সরওয়ার আহমদঃ
শৈত্য প্রবাহের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার তথা পৌর নির্বাচনী প্রবাহ এবার নিস্তরঙ্গ নাকি তরঙ্গিত তার মাপজোক দেওয়ার তেমন কোন অবকাশ নেই। তবে হরেদরে হাল আমলের নির্বাচন যেরকম অনুষ্ঠিত হয় তেমনি ভাবেই হচ্ছে। ব্যতিক্রমী ঘটনাও নির্বাচনী ডামাডোলে আপন মহিমা নিয়ে একাকার হবার নজির আছে বৈকি। সম্পদের একাধিপত্য নিশ্চিত লক্ষ্যে আপনে বড় ভাই তার ছোট ভাইকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের দিন। সম্পত্তির লিপ্সায় আপনজন হত্যা এদেশে নতুন বিষয় নয়। প্রায়ই এ ধরনের জঘন্য এবং মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু চট্টগ্রামের হন্তারকরূপী বড়ভাই তার ছোটভাইকে হত্যার জন্য পরিকল্পিত ভাবে নির্বাচনের দিনটাকে “মাহেন্দ্রক্ষণ” হিসাবে বেছে নিয়েছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। নির্বাচনী উত্তেজনার প্রভাবে নির্বাচনের দিন দাঙ্গা হাঙ্গামা খুন খারাবি সহ নানাবিধ অনাচার উপাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠার পাশাপাশি “জোর যার মুল্লুক তার” নীতিটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আসছে কালপরিক্রমায়। নির্বাচন কালীন সহিংসতার দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি এবং বিচারের নজির এদেশে খুব কমই আছে। এই আলোকে সম্পদলিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য বড়ভাই তার নিজ ছোটভাইকে হত্যাকরেছে নির্বাচনী হাঙ্গামার ছদ্মাবরণে। এভাবে নির্বাচনী নাট্যমঞ্চে বড়দলের প্রার্থী নিজস্ব প্রভাবের ভিত্তি মূলে দাড়িয়ে জনবলের সাথে বাহুবলের কসরৎ প্রদর্শন পূর্বক ছোটদলের প্রার্থীকে যদি কপোকাৎ করে, তাহলে আশ্চর্য্য হবার কি আছে! প্রশ্ন উঠতে পারে এটাই কি তবে গণতন্ত্র? এপ্রশ্নের ল্যাংরা জবাব আছে- গধলড়ৎরঃু সঁংঃ নব মৎধহঃবফ. গণতন্ত্রে এমন নীতি বাক্যতো প্রতিষ্ঠিত। তবে মেজরিটি এবং মাইনরিটির প্রতিদ্বন্দিতায় অবলীলাক্রমে মাইনরিটির পরাজয়তো বিধিলিপি বলেই মেনে নিতে হয়। গণতন্ত্রের অবস্থান এখানে ঢোল সমতুল্য। যে বাজাতে পারবে তারই ইচ্ছায় আওয়াজ উঠবে। এথেন্সীয় গণতন্ত্রের এটাই হচ্ছে হালফিল অবস্থা।
এবার আসা যাক চলমান পৌর নির্বাচন প্রসঙ্গে। বলাবাহুল্য-জাতীয় কিংবা স্থানীয় নির্বাচনের স্বরূপের মধ্যে অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে তেমন হেরফের ধরেনি। হোন্ডার সাথে গুন্ডা এবং ফ্রীষ্টাইলে ব্যালট পেপারে সীল মেরে বাক্সে ঢুকানোর কলঙ্ক তীলক নির্বাচনের কপালে আকা হয়েছিলো সেই সত্তুর আশির দশকে। এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে প্রতিপক্ষের নির্বাচনী এজেন্টকে তাড়িয়ে দিয়ে বুথ দখল এবং প্রক্সি ভোট প্রদান। নির্বাচনকে প্রতিহত করণের নামে ভোট কেন্দ্র পুড়িয়ে দেয়া সহ প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসার খুন। আছে অন্যান্য উপসর্গও। সমাজের একাংশে ভোট আসে বিকি কিনির মৌসুম হিসেবে। কোরবানির হাটের গরুছাগলের মতো ভোটারদেরকে গণ্যকরে ভোট ক্রয় এবং একশ্রেণীর ভোটারদের মধ্যে বিক্রি হবার প্রবণতা সুস্থ এবং স্বত:স্ফুর্ত ভোটের ক্ষেত্রে মারাত্মক অন্তরায় হয়ে উঠেছে। নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সিভিল এবং পুলিশ প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের প্রশ্নটিও এখন লাইম লাইটে বলে এসেছে। বি.এন.পির কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভোটের ক্ষেত্রে প্রশাসনকেই বড় প্রতিপক্ষ হিসেবে মনে করছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেছেন। কোথাও প্রত্যক্ষ এবং কোথাও পরোক্ষ প্রভাব বিস্তার করে প্রশাসনিক ভাবে সরকার দলীয় প্রার্থীকে জিতিয়ে আনা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে বিরোধী দল থেকে। এ অভিযোগ নতুন নয়। আওয়ামীলীগও যখন বিরোধী দলে ছিলো তখনও এ ধরণের অভিযোগ উঠতো। এই অভিযোগকে ইন্দ্রীয় গ্রাহ্য করে সরল দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়- তর্কাতীত নির্বাচন বুঝি দূরঅস্ত হয়ে উঠলো। নির্বাচনে বিজয়ী পক্ষ বলে সুস্থ এবং সুন্দর নির্বাচন হয়েছে। অন্যদিকে পরাজিত পক্ষ বলে- পেশী শক্তি ও প্রহসনের নির্বাচন। ফাঁকতালে তৈরী হয় ধ্রু¤্রজাল। এই ধূম্যজাল এখন আলোকবর্তীতাকাকে ঠাহর করতে পারছেনা ষ্পষ্টভাবে। তবে উল্লেখিত উপসর্গের প্রতিক্রিয়া যে আছে সেটি ক্রমশ: প্রচ্ছন্ন হয়ে উঠছে। জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ তথা “মহামূল্যবান” ভোট প্রদানের ব্যাপারে ক্রমশ: বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছে। যার ফল শ্রুতিতে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির হার চল্লিশ পার্সেন্টের (জাল ভোট সহ) কোটা অতিক্রম করতে পারছেনা। শতভাগ ভোটের মধ্যে চল্লিশ পার্সেন্টের উপস্থিতি যদি ঘটে তাহলে বাকী ষাট পার্সেন্টের অনুপস্থিতিকে কোন বাটখারায় পরিমাপ করা হবে? মেজরিটির প্রসঙ্গ আসলে ভোটকেন্দ্র বিমুখ ৬০ পার্সেন্ট ভোটারদেরকেই ধরে নিতে হবে। তার বিপরীতে মাইনরিটী বলতে ভোটপ্রদানকারী ৪০ পার্সেন্টকে বোঝাবে। অবস্থা বিবেচনায় এবং বাস্তবের আলোকে এই চল্লিশ পার্সেন্টেই ষাট পার্সেন্টের উপর কর্তৃত্ব বহাল রাখছে। গণতন্ত্রের কি বিচিত্র মহিমা।
এখন প্রসঙ্গ আসতে পারে ভোট কেন্দ্রে গরিষ্টসংখ্যক ভোটারদের অনুপস্থিতির ব্যাপার। ভোটারদের ভোটকেন্দ্র বিমুখতার মানসিকতা একদিনে তৈরী হয়নি। এখানে বিন্দু বিন্দু জলে সিন্ধর বিস্তার ঘটেছে পালাক্রমিক বিতর্কিত নির্বাচনের প্রভাবে। তার আনুপূর্বিক বিশ্লেষণ এখানে সম্ভব নয়। ভোটের আগে সংগঠন সহ প্রার্থীরা ভোটারদেরকে নানারং এর স্বপ্নদেখায়। ভোট শেষে সেই স্বপ্নের ফাঁনুস উবে যেতে তেমন বিলম্ব না হওয়ায় ভোটার মানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ভোট কেন্দ্র দখল করে প্রক্সিভোটের দৌরাত্ম্যর মুখে ভোটাররা বিফল মনোরথে ফিরে যায়। প্রশ্ন উঠে- আমার ভোট যদি আমি না দিতে পারলাম, তাহলে এখানে এসে লাভ কি? নির্বাচন কেন্দ্রে দাঙ্গা বাধলে পুলিশ প্রথমে পেটায় আগত নিরীহ ভোটারদেরকে। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে পিঠে লাটির বাদাম খেতে অভ্যস্থ নয় এক শ্রেণীর নিরীহ ভোটার। ভোট কেন্দ্রে দায়িত্বরত প্রিসাইডিং এবং পোলিং অফিসারদের ক্ষেত্র বিশেষে দারসাড়া দায়িত্ব পালন এবং প্রক্সি ভোট প্রদানে মৌন সমর্থনের বিষয়টিও জনান্তিকে প্রশ্ন তুলেছে। ভোট প্রয়োগের ক্ষেত্রে একশ্রেণীর ভোটার মানসে প্রেষ্টিজ ইস্যু আড়াল থেকে নাড়া দেয়। টাকা দিয়ে ভোট কেনার বিষয়টি চাপা থাকেনা। এ হেন প্রেক্ষাপটে নৈতিকতা সম্পন্ন ভোটারদের একাংশ ভোট কেন্দ্রে হাজির হয়ে গায়ে দাগ লাগাতে নারাজ হয়ে উঠেছে। ইদানীং ভোটারদেরকে ভোটকেন্দ্র বিমুখ করে তোলার একটি পরোক্ষ নেটওয়ার্কও সক্রিয় রয়েছে। ভোটার মহলে তারা এই বাণীই প্রচার করছে- ভোট দিয়ে কি হবে, যে পাশ করার সে ভোটের আগের রাতেই পাশ হয়ে গেছে। আপনার ভোট কোন কাজে লাগবেনা। এই অপপ্রচারণা আম পাবলিক মানসকে প্রভাবিত করতে ধন্ধন্তরির মতো কাজ করছে। উল্লেখিত উপসর্গসমূহ গণতান্ত্রিক সোপান বলে গণ্য সাধারণ নির্বাচনকে “জন উৎসব” এর পরিবর্তে জন প্রহসনে পরিণত করার পথ ধরেছে। নির্বাচনকে যদি জনমতের প্রকিফলন হিসেবে গণ্য করা হয়, তাহলে সেই জনমতকে টুটি চেপে প্রহসনে পরিণত করার প্রতিক্রিয়া কোন দিনই শুভ হয়নি।