“এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ
মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান”
বিশেষ প্রতিবেদকঃ
একে একে নিঁভিছে দেউটী………..। জীবনঘাতী করোনা ভাইরাসের ছোবলে রাষ্ট্রীয় পর্য্যায়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মন্ত্রী বুদ্ধিজীবি ও শীর্ষ স্থানীয় পেশাজীবিদের বেদনাবিঁধূর প্রয়াণের সাথে সঙ্গঁতি রেখে করোনার গ্রাসে ঝরে পড়লেন মৌলভীবাজার তথা বৃহত্তর সিলেট অঞ্জলের খ্যাতিমান রাজনীতিক আজিজুর রহমান। গত মঙ্গঁলবার রাত আড়াইটায় ঢাকাস্থ সি.এম.এইচ হাসপাতলে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মরণ সমুদ্রের সেপারে তার মহাযাত্রা নিশ্চিত হলেও এপারে রেখে গেছেন গৌরবোজ্জ্বল নানমুখি অধ্যায়। যাহা তাকে মৃত্যুজয়ী এবং অনশ্বর করে রাখবে যুগের পর যুগ ধরে।
নির্বাচিত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বরত অবস্থায় করোনা আক্রান্ত হবার পর গত ৫ আগষ্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার এম্বুলেন্সের মাধ্যমে তাকে মৌলভীবাজার থেকে ঢাকাস্থ সি.এম.এইচ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে মৃত্যুর সাথে ১২ দিন পাঞ্জালড়ার পর গত মঙ্গলবার রাতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জাতীয় পর্য্যায় শোকের মাস হিসেবে খ্যাত আগস্ট মাসে তার মৃত্যুবরণ মরহুমের আদর্শিক চেতনার ভবলোক মূল্যায়নের সাথে যুক্ত হলো। মৌলভীবাজারের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গণে মরহুম আজিজুর রহমানের অধিষ্ঠান ও বিচরণ পাঁচ দশকেরও অধিক কালের। সাংস্কৃতিক অঙ্গঁণ থেকে রাজনৈতিক অঙ্গঁণে আসার পর পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চয়েস অনুসারে আজিজুর রহমান মাত্র ২৭ বছর বয়সে ১৯৭০ সনের জাতীয় নির্বাচনে মৌলভীবাজার সদর থেকে প্রাদর্শিক পরিষদের এস.পি.এ হিসেবে নির্বাচিত হন। এ সুবাদে স্বাধীনতা উত্তর গণপরিষদ সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের নতুন সংবিধানে স্বাক্ষর প্রদান করেন। তার আগে ১৯৭০ সনের এপ্রিল মাসে মহকুমা আওয়ামীলীগের সম্মেলনে মহকুমা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তী কালে জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি পদে বার নির্বাচিত হবার পর শেষমেষ কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। গণ পরিষদ সদস্য পদ ছাড়াও ১৯৮৬ এবং ১৯৯১ সনের সংসদ নির্বাচনে মৌলভীবাজার রাজনগর আসন থেকে দুবার সংসদ সদস্য পদে নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সনের সংসদে তিনি বিরোধী দলীয় হুইপের দায়িত্ব পালন করেন। গত ২০১১ সনে মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ২০১৬ সনের জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে মরহুম আজিজুর রহমান চীন ও যুক্তরাজ্যে একাধিক বার সফর করেন।
মরহুম আজিজুর রহমান ১৯৪৩ সনে মৌলভীবাজার শহরতলির গুজারাই গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন স্বনামধন্য প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার আব্দুছ ছত্তার ওরফে আকলু মিয়া। ১৯৬২ সনে হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজ থেকে বি.কম পাস করার পর মৌলভীবাজার সাংস্কৃতিক অঙ্গঁণের সাথে জড়িয়ে পড়েন। ন্যাপ রাজনীতি পরিত্যাগ করে বঙ্গঁবন্ধুর আহব্বানে তিনি আওয়ামীলীগে যোগদান করে সক্রিয় রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। পঞ্চাশ বছরের রাজনৈতিক পরিক্রমায় চড়াই উৎরাইকে ইন্দ্রীয় গ্রাহ্য করে শুধু মৌলভীবাজার নয়, বৃহত্তর সিলেট সহ জাতীয় পর্য্যায়ে স্বমহিমায় অবতীর্ণ হতে পেরেছিলেন। মরহুম আজিজুর রহমানের হাত ধরে অনেকের উর্দ্ধারোহণ ঘটেছে। আজীবন অকৃতদার আজিজুর রহমান ছিলেন সামাজিক অন্তঃপ্রাণ, নিরহঙ্কার ও নির্লোভ চরিত্রের অধিকারী। তাই তার অবাঞ্চিত প্রায়ণে শোকের ছায়া নেমে আসে সর্বমহলে। গতকাল সকাল এগারোটায় ঢাকা থেকে নিজ বাসভূমে মরদেহ আসার পর সর্বস্তরের শোকাকূল মানুষের ঢল নামে বাড়ীতে। নেতার মৃতমুখ একনজর দর্শণের জন্য ভীড় জমে উঠে অনুরাগী মহলের।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও যোদ্ধা হিসেবে ১৯৭১ সনে আজিজুর রহমানের ভূমিকা ছিলো সাহসী সৈনিকের সমান। ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ ভোরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সর্বাগ্রে তাকে গ্রেফতার করে এবং নির্য্যাতন চালায়। মধ্য এপ্রিলে সিলেট কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর যুদ্ধ সংগঠনে তিনি ঝাপিয়ে পড়েন। রণাঙ্গঁণের বেইজ কমান্ডার ছাড়াও তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। একারণে বাংলাদেশ সরকার চলতি ২০২০ সনে তাকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে। গতকাল রাষ্ট্রীয় মর্য্যাদায় তাকে সমাহিত করা হয় নিজগ্রামে গুজারাইয়ে। তার আগে বিকাল চার ঘটিকায় মরহুমের জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয় হযরত শাহ মোস্তফা (র:) এর মাজার সংলগ্ন ঈদগাহ ময়দানে। করোনাকালীন বিধি নিষেধ মেনেও হাজার হাজার জনতার উপস্থিতি ঘটেছিলো অন্তিম বিদায় লগ্নে। মরহুম আজিজুর রহমানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বন ও পরিবেশমন্ত্রী মো: শাহাব উদ্দিন। শোকের সম্মিলনীর মধ্যেও আম জনতা থেকে আওয়াজ উঠেছে- “এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান”।… বিদায় মাটি ও মানুষের নেতা আজিজুর রহমান।