মোহাম্মদ আবু তাহের
সমাজ জীবনে অবক্ষয়ের সময়ে যারা সমাজকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য হাল ধরেন তাদের অন্যতম পুরোধা হলেন শিক্ষক সমাজ। শিক্ষকদের বলা হয় এঁধৎফরধহ ড়ভ ঈরারষরুধঃরড়হ ধৎপযরঃবপঃ ড়ভ ঃযব হধঃরড়হ.
শিক্ষকরা একদিকে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেন অন্যদিকে সেই আলোতে সমাজকে ও আলোকিত করেন । এমন কঠিন ও মহৎ কাজটি করে থাকেন আমাদের শিক্ষক সমাজ। এমনই একজন শিক্ষক ছিলেন স ব ম দানিয়াল । তার জন্ম মৌলভীবাজার সদরের আদপাশা গ্রামের এক স¤্রান্ত পরিবারে। তিনি পৌরসভা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক ছিলেন। তাঁর পিতা ও ছিলেন একজন শিক্ষক। দীর্ঘদিন বাংলাদেশ স্কাউট মৌলভীবাজার জেলার সম্পাদক ও বাংলাদেশ স্কাউটস সদর দপ্তরের নির্বাহী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ বাংলাদেশ স্কাউট সিলেট অঞ্চলের কোষাধ্যক্ষ সহ অনেক কল্যাণমূলক কর্মকান্ডে যুক্ত ছিলেন। তিনি এক ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষক ছিলেন। দীর্ঘদিন শিক্ষকতার সাথে জড়িত থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আদর্শের প্রতীক এক প্রজ্ঞাবান মানুষ। একজন শিক্ষক জাতি নির্মাণের কারিগর। দানিয়াল তার আদর্শ চেতনা ও মূল্যবোধ শিক্ষার্থীদের মাঝে সঞ্চার করে গেছেন আমৃত্যু। অসাধারণ অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন। তিনি একজন শিক্ষক হয়ে ও মানুষকে আগে সালাম দিতেন। অত্যন্ত বিনীতভাবে কথা বলতেন। মানুষের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি দলমত নির্বিশেষে সবার সাথে মিশতে পারতেন ।
তিনি যুক্ত ছিলেন নানা সামাজিক সংগঠনের সাথে।আমার সেই প্রিয় মানুষটি ২০২০ সালের ২৯ জানুারি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। মৃত্যুর প্রায় এক মাস পূর্বে তিনি যখন অসুস্থ হয়ে সিলেটের নুরজাহান হাসপাতালে আমি ফেসবুকের মাধ্যমে তার অসুস্থতার খবর জেনে হাসপাতালে গিয়েছিলাম দেখা করতে। আমার সঙ্গে ছিলেন পূবালী ব্যাংক লিমিটেড দরগা গেইট শাখা সিলেট এর ম্যানেজার জনাব মোঃ হুমায়ুন মিয়া। ব্যাংক শাখা ও হাসপাতাল একই ভবনে থাকায় আমি জনাব মোহাম্মাদ হুমায়ুন মিয়াকে দানিয়াল সাহেবের খোঁজখবর নেয়ার অনুরোধ করেছিলাম। তিনি নিয়মিত খোঁজখবর রেখেছেন। আমি যখন তাঁর কেবিনে গেলাম তখন তিনি জনাব হুমায়ুনের কাছে আমার সামাজিক কার্যক্রমের বিষয় তুলে ধরার জন্য সচেষ্ট হলেন। আমাকে বড় ভাই হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এখানে তার বড় মনের পরিচয় পাওয়া যায়। আমাকে পেয়ে কতটা যে আনন্দিত হয়েছিলেন আমি তা প্রকাশ করতে পারবোনা। আমি বেশ কয়েকবার ফোন করে তার খোঁজখবর নিয়েছি। সুস্থ হয়ে মৌলভীবাজার আসার পরও তার সাথে দেখা হয়েছে। তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। স ব ম দানিয়াল ছিলেন একজন সৃষ্টিশীল মানুষ। সৃষ্টিশীল মানুষ দেশ, কাল, সমাজ, বয়স সবকিছুর ঊর্ধ্বে। স ব ম দানিয়াল ছিলেন এমনই একজন মানুষ তার দায়িত্ববোধ ,মানবতাবোধ, সাধারণ মানুষের উপকার করার আগ্রহই প্রমাণ বহন করে আমাদের এই সমাজে এমন নির্লোভ এবং সজ্জন শিক্ষক থাকতে পারেন তার জ্বলন্ত উদাহরণ দানিয়াল ।যে সমস্ত মানুষের কাজ চিন্তা ও মূল্যবোধ মানুষের জীবনকে গভীরভাবে স্পর্শ করে যায় তারা শারীরিকভাবে গত হলেও তারা মানুষের জীবন ও চেতনায় থেকে যান । স ব ম দানিয়াল ও ছিলেন তেমনি একজন । মৃত্যু পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্য। কিছু কিছু মহৎ লোকের কারণে সমাজ এগিয়ে যায় সভ্যতা বিকাশ লাভ করে। দেশের জন্য সমাজের জন্য ভালো ও কল্যাণমূলক কাজ করার মানসিকতা সবার থাকে না মহৎপ্রাণ লোকদেরই থাকে। দানিয়াল পেশায় একজন শিক্ষক হলেও তাকে অনেক বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায়। শিক্ষার মাধ্যমে সমাজকে এগিয়ে নেয়া ও আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের কারিগর ছিলেন তিনি।পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম ঘটনা মানুষের মৃত্যু। মানুষ একটা ক্ষণস্থায়ী জীবন নিয়ে পৃথিবীতে আসে। এরপর জীবনের নাট্যমঞ্চে অভিনেতার ভূমিকা পালন করে চলে যায় চিরদিনের জন্য। এ পরিণতি থেকে রেহাই, নেই কারোর কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে মহামানব পর্যন্ত।
মহান আল্লাহর ঘোষণা কুল ইন্নাল মাওতাল্লাজি তাফিররুণা মিনহু ফা ইন্নাহু মুলাক্বিকুম বলুন, যে মৃত্যু হতে তোমরা পলায়ন করতে চাও তা একদিন তোমাদের পাকড়াও করবেই। মানবজীবনে মুত্যুই একমাত্র নির্মম সত্য। কিন্তু আকস্মিক আচমকা বা দূর্ঘটনা কবলিত মৃত্যুর ঝাঁকুনি অনেক বেশি প্রবল হয়। অনেক বেশি বেদনাদায়ক হয়। এসব ঘটনা থেকেও আমরা উপলব্ধি করি না জীবন কতটা অনিশ্চিত আর মৃত্যু কতটা নিশ্চিত। ক্ষমতা , অর্থবিত্ত সহ নানামুখী লোভের লড়াইয়ে আমরা প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করি। কিন্তু আমরা একবারও ভাবি না এক মুহুর্ত পর বেঁচে থাকবো কিনা। সকল মৃত্যুই আমাদের একটি বার্তা দিয়ে যায় আমরা সকলেই একই পথের পথিক। এই যে, ক্ষণস্থায়ী জীবন সে জীবন অর্থবহ হয় তখনই যখন তার কর্মে সন্তুষ্ট হয় স্বজন ও দেশবাসী। মানুষের মৃত্যু হবেই। তারপরও কোনো কোনো মৃত্যু আত্মীয়-অনাত্মীয় সবাইকে স্তম্বিত করে দেয়।
না মেনে উপায় নেই জেনে ও মেনে নিতে পারে না মানুষ তার আপনজনের মৃত্যু। স ব ম দানিয়ালের মৃত্যুতে মৌলভীবাজারের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা খুব তাড়াতাড়ি পূরণ হবার নয়। মৌলভীবাজারের শিক্ষাক্ষেত্রে, খেলাধুলা সামাজিক ও সাংস্কৃতিতে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন দীর্ঘকাল। শিক্ষক স ব ম দানিয়াল সমাজের বাতিঘর হিসেবে সামাজিক দায়িত্ব পালন করে গেছেন। একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা করে গেছেন, মানবিক মূল্যবোধে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। সৃজনশীল মানুষেরা সমাজকে যেভাবে দিয়ে যাচ্ছেন সমাজ সচেতন মানুষ হিসেবে আমাদের ও উচিত তাদের মূল্যায়ন করা। গুনী মানুষদের মূল্যায়ন করলে সমাজে আর ও গুণী মানুষ তৈরি হয়। আলোকিত মানুষ সৃষ্টি হয়। আদর্শ শিক্ষক স ব ম দানিয়াল সাহেবের স্মরণে স্মরণিকা প্রকাশ করার উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। সমাজে এমন কিছু মানুষ আছেন তাদের কার্যক্রম দেখলে মনে হয় যারা জীবন যৌবন উৎসর্গ করেন মানবকল্যাণে। আমাদেরও বয়স হয়েছে ন্যায়নীতর বাইরে ইচ্ছার বাইরে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে মন সায় দেয় না। চিন্তা-চেতনা ও ন্যায়-নীতিতে সাবলীল মানুষ এখন খুব কমই দেখা যায়। দানিয়াল চিন্তা-চেতনায় একজন পরিশীলিত ও মার্জিত মানুষ ছিলেন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি খেলাধুলা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাবলীল কন্ঠের উপস্থাপনার সার্বক্ষণিক সেবক দানিয়াল তার বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের সমাপ্তি টেনে দেন, রেখে গেছেন স্মৃতির বহর। জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষের অনেক মিটিং এ তার সাথে দেখা হতো। যে কোন বিষয়ে সুচিন্তিত মতামত সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করতেন। একথা অবশ্যই সত্য সব মানুষের মৃত্যুতে দেশ ও সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি হয় না। জীবনের কবি বিশ্বমনস্ক ব্যক্তিত্ব জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন “সকলেই কবি নন কেউ কেউ কবি” তেমনি সবার মৃত্যুতে সমাজও হারায়না কৃতি সন্তান। সবাই মানুষের জন্য কিংবা একটা মানবিক সমাজ গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও নন। তাই কারো কারো প্রস্তানে আমরা হারাই সত্যিকারের সমাজসেবক। শত শত ছাত্রছাত্রীর কাছে শিক্ষক দানিয়াল এমন একজন স্যার ছিলেন যার অভাব বোধ করবে তারা দীর্ঘদিন। সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনেক বিষয়ে তার অনুসরণীয় পথ বর্তমান প্রজন্মের জন্য বিশেষ পাথেয় হয়ে থাকবে। সত্য ও শান্তি সন্ধানের সাধক হিসেবে তিনি মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন আরও বহুকাল। আমি তার রুহের মাগফিরাত কামনা করি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
লেখক-কলামিস্ট, ব্যাংকার ও গবেষক