বিশেষ প্রতিনিধিঃ
প্রবাসী অধ্যূষিত মৌলভীবাজার জেলায় প্রতিনিয়িত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রবাসীরা আসছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন করোনা আক্রান্ত। জেলা প্রশাসকের তথ্য অনুযায়ী ১ মার্চ থেকে এ সংবাদ লেখা পর্যন্ত মৌলভীবাজারে ২ হাজার ৭’শ ৮৫ জন প্রবাসী এসেছেন। তবে বেসরকারী তথ্য মতে এর কয়েকগুন বেশি প্রবাসী মৌলভীবাজার এসেছেন। যার হিসাব অনেকটা জেলা প্রশাসকের কাছে নেই। আগত প্রবাসীদের ১৪ দিনের হোম কোয়ারেইন্টানে রাখতে প্রশংসনীয় ভুমিকা রাখেন মৌলভীবাজার জেলা পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ পিপিএম (বার) এর নেতৃত্বাধীন পুলিশ সদস্যরা। এ করোন পরিস্থিতিতে জেলার ৭ উপজেলার অফিসার ইনচার্জরা আন্তরিকতার সহিত দায়িত্ব পালন করেন।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সৃষ্ট অচলাবস্থায় আয় রোজাগার কমেছে দেশের মানুষের। অসহায় নিম্নবিত্তের পাশে সহায়তা নিয়ে দাঁড়িয়েছেন অনেকে। কিন্তু সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণি অর্থকষ্টে থাকলেও পারিপার্শ্বিক লোকলজ্জার ভয়ে সহযোগিতা চাইতে পারেন না। এ দুর্দশায় এ শ্রেণির মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে মৌলভীবাজার জেলা পুলিশ। সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন না করে তাদের গোপনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছেন পুলিশের সদস্যরা। এটি জেলা পুলিশের নিজস্ব উদ্যোগে। সরকারি প্রণোদনা নয়। পুলিশের সমাদৃত এ উদ্যোগ মানুষের হৃদয়ে স্থান পেয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মৌলভীবাজার সদর উপজেলার এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বলেন, মৌলভীবাজার মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ আলমগীর হোসেন আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, “ভাই আপনার সাথে একটু দেখা করতে চাই। উনার ফোন পেয়ে প্রথমে আমি ভয় পেয়ে ছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি যখন বলেন ভাই জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে আপনার জন্য সামান্য উপহার সামগ্রী রয়েছে। কোথায় পৌঁছানো যায়। বাসার ঠিকানা দেয়ার ১৫ মিনিটের মাথায় তিনি খাদ্য সামগ্রী নিয়ে হাজির হন”। এভাবে মৌলভীবাজার জেলা পুলিশের সদস্যরা রাতের আদারে কয়েক শতাধিক মধ্যবিত্ত পরিবারকে সহযোগীতা করেছেন এবং এটা অব্যাহত আছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা সংবাদে তাদের কারো নামই উঠে আসেনি।
জেলা পুলিশ জানায়, এ পর্যন্ত পুরো জেলায় ১৭ জন পুলিশ সদস্য করোনায় অক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে অনেকেই সুস্থ্য হয়েছেন। বাকীরা চিকিৎসাধীন আছেন। এখন পর্যন্ত কেউ মারা যাননি।
করোনা পরিস্থিতিতে জেলা পুলিশের উল্লেখযোগ্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে জেলার বাজারসমূহ উন্মুক্ত স্থান বা রাস্তাঘাটে স্থানান্তর করা, বাজার ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে নিয়মিত মাইকিং, জনসাধারণের ভিড় কমানোর লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ বাজারসমূহে মানুষজনের চলাচল একমুখীকরণ, জরুরি পণ্যসামগ্রী, চিকিৎসা সরঞ্জামাদী, অন্যান্য জরুরী পরিসেবা পরিবহনে সহযোগিতা, মোবাইল শপ চালু করার মাধ্যমে ঘরে বসে খাদ্য সামগ্রী কেনাকাটার ব্যবস্থা, জেলার সকল মসজিদে ইসলামিক ফাউন্ডেশন/সরকার কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনা সমূহ রেকর্ড আকারে প্রচার, জেলার সকল প্রবেশ পথে থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে আগতদের তাপমাত্রা পরীক্ষা, হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট বাড়িতে সাইনবোর্ড, লাল পতাকা উত্তোলন, স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্তকরণ, জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ড্রোন ব্যবহার করে জনসমাগম পর্যবেক্ষণ, করোনা আক্রান্ত রোগীর দাফনে সার্বিক সহযোগীতা, জেলার ৬৭টি ইউনিয়নে বিট অফিসার হিসেবে একজন সাব-ইন্সপেক্টর নিয়োগ করার মাধ্যমে কোন প্রকার সাহায্য পায়নি এধরনের লোকদের তালিকা সংগ্রহ করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরে আনা এবং নিজেদের পক্ষ থেকে সহযোগীতা করা, সোর্স থেকে ফোনকলের মাধ্যমে প্রাপ্ত কয়েকশ অভাবী ও মধ্যবিত্ত লোকজনের নিকট খাবার পৌঁছে দেয়া, জেলা ব্যাপি সচেতনতা মূলক লিফলেট বিতরণ এবং পুলিশ সদস্য ও সাংবাদিকদের মধ্যে “ফেস শিল্ড” বিতরন করা হয়। জেলা পুলিশ বিভাগের এমন কাজে সস্তি ফিরেছে এসেছে স্থানীয়দের মাঝে।
এছাড়াও করোনার শুরুতেই পুলিশ সদস্যদের রেইনকোটকে পিপিই হিসেবে ব্যবহার করে কার্যক্রম শুরু করে, পুলিশে কর্মরত সকল সদস্যদের নিজ উদ্যোগে মাক্স/হেডক্যাপ, হ্যান্ড গ্লোভস তৈরি করে তাদের মধ্যে বিতরন করা হয়, পুলিশের সকল স্থাপনায় জীবাণুনাশক সলিউশন তৈরি, থানা, ফাঁড়িসহ সকল স্থাপনায় থার্মাল স্ক্যানার ব্যবহার, থানায় আসা সেবা গ্রহীতাদের হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা, সকল সদস্যদের মধ্যে মিনি সাবান এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার সরবরাহ, নিজেদের মাধ্যমে “সোপি ওয়াটার” তৈরি করে পুলিশ ইউনিট সমূহে হাত ধোবার কাজে ব্যবহার, পুলিশ সদস্যদের পান করার জন্য গরম পানি সরবরাহের ব্যবস্থা, কর্মস্থলে যাবার আগে এবং কর্মস্থল থেকে ফিরে ব্যবহৃত প্রতিটি যানবাহন জীবাণুমুক্ত করা, প্রত্যেক স্থাপনার প্রবেশ মুখে হাত ধোয়ার সাবান/হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবস্থা, জেলার প্রতিটি ইউনিটে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরন এবং করোনা সচেতনতায় ব্যানার টাঙ্গানো।
জেলা পুলিশের সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে লেখক, গবেষক ও ব্যাংকার মোঃ আবু তাহের বলেন, জেলার পুলিশ সদস্য করোনার শুরু থেকেই সরকারি নির্দেশনার আলোকে সকল ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। অনেক করোনায় আক্রান্ত হলেও অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন থেকে সামান্য সময়ের জন্যও বিরত থাকেন নি। জেলার সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বলেন, “করোনা পরিস্থিতিতে জেলা পুলিশ প্রশংসনী কাজ করেছে। সরকারি নির্দেশনা পালনে তাদের আন্তরিকতার ঘাটতি ছিলনা। তাদের এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে মৌলভীবাজার জেলাকে করোনা মুক্ত করা সম্ভব।
হাকালুকি যুব সাহিত্য পরিষদের সভাপতি লেখক এম এস আলী বলেন, গ্রামে বসেও পুলিশের সেবা পেয়েছি।
জেলা পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ পিপিএম (বার) বলেন, উল্লেখিত কার্যক্রম গ্রহনের মাধ্যমে জেলার সংশ্লিষ্ট সকল সরকারি/বেসরকারি দপ্তর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে সমন্বয় করে করোনা মোকাবিলায় মৌলভীবাজার জেলা পুলিশ দিন-রাত নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করছে। আমরা বিশ্বাস করি, সকলের সম্মিলিত চেষ্টায় করোনাকে জয় করা সম্ভব। পাশাপশি তিনি জেলাবাসীর আন্তরিক সহযোগীতার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
Post Views:
0