সরওয়ার আহমদঃ মৌলভীবাজারের নন্দিত জননেতা সাবেক গণ পরিষদ এবং সংসদ সদস্য ও জেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান মরহুম আজিজুর রহমানের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে “আজিজুর রহমান ফাউন্ডেশনের “তরফে জীবন পাঠ শীর্ষক একটি স্মরণীকা প্রকাশিত হয়েছে। একজন কীর্ত্তিমান এবং ঐতিহাসিক ব্যাক্তিত্বের জীবনালেখ্যকে বিস্মৃতির ঘেরাটোপ থেকে উত্তরণের মোক্ষম অবলম্বন হচ্ছে স্মৃতিচারণ এবং স্মরণীকা প্রকাশ। বিশেষত উত্তরাধিকারহীন প্রয়াত নেতা আজিজুর রহমান ক্ষেত্রে এহেন প্রয়াস অধিকতর গুরুত্ববহ। তাই আজিজুর রহমান ফাউন্ডেশন কর্তৃক এই শুভ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার।
প্রকাশনার উদ্যোগ শুভ হলেও তাকে ঘিরে আলোচনা সমালোচনার বুদ বুদ উৎসারণকে অস্বীকারের উপায় নেই। জাতীয় স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত আজিজুর রহমান শুধু মৌলভীবাজার অথবা বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলেরই গৌরব নন, বরং এ গৌরবের আলোকচ্ছটা গোটা দেশেই ছড়িয়ে আছে। এমতাবস্থায় বর্ষিয়ান এ রাজনীতিকের জীবন ও কর্ম নিয়ে জাতীয় পর্য্যায়ে এবং সিলেট অঞ্চলের লেখকদের লেখনী প্রত্যাশিত ছিলো। বিশেষতঃ তার সতীর্থ এবং সমসাময়িকদের মধ্যে এখনও যারা জীবিত আছেন তাদের বক্তব্যের আক্ষরিক বিন্যাস সংযুক্ত হলে- প্রকাশিনাটি সার্থকতা লাভ করতো। প্রকাশিত স্মরনীকায় লেখকের অভাব হয়নি। তাতে অনিরুদ্ধ আবেগের স্ফুরণ এবং আত্মপ্রচারণার আধিক্য প্রস্ফুঠিত হয়েছে। আছে ইতিহাস বিকৃতির অজ্ঞাতপ্রসূত ছাপ। প্রকাশনার একাধিক নিবন্ধে এমনকি আজিজুর রহমানের মুদ্রিত সাক্ষাৎকারে উল্লেখিত হয়েছে যে ১৯৬৮ সনে সাংগঠনিক সফরে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজিজুর রহমানের আওয়ামীলীগে যোগদান নিশ্চিত করেছিলেন। কিন্তু ১৯৬৮ সনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। ৬৯ এর গণঅভূত্থানের চাপে এবং পিন্ডিতে আহুত গোলটেবিল বৈঠক যোগদানের লক্ষ্যে তৎকালীন আয়ুবশাহী সরকার মামলা প্রত্যাহার সহ বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদান করেছিলো ৬৯ এর ২২ ফেব্রæয়ারী তারিখে। গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হবার পর একই সনের ২৫ মার্চ আয়ুবখান সামরিক আইনজারী করতঃ ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করে দৃশ্যপটের আড়াল হন। সামরিক আইন জারির ৬ মাস পর্য্যন্ত রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ছিলো। ১৯৬৯ সনের আগষ্ট মাসের পর ঘরোয়া রাজনীতির সুযোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন সীমিত পরিসরে তৎপরতা শুরু করে। সম্ভাব্য সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে কারামুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন দেশ ব্যাপি ঝটিকা সফর শুরু করেন দুলকে পুনর্বিন্যস্তকরণ এবং প্রার্থী বাছাইয়ের লক্ষ্যে। এসময় তৎকালীন সিলেট জেলার বিভিন্ন মহকুমাতেও একাধিকবার আগমণ করেন। ১৯৬৯ সনের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে তৎকালীন কোর্ট রোডস্থ জনমিলন কেন্দ্রেও একটি সমাবেশে বক্তব্য রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তৎকালীন ছাত্রলীগই এ সমাবেশের নেপথ্যে তৎপর ছিলো। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেছিলেন দেওয়ান ফরিদ গাজী। মহকুমা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক কাটামো তখনও অনুপস্থিত ছিলো।। মোদ্দা কথায়- দেওয়ান ফরিদ গাজী এবং তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের তৎপরতায় মহকুমা আওয়ামীলীগের কাঠামো রচিত হয়েছিলো। এই যৌথ তৎপরতার ফসল হিসেবে ন্যাপ থেকে মরহুম আজিজুর রহমান আওয়ামীলীগে যোগদান করেছিলেন ১৯৬৯ সনে। ঐতিহাসিক মানদন্ডে এই ঘটনার বয়স ৫২ বৎসর। অনুসন্ধানের আলোকে পাঁচশত বছরের আগের সুপ্ত তথ্য উপাত্ত বেরিয়ে আসে। সুতরাং অর্ধশত বছরের আগের ঘটনার যথার্থতা খুঁজতে অসুবিধা হবার কথা নয়।
১৯৭১ সনের ডিসেম্বরে হানাদার মুক্ত সমশেরনগর রাজনগর এবং মৌলভীবাজার সদরে মরহুম আজিজুর রহমান কর্তৃক বাংলা দেশের পতাকা উত্তোলনের প্রসঙ্গ এসেছে। হানাদার বাহিনী ৭ ডিসেম্বর রাতে মৌলভীবাজার ব্রিগেড হেডকোয়াটার থেকে পালিয়ে যাবার পরদিন শহরে যৌথবাহিনী প্রবেশ করে। হানাদার বাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন অপসারণের লক্ষ্যে ঐদিন শহরে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। যৌথ বাহিনীর গাইড হিসেবে মীর্জা আজিজ বেগ পশ্চিম বাজারস্থ খেয়াঘাটে গেলে তাকে দেখে নদীর উত্তর পাড়ের শাবিয়া এবং বলিয়ারবাগ গ্রামের কৌতুহলী কিছু জনতা নদী সাতরে এপারে চলে আসে এবং স্বত-স্ফুর্ত ভাবে বিজয় মিছিল করে। এসময় অনানুষ্ঠানিক ভাবে পশ্চিম বাজারস্থ ট্রাফিক পয়েন্টে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন মির্জা আজিজ বেগ। শহরে জনসমাগম দেখে মিত্রবাহিনী অকুস্থলে ছুটে আসলে এবং জনচলাচলে বিধিনিষেধ জারি করলে, আগত জনতা শহর ত্যাগ করে। পরদিন ৯ ডিসেম্বর কার্ফু প্রত্যাহার করা হলে সদরের এম.পি.এ আজিজুর রহমান এস.ডি.ও অফিসে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। হানাদার মুক্ত সমশেরনগর এবং রাজনগরে মরহুম আজিজুর রহমান কর্তৃক স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন অসম্ভব কিছু নয়। নির্বাচিত এম.পি.এ ছাড়াও তিনি মহকুমা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক হিসেবে পতাকা উত্তোলনের দাবীদার। কিন্তু এক্ষেত্রেও বিভ্রান্তি আছে। ৪টা ডিসেম্বর সমশেরনগরে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন সেই এলাকা থেকে নির্বাচিত এম.পি.এ তোয়াবুর রহিম। জীবদ্দশায় তিনি এ দাবী উত্থাপন করেছিলেন জুরালো কন্ঠে। সেসময়ে রাজনগর থানা সহ কমলগঞ্জের তিনটি ইউনিয়ন ছিলো রাজনগর সংসদীয় এলাকাভূক্ত। এতিনটি ইউনিয়নের অন্যতম ছিলো সমশেরনগর ইউনিয়ন। অন্যদিকে রাজনগর দখল করেছিলো- সি.এন.সি স্পেশাল ফোর্স। এ ফোর্সের কমান্ডার অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরী দাবী করেছেন, রাজনগর সদরে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন তিনি। এমতাবস্থায় ঐতিহাসিক দ্বান্দিকতা আছে পতাকা উত্তোলন নিয়ে। এ দ্বন্দের অবসান প্রয়োজন- যথাযথ ইতিহাসের প্রয়োজনে। অন্যদিকে এক সাক্ষাৎকারে গৃহীত প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে ৬ দফা আন্দোলনে মরহুম আজিজুর রহমানের সম্পৃক্ততা দেখিয়েছেন এক লেখক। ৬৯ সনে আওয়ামীলীগে যোগদানের আগে ৬৬ সনে আজিজুর রহমান কিভাবে ৬ দফা আন্দোলনে সংযুক্ত হতে পারেন- এটিও তো এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন। মূলতঃ প্রচারণার আতিশয্যে একশ্রেণীর লেখক নায়ককে খলনায়কে পরিণত করতেও দ্বিধাবোধ করেননা।