সরওয়ার আহমদঃ
কথায় কথা বাড়ে। বানভাসি জীবের যতো ভেসে আসা মায়ানমারের বারোলক্ষাধিক শরনার্থী নিয়ে ইতিমধ্যে নানা মুণির নানা মতের উদগীরণে মূলপ্রতিপাদ্য ধূ¤্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। নিজ দেশে অমানবিক ভাবে আক্রান্ত রোহিঙ্গাঁকে পুশব্যাক করে ফেরত পাঠানো যেমনি ছিলো দুরূহ এবং অমানবিক, তেমনি আশ্রয় প্রদানের ফলশ্রুতি হিসেবে “দয়ায় আপদ বাড়ে” এমন কিংবদন্তীর বাস্তবতায় দেশ তথা জাতিকে বোধ হয় কাফ্ফারা দিতে হবে। এদেশে শরনার্থী কিংবা উদ্বাস্তদেরকে আশ্রয় প্রশ্রয় দেওয়ার প্রতিফল কি হতে পারে সেটি অতীতের বাস্তবতা ঘাটলে সবকিছুই নখদর্পনে আসার কথা। “ধর্মীয় কীট” প্রণীত দ্বিজাতিতত্বের লেজুড় ধরে ১৯৪৬, ১৯৪৭ এবং ১৯৪৯ সনের পর্য্যায়ক্রমিক সম্প্রদায়িক দাঙ্গাঁ এবং রক্তাক্ত দেশ ভাগের প্রেক্ষাপটে এদেশ উদ্বাস্ত তথা শরনার্থীর প্রথম সান্নিধ্য লাভ করেছিলো। দাঙ্গাঁউদ্ভুত পরিস্থিতিতে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে দলে দলে বিহারী এবং মোহাজিররা তৎকালীন পূর্ব বঙ্গেঁ এসে ঠাঁই নিয়েছিলো। মূলত: সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে তৎকালীন সরকার বিহারী এবং মোহাজিরদেকে এদেশে পুণর্বাসিত করার ব্যবস্থা করেছিলো। পরিকল্পনার প্রথম ধাপ ছিলো এদেশ থেকে হিন্দু বিতাড়ন করে উদ্বাস্তদেরকে পুণর্বাসিত করণ। দ্বিতীয় ধাপ ছিলো- উদ্বাস্তদেরকে পঞ্চমবাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা। দুটো লক্ষ্যই সফল হয়েছিলো। ভেসে আসা উদ্বাস্তরা সদর্পে অবস্থান গ্রহণ করেছিলো। অন্যদিকে এদেশের স্থায়ী বসত ভিটা এবং জমিজিরাত ফেলে দলে দলে হিন্দু জনতা দেশত্যাগী হয়ে ছিলো। পরবর্তী অবস্থা আরও পরিস্কার। ৫৪ সনে নিরঙ্কুশ ভোটে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়ে পূর্ববঙ্গেঁ সরকার গঠনের পর সেই সরকারকে ফেলে দেয়ার প্রধান উপলক্ষ্য হয়ে উঠেছিলো এই ভেসে আসা উদ্বাস্তরা। নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও খুলনাতে বাঙ্গাঁলী বিহারী দাঙ্গাঁ বাঁধিয়ে দিয়েছিলো পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় কায়েমী চক্র। এবং এই অজুহাতে পূর্ব বঙ্গেঁর যুক্তফ্রন্ঠ সরকারকে অপসারণ করা হয়েছিলো। ১৯৭১ সনে এই ভেসে আসা উদ্বাস্তদের ভূমিকা আত্মবিস্মৃত সমাজ ভুলে গেলেও ইতিহাস তা ভুলেনাই। বাঙ্গঁলী জাতি সত্ত্বাকে দলিতমথিত করার ক্ষেত্রে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পাশাপাশি স্থানে স্থানে ছড়িয়ে থাকা বিহারী চক্রের ভূমিকা ছিলো অগ্রণী পর্য্যায়ে। গণ হত্যা এবং বুদ্ধিজীবি হত্যার ক্ষেত্রে বিহারীরা ছিলো মারমুখী। ৭১ সনের ষোল ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনীর পরাজয় বরণ এবং আত্মসমর্পণের পর স্বাধীন বাংলাদেশে কয়েকলক্ষ বিহারী রয়ে গিয়েছিলো। তারা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য দেখায়নি। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বিহারীদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার কথা প্রাধান্য পেলেও পাকিস্তান সরকার তেমন গুরুত্ব দেয়নি। বিহারীদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে সম্মতি থাকলে পাকিস্তানের কোন সরকার এ ব্যাপারে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়নি। ৪৭ বছর পর এখন বাংলাদেশ সরকারও বিহারী ফিরিয়ে নেয়ার প্রসঙ্গঁটি ভূলে গেছে। রোহিঙ্গাঁদের ক্ষেত্রেও হয়তো এমনটি হতে পারে। এই বিহারী সমাজ বাংলাদেশের বাস্তবতাকে কোন দিনই মেনে নেবে না। বংশ পরম্পরায় এরা বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষীয় সরকারের বিরোধী অবস্থায় রয়েছে। এই সমাজের সাথে অপরাধজগতের যোগসূত্রতা বেশী একারণেই যে, তারা দেশ প্রেমিক নয়। এদেশে তারা বসবাস করলেও দেশের ভূমি পুত্র তারা হতে পারেনি। পুরনো উদ্বাস্ত এই বিহারী এবং নতুন উদ্বাস্ত রোহিঙ্গাঁরা একই মুদ্রায় এ পিঠ-ওপিঠ নয় কি? নৃতাত্ত্বিক ভাবে রোহিঙ্গাঁরা নিগ্রোয়েড, আফ্রোয়েড ও মঙ্গঁলোয়েড সংমিশ্রণে শংকর জাতি হিসেবে গণ্য হলেও মগ রক্তের প্রাধাণ্য রয়েছে তাদের ধমনীতে। তদুপারি বংশ পরস্পরায় অশিক্ষা, কুশিক্ষা অবজ্ঞা এবং নির্য্যাতনের যাতাকলে পিষ্ট হতে হতে তারা হয়ে উঠেছে দুর্বিনীত, অপরাধপ্রবণ তথা অন্ধকার জগতের বাসিন্দা। তাই ভয়ঙ্কর পথে অগ্রসর হতে তাদের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। ধর্মের নামে বিশ্বব্যাপী জেহাদের ছদ্মাবরণে যে জঙ্গী তৎপরতা শুরু হয়েছে, সেই ¯্রােতে রোহিঙ্গাঁদের ডুবসাতার দিতেও ইন্ধন আছে। বলা বাহুল্য- জঙ্গী তৈরীর ফ্যাক্টরী খুলে বসেছে পাকিস্তান। এই ফ্যাক্টরীর উপজাত গোষ্ঠী আফগানিস্থান ও কাশ্মীরেই তাদের তৎপরতা সীমাবদ্ধ রাখবে কেন? তাদের নজর আছে নিকটবর্তী দেশ সমূহের প্রতি। গোয়েন্দা সংস্থা আই.এস.আই আছে পথ প্রদর্শন হিসেবে। আই.এস.আইর সাথে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাঁ সংগঠন “আরসা”র যোগসূত্র আছে। এই যোগসূত্রতার ফলেই আরসা’র প্রশিক্ষিত ক্যাডাররা মায়ানমারের পুলিশ ও সেনা পোষ্টে হামলা চালিয়েছিলো। তার প্রত্যুত্তরে সেখানে শুরু হয় রোহিঙ্গাঁ নিধন এবং উচ্ছেদ অভিযান। উচ্ছেদকৃতরা নিকটবর্তী অন্য দেশে না গিয়ে বাংলাদেশের প্রতি যে ধাবিত হবে এর হিসাবতো আগেই করা হয়েছিলো। বলতে দ্বিধানেই- সব কিছুই সংগঠিত হয়েছে পরিকল্পনা মাফিক। ১৯৭৮ এবং ১৯৯১ সনে মিয়ানমার থেকে ভেসে আসা রোহিঙ্গাঁরা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলো। দেনদরবার করে তাদের সবাইকে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। তাই আশ্রিতরা সম্ভাবনাময় কক্সবাজারকে মাদক বাণিজ্যের সিংহদ্বার হিসেবে তৈরী করেছে। লক্ষ্য একটাই- প্রতীভাসম্পন্ন বাঙ্গাঁলী সম্ভাবনার অঙ্কুরকে মাদক ভাইরাস দিয়ে গুলিয়ে ফেলা। হয়েছেও তাই। এখন শুরু হয়েছে আরেক খেলা। বাংলাদেশী উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে কিভাবে আছাড় দেয়া যায়। তারই কৌশল হিসেবে অজুহাত তৈরী করে শরণার্থীদের ঢল বাংলাদেশের উপর ঠেলে দেয়া হয়েছে। উদারতা প্রদর্শন করে বাংলাদেশ সরকার এই শরাণার্থী ঢলকে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু হিতে কতটুকু বিপরীত ধরেছে সেটি এখন টের পাওয়া যাচ্ছে। রোহিঙ্গাঁ শরণার্থীদের ভরে কক্সবাজারের ছয় হাজার একর বনভূমি উজাড় হয়েছে। টেকনাফ উখিয়ার মানুষ স্বগৃহে এখন পরবাসী। সেখানকার সামগ্রীক পরিবেশ বিপর্যয়ের ছাপে সংক্রামিত হচ্ছে বৃহত্তর চট্টগ্রাম। অত:পর প্রভাবিত হবে গোটা দেশ। জাতীয় অর্থভান্ডার থেকে ইতিমধ্যে খসে পড়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকা শুধু পুনর্বাসন খাতে। আগামীতে এই বোজা আরও বাড়বে। আন্তর্জাতিক সাহায্য বা অনুদানের বর্তমান যে প্রবাহ আছে সেটিও এক সময় ক্ষীণ হয়ে আসবে। অন্যদিকে শরণার্থী ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক চাপ আপাতত: বৃদ্ধি পেলেও সেই চাঁপে একমুখা মিয়ানমার সরকারের ঘাড় নত হবে নি না- সেটিও প্রশ্ন সাপেক্ষ। আন্তর্জাতিক মাতববরদের এক্ষেত্রে আন্তরিকতা কতটুকু আছে সেটিও বোধগম্যের বাইরে। কাশ্মীর সমস্যায় আন্তর্জাতিক মাতববরী তেমন কার্য্যকর হতে পারেনি। ৭১ সনে ভারতের উপর চাপিয়ে দেওয়া ১ কোটি বাংলাদেশী শরণার্থীর ব্যাপারেও আন্তর্জাাতিক চাপে কোন ফলোদয় হয়নি। শেষমেষ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হয়েছিলো শরণার্থী সমস্যার সমাধান দিতে। অনুরূপ ভাবে কি শেখ হাসিনা সরকারকে শরনার্থী সমস্যার সমাধান কল্পে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামানোর কোন ছঁক তৈরী করা হয়েছে? তবে আলামত ভালো নয়। এনজিও (ঘড় মড়ড়ফ ড়ৎমধহরুধঃরড়হ) সংস্থা কর্তৃক রোহিঙ্গাঁ ক্যাম্পে দেশীয় তৈরী ধারালো অস্ত্রের যোগানকে ঘোলা চোখে দেখার অবকাশ নাই। এখন সরবরাহ করা হয়েছে ধারালো অন্ত্র। আগামীতে যদি স্বয়ংক্রিয় মারণান্ত্র সরবরাহ করা হয়, তাতে আশ্চর্য্য হবার কিছু থাকবেনা। এই অস্ত্র হাতে নিয়ে যদি শরণার্থী ক্যাম্পের প্রশিক্ষিত ক্যাডাররা নাফ নদী অতিক্রম করে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বা সামরিক বাহিনীর উপর হামলা চালায়, তখনকি মিয়ানসার কর্তৃপক্ষ বসে থাকবে? পাল্টা আক্রমণ চালালে সেই আক্রমণকেতো সালাম দিতে হবে বাংলাদেশকেই। বিপদের আশংকাতো এখানেই। লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।
রোহিঙ্গাঁ শরণার্থী বনাম শাঁখের করাত
