৯৪৭ সনে দেশভাগ নিশ্চিত হলেও লদ্ধ স্বাধীনতার খেসারত দিতে হয়েছিলো অপরিসীম দুর্ভোগ এবং লোক ক্ষয়ের মাধ্যমে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সেসময়ে দশ লক্ষ মানুষ নিহত এক কোটি মানুষ আহত এবং ২ কোটি মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে বিপন্ন হয়েছিলো। তার পরবর্তীতে পাকিস্তানে ও ভারতে পর্য্যায়ক্রমিক ভাবে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং দাঙ্গার সহচর লুটতরাজের ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান যথাযথভাবে উপস্থাপন করলে দেশভাগ কালের ক্ষয়ক্ষতির সমপরিমাণ হবে নির্বিঘেœ।
পাকিস্তানী আমলে পশ্চিমা দরদীরা শুধু ধর্মের দোহাই পেড়ে পূর্ব বাংলাকে কিভাবে শোষণ ও বৈষম্যের নাগপাশে আবদ্ধ করেছিলো সে খতিয়ানতো অমোচনীয় অবস্থায় রয়েছে। ৭১ সনে ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে হানাদার বাহিনী এদেশে কিভাবে মানুষ হত্যা, নারী নির্যাতন ও লুটপাটে মেতে উঠেছিলো সেটি আত্মবিস্মৃতির ঘেরাটোপে তলিয়ে গেলেও ইতিহাস ভূলেনি। ধর্মের ঢোল পিটেয়ে “বিছমিল্লাহ রক্ষা এবং ভারতীয় হিন্দু জুজুর ভয়দেখিয়ে এদেশে নির্বাচনী বৈতরনী পাড়ের নজিরও রয়েছে।
মূলত: ধর্মকে পারলৌকিক জীবনদর্শনের পরিবর্তে ইহলৌকিক বা জাগতিক সুবিধা হাসিলের একটি চারণ ক্ষেত্র তৈরী করা হয়েছে এদেশে। ধর্ম্মীয় অনুভূতি এবং সাম্প্রদায়িক চেতনায় সুঁড়সুঁড়ি দিলেই মোক্ষ লাভ সম্ভব- এমন ধারণা থেকেই তার প্রয়োগ চলছে। তাই ধর্মীয় সংগঠনের পাশাপাশি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান (মতান্তরে দোকান) এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যাকাত এবং লিল্লাহ আদায়ের পাশাপাশি শবেবরাত এবং রমজান মাসে এসমস্থ প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে কতটাকার যোগান আসে এবং কতটাকা খরচ হয় তার যথাযথ অডিট হলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসার কথা। সীমিত মাসোহারার হুজুররা কোন রহস্য বলে বিলাসী জীবন যাপন করেন সেটি অনুসন্ধান করলেই- ধর্মের ঢোল বাতাসে বেজে উঠবে। অন্যদিকে “মিসকিন” এই দেশে ইসলামের খুঁটি “নড়বড়ে” এই বুলি কপচিয়ে খুটিকে শক্ত অবস্থানে প্রেথিত করার জন্য এদেশীয় ধান্দাবাজরা মধ্যপ্রাচীয় শেখদের শরণাপন্ন হন বলে জনশ্রæতি আছে।
তাদের প্রদত্ত এইড (নাকি এইডস) সংগ্রহ করে নিজেদের ভিত মজবুত করে কেহ মার্সিডিজে চড়ে আবার কেহ হেলিকপ্টারে উড়ে ইসলামী জজবা প্রদর্শন করেন। ইদানীং হেলিকপ্টার চড়ে ৫৬ বছর বয়েসী এক হুজুর দ্বিতীয় বিয়েও নাকি করেছেন! অঢেলবিত্তবেশাতের ফলে শান শওকত বৃদ্ধির পাশাপাশি জৈবিক লালসাও বাড়ে। তাই মমিনুল হকরা পরকীয়ায় লিপ্ত হয় নিজেদের স্ত্রীকে পাশকাটিয়ে। এটি আশ্চর্য হওয়ার খবর নয়। মাদ্রাসার শিক্ষকদেরকে হুজুর বলা হয়। শিক্ষার্থীদেরকে এই সন্মোধনে বাধ্য করা হয়েছে। অগ্নিতে পুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়া মাদ্রাসার ছাত্রী নুশরাত জানান দিয়ে গেছে হুজুরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। জোব্বা ও পাগড়ী পরিহিত এ সমস্থ হুজুরদের সংখ্যা কত হতে পারে- অনুসন্ধানে নামলে সেঠিও বেরিয়ে আসবে। চাপা পড়ে আছে আরেকটি উপসর্গ। সেটি হচ্ছে এতিমখানার শিশু কিশোরদের উপর বলাৎকার। এ বলাৎকারের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে। আল্লাহ তায়ালা বলাৎকারীদেরকে কিভাবে ধ্বংস করেছেন তারও বর্ণনা আছে। এত কিছু জানার পরও এতিমদের উপর বলাৎকার চালাচ্ছে কি কোন অশরীরীয় শক্তি? তাদের ভরণপোষণের নামে সংগৃহীত অর্থ কারা লুটে নিচ্ছে? আড়ালে থাকা এ প্রশ্নগুলোর যথাযথ উত্তর খোঁজে নেয়ার সময় এখন এসেছে। কারণ টুনকো ইস্যু তৈরী করে মাদ্রাসার ছাত্র এবং এতিমদেরকে অবস্থা বিবেচনায় হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ্যনীয় হয়ে উঠেছে। ধর্মকে বর্ম বা ঢাল হিসাবে খাড়া করে রাজনৈতিক আর্থিক ও সামাজিক ফায়দা হাসিলের ভূরি ভূরি নজির উপস্থাপন করা যাবে। এই তৎপরতার সাথে সম্পৃক্ত আছেন “রাজনৈতিক নবী” এবং ধর্মের কবিরা। অনন্যোপার হয়ে কিংবা সুবিধা বুঝে আমজনতার একাংশও তাদের অনুগামী হতে বাধ্য হয়। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।
ধর্মের সাথে পবিত্র ধর্ম গ্রন্থের অপব্যবহারেরও নজির আছে। খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলীয় সিফফিন প্রান্তরের যুদ্ধ সম্পর্কে যারা অবহিত আছেন তারা বিষয়টি জানেন। ক্ষমতার দ্বন্দে হযরত আলী (র:) সাথে মোয়াবিয়ার যুদ্ধকালে মোয়াবিয়া পক্ষের পরাজয় যখন অবধারিত হয়ে উঠে, তখন এ পরাজয় ঠেকাতে মারওয়ানের মন্ত্রনায় মোয়ারিয়া পক্ষ বর্শার আগায় কোরআন শরীফ বেঁধে এবং কোরআনের দোহাই দিয়ে যুদ্ধবিরতির আহŸান জানিয়েছিলো। হযরত আলীর যোদ্ধাদের একাংশ এটিকে ভেঁক বা ছলনা গণ্য করে যুদ্ধচালিয়ে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলো। অপর পক্ষ কোরআনের সম্মান রক্ষার্থে যুদ্ধ বিরতির পক্ষে মতামত ব্যক্ত করে। হযরত আলী ভেবে চিন্তে যুদ্ধ বিরতির পক্ষেই মত দিয়েছিলেন। এমতাবস্থায় হযরত আলীর পক্ষ ত্যাগ করে একটি পক্ষ খারিজি হয়ে যায়। হযরত আলী (র:) মোয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করে খারিজি দমনেই প্রবৃত্ত হন। তার পরবর্তী ইতিহাসতো অন্যরকম। কোরআনকে বর্শা ফলকে ঝুলিয়ে সন্ধি স্থাপন করত: মোয়াবিয়া শক্তি সঞ্জয় করে হয়ে উঠেছিলেন অসীম ক্ষমতাধর। মোয়াবিয়ার হাতেই খেলাফতী শাসনের যবণিকা, বাদশাহী শাসন কায়েম, ইয়াজিদের উত্থান সহ মূল ইসলামী ব্যবস্থা তছনছ হয়েছিলো। বলা যায়, শুধু ধর্ম নয় ধর্ম গ্রন্থকে ঢাল হিসেবে খাড়া করে ইতিহাসের মোড় পরিবর্তন করা হয়েছিলো। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটকে তছনছ এবং বিরাজমান স্থিতিশীলতাকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে কুমিল্লায় দেবীর পদতলে পবিত্র কোরআন আবিষ্কার- একটি গভীর ষড়যন্ত্রের স্মারক বলেই প্রতীয়মান। কোন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পক্ষে এহেন অপকর্ম সাধন সম্ভব নয়। যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তারা মারওয়ান, সোয়াবিয়া এবং ইয়াজিদের উত্তরসুরী এবং ভেঁকধারী লেবাসী মুসলমান। তাদের বাপ চাচারা হয়তো জিন্নাহ, মওদুদী, আয়ুব, ইয়াহিয়ার তল্পীবাহক অথবা ভাবশীষ্য হিলো অবশ্যই।