সরওয়ার আহমদ: ৭১ সনে আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার নীল নক্সা এবং ষড়যন্ত্র ছিলো আরও। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালীদেরকে কতদিন দাবিয়ে রাখতে পারবে এ নিয়ে মার্কিন মহল পাক সেনাদের মধ্যে সংশয় ছিলো। ২৫ মার্চের কালো রাত্রে পূর্ববাংলায় “অপারেশন সার্চ লাইট” কার্যকরের আগে পাক-কমান্ডার টিক্কা খান ঘোষণা দিয়েছিলো যে, বাঙ্গাল মল্লুক কে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে শায়েস্তা করা যাবে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধে নেমে পশ্চিমা জেনারেলের দম্ভকে গুড়িয়ে দিয়েছিলো। ক্যান্টনমেন্ট ও জেলা শহর ব্যতিরেকে গোটা দেশেই মুক্তাঞ্চাল সৃষ্টি হয়েছিলো এপ্রিল মাস পর্যন্ত। বাঙ্গালী যোদ্ধাদের হাতে ছিলো সাবেক আমলের অস্ত্র এবং স্বল্পমাত্রার স্বয়ংক্রিয় ভারী অস্ত্র। এমতাবস্থায় হানাদার বাহিনী বহিঃশত্রুর আক্রমণ মোকাবেলার সক্ষমতা নিয়ে জলে, স্থলে এবং আকাশ যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীকে সাময়িকভাবে হঠিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু তাদের শংকা ছিলো, যদি বাঙ্গাঁলী যোদ্ধার হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং আর্টিলারি ক্ষমতা আসে, তাহলে তাদেরকে দমিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হয়ে যায়, তাহলে নব্যস্বাধীন দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে কিভাবে বিপর্যন্ত করতে হবে তার একটি নীল নক্সাও প্রণীত হয়েছিলো আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার নিখুঁত কারুকাজের ভিত্তিতে। ধারণা করা হচ্ছে, এই নীল নক্সা প্রণীত হয়েছিলো আগস্ট মাসেই। কারণ উপমহাদেশে উদ্ভুত পরিস্থিতির আলোকে ৭১ সনের আগস্ট মাসে ভারত, রাশিয়া মৈত্রীচুক্তি সম্পাদিত হয়েছিলো। এই চুক্তির পর পরই মুক্তিবাহিনীর হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র আসতে থাকে এবং হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে গিয়েছিলো। ষড়যন্ত্রী মহলের ধারণা ছিলো, বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হয়ে যায় তাহলে সেখানে আওয়ামীলীগের মতো একটি মহিরুহী সংগঠনকে এদেশীয় পাকিস্তানপন্থী এবং চীনা পন্থীদের দ্বারা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। তাই নীল নক্সা মোতাবেক আওয়ামী বলয় থেকে একটি বিভীষণ পন্থী গ্রুপকে স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগেই ম্যানেজ করা হয়েছিলো আওয়ামীলীগ সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য। অন্যদিকে পাট চা পাতা ও ধানের গোদাম খালি করা সই ব্যাংকগুলো থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থপাচার এবং পরাজয় লগ্নে ব্যাংকের ভোল্ট ভেঙ্গেঁ কারেন্সী নোট পুড়িয়ে ফেলেছিলো। নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে হানাদার বাহিনী যততত্র অস্ত্র ফেলে রেখেছিলো, যাতে এই অস্ত্র দিয়ে হত্যা রাহাজানি ও ডাকাতি সংগঠিত হয়। একই পরিকল্পনায় বুদ্ধিজীবিদেরকেও হত্যা করা হয়েছিলো।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক ও তাদের দেশীয় বশংবদদের পরিকল্পিত নীল নক্সার নীল দংশনে নতুন সরকারকে কি ধরনের বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে তাহা আত্ম বিস্তৃতির ঘেরাটোপে অনেকে ভুলে গেলেও ইতিহাস ভুলে নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ভারতে দুর্ভিক্ষে মরেছে কয়েক লক্ষ মানুষ। যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা মোকাবেলা করতে গিয়ে গ্রেট বৃট্রেন তার উপনিবেশ হারিয়েছে। জার্মানীর অস্থিত্ব বিপন্ন হয়েছিলো। যুদ্ধের ক্ষত মুছতে গিয়ে জাপানকে কড়ায় গন্ডায় মাশুল দিতে হয়েছিলো। একটি দিয়াশালাইর পরিবর্তে রাশিয়াতে নারী পযর্ন্ত বিক্রি হয়েছে। বাংলাদেশে যুদ্ধের ভয়াবহতা কি কমছিলো? বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল ৭১ সনের জুলাই মাসে যশোর ও কুষ্টিয়া শহর পরিদর্শন করে এ দুটি শহরকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অষ্ট্রিয়ার ধ্বংসযঞ্জের সাথে তুলনা করেছিলো। গোটা দেশের অবস্থা ছিলো ততৈবচ। এমনি অবস্থায় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রাপথ ছিলো পিচ্ছিল, বন্ধুর, কণ্ঠকাকীর্ণ ও সমস্যায় ভারাক্রান্ত। তারপর ছিলো জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চক্রের ষড়যন্ত্রজাল। এই ষড়যন্ত্র সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস এবং উচ্ছেদের পথ রচনায় ছিলো নিবেদিত। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবস্থা সঙ্গঁত কারণেই স্বাভাবিক থাকার নয়। এ ক্ষেত্রে হয়তো জরুরী আইন বা সামরিক শাসনের মাধ্যমে দেশকে স্থিতিশীল রাখার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তার সমান্তরাল উদাহরণ ছিলো পাকিস্তান। পূর্বাঞ্চলের পরাজয় নিশ্চিত হবার পর খন্ডিত পাকিস্তানের শাসন ভার নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে সমর্পন করা হয়েছিলো। জুলফিকার আলী ভুঠ্রো তখন ক্ষমতা গ্রহণ করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের ধারাবাহিকতার পাশাপাশি সামরিক শাসনও বহাল রেখেছিলো যুদ্ধ পরবর্তী বাস্তবতাকে ধারণায় রেখে। তৎকালীন বাংলাদেশীয় বাস্তবতার আলোকে অন্তত একটি বছর রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের পাশাপাশি জরুরী শাসনের প্রয়াজন ছিলো। কিন্তু আজীবন সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি অনুরক্ত বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান আমলের সূচনাতে স্বৈরশাসনের কথাটি ধারণায় রেখে বাংলাদেশে মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকার এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের সবকটি জানালা খুলে দিয়েছিলেন। পাকিস্তানী আমলের দুই দশক যেখানে অতিক্রান্ত হয়েছে স্বৈরশাসনের যাতাকলে এবং তারও আগে প্রায় দুই শতাব্দী যেখানে কায়েম ছিলো সীমিত গণতন্ত্র এবং স্বৈরশাসন, সেখানে অবাধ গণতন্ত্র কতটুকু মানানসই হবে সেটি হয়তো ভেবে দেখা হয়নি। ফলে গণতন্ত্র এখানে আর্বিভূত হয়েছিলো ভিন্ন অবয়বে। গণতন্ত্রের সমান্তরালে যদি স্বেচ্ছাতন্ত্র ও ষড়যন্ত্র মাথাছাড়া দেয়, তাহলে গণতন্ত্রের নাদুসনুদুস চেহারা কিভাবে গুটি বসন্ত রোগীর অবয়ব ধারণ করে বাংলাদেশের ১৯৭২-৭৫ চাপ্টার হচ্ছে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
স্বাধীন রাজনৈতিক চর্চা, বাকস্বাধীনতা, সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা, চলা ফেরার স্বাধীনতা, স্বাধীনভাবে সম্পত্তিভোগ সহ ব্যবসা পরিচালনার অধিকার, সভাসমাবেশের অধিকার, ভোটধিকারের প্রয়োগ, নির্বাচিত হবার অধিকার সহ সর্বক্ষেত্রে নিয়মতন্ত্রের অনুশীলনই হচ্ছে গণতন্ত্রের উপজীব্য শর্তাবলী। কিন্তু বাস্তবতা ছিলো বিপরীত। গণতন্ত্রে দলগঠনের অধিকার থাকায় দলগঠন করতে গিয়ে বাংলাদেশের স্থলে দলের নামকরণ করা হলো “পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি”। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামকরণকে অগ্রাহ্য করে বলা হলো মুসলিম বাংলা। গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর ভর করে আওয়াজ উঠলো, আসাম ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গেঁর সমন্বয়ে বৃহত্তর বাংলা কায়েম করার। গণতান্ত্রিক অধিকার ও বাক স্বাধীনতার সুযোগে গর্তে লুকানো পাকিস্তান পন্থীরা তর্জনী উচিয়ে আওয়াজ তুললো-এদেশতো স্বাধীন নয়, ভারতের অঙ্গরাজ্য মাত্র। জাতীয় সঙ্গীতকে বলা হলো হিন্দুর রচিত গান। সমালোচনার নামে মাতালের গালিগালাজ হয়ে উঠলো বক্তৃতার অলংকার। রাজনৈতিক সহনশীলতাকে যদি গণতন্ত্রের স্তম্ভ হিসেবে গণ্য করা হয় তাহলে নব্যস্বাধীন বাংলাদেশে সে সহনশীলতা ছিলো অনুপস্থিত। গণতন্ত্রের ছাতার তলে তখন আশ্রয় নিয়েছিলো স্বৈরতান্ত্রিক ধারার অনুগত শক্তি। বাংলাদেশের বাস্তবতা অস্বীকারকারী মহল এবং চঠকদার শ্লোগান ধারী ইয়াংকি মহল। তাই বিক্ষোভ সমাবেশকে ধাবিত করা হলো হানাহানি, সশস্ত্র ঘেরাও সহ স্যাবাটেজ তৎপরতায়। আওয়ামীলীগের জঠর থেকে বেরিয়ে আসা জাসদ, চৈনিক বলয়ের সিরাজ শিকদার নেতৃত্বাধীন পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি এবং হক-তোয়াহা নেতৃত্বাধীন উগ্রপন্থী দলগুলো গণতন্ত্রের নামে “গানতন্ত্র ”কে বেছে নিয়েছিলো রাজনীতির ছদ্মনামে। অন্যদিকে ৭০ সনে পার্বত্য চট্রগ্রাম থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত মেজর (অব:) রাজা ত্রিদির রায় পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে ৭১ সনে বাঙ্গাঁলীর মুক্তিযুদ্ধের শুধু বিরোধিতা করেননি, গোলাম আযম, নুরুল আমীনসহ মাহমুদ আলীর মতো রাজা ত্রিদির রায় পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিলেন। তার ইন্ধনে শান্তিবাহিনী নামে পার্বত্য চট্রগ্রাম অঞ্চলে বাংলাদেশ বিরোধী সশস্ত্র তৎপরতায় মেতে উঠেছিলো। ফলশ্রুতিতে দেশব্যাপী থানালুট, ব্যাংকলুট, ছিনতাই ডাকাতি, গুপ্তহত্যা, বিদুৎ কেন্দ্র ও পাট গুদামে আগুন, নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং সাবেক গণপরিষদ সদস্য হত্যার নামে এক অরাজক পরিস্থিতি কায়েম করা হয়েছিলো। উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয়েছিলো। কিন্তু পরিস্থিতি মোকাবেলায় যে বাড়াবাড়ি সেটিও গণতন্ত্রের সাথে সঙ্গতিশীল ছিলো না।
গণতন্ত্রে স্বাধীনভাবে ব্যবসা পরিচালনার গ্যারান্টি আছে। কিন্তু ব্যবসায়িক স্বাধীনতার নামে কালোবাজারি মজুতদারী, মুনাফাবাজী ও ক্রাইসিস সৃষ্টিই ছিলো সেই সময়ের রাঘব বোয়াল ব্যবসায়ীদের মূললক্ষ্য। ফলে সমাজ ব্যবস্থায় হতাশা এবং অস্থিরতার ছাপ ছিলো স্পষ্ট। ৭৪ সনের কথিত দুর্ভিক্ষের সময়ও দোকানভর্তি চাল ছিলো কিন্তু মানুষ মরেছে অনাহারে। চাল ক্রয় ক্ষমতা ছিলো না বলেই তাদেরকে মরতে হয়েছে।
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সংবাদপত্র তথা প্রচার মাধ্যমে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে গণ্য করা হয়। এ ক্ষেত্রে সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা অনস্বীকার্য। কিন্তু ৭২ পরবর্তীতে সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের যোগসাজসে কোন পথে ধাবিত হয়েছিলো সেটি এখন গবেষণার বিষয় হতে পারে। সংবাদ পত্রে স্বাধীনতার সুযোগে এক শ্রেনীর সংবাদপত্র ভেষ্টেড লিফলেটে পরিণত হয়েছিলো। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যেখানে যতটুকু বাড়েনি তার চাইতে অধিক উল্লেখ করে দেশব্যাপী কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি সহ অবাধ মুনাফার পথ আবিষ্কার করাই কোন কোনসংবাদ পত্রের মোক্ষ হয়ে উেেঠছিলো। ডাকাতি, লুট, ছিনতাই খুন,এবং লুটপাটের খবরকে তেলমসল্লা সহ পরিবেশন করে এই উপসর্গ কে প্রকারান্তরে উৎসাহিত করা হয়েছিলো। অনাহারে মানুষ ৬ জন মৃত্যুবরণ করলে সেই সংখ্যা উন্নীত হতো ৬০ জনে। মোদ্দকথায়, বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিব এবং তার নেতৃত্বাধীন সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছিলো একশ্রেণীর সংবাদ পত্র। তৎকালে দেশের বহুল প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাক রংপুরের প্রান্তিক জনপদের জেলে কন্যা বাসন্তীর গায়ে কাপড় পরিবর্তন করে মাছ ধরার জাল পরিয়ে সেই ছবি ছেপেঁছিলো। সচিত্র এ সংবাদ দেশীয় চৌহদ্দী অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক ভাবে সদ্যস্বাধীন দেশের ভাবমূর্তিকে বিতর্কিত করে তুলেছিলো। শীর্ষস্থানীয় সরওয়ার আহমদঃ পত্রিকাগুলোতে স্বাধীন মতপ্রকাশের ছদ্মাবরণে আবুল মনসুর আহমদ, আবুল ফজল, আব্দুল হামিদ খান সহ শীর্ষস্থানীয় এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা কারান্তরালে আটক পাকিস্তানপন্থী কোলাবরেটরদের মুক্তির স্বপক্ষে কলাম লিখতে কুণ্ঠিত ছিলেন না। পাকিস্তান না হলে বাংলাদেশের সৃষ্ঠি হতো না বলেও কেউ কেউ মত প্রকাশ করেছিলেন। অথচ রাজনৈতিক বোধজ্ঞান সম্পন্নরা জানেন, জিন্নাহ নেহেরুর কুটচালে “মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনা ব্যর্থ না হলে লাহোর প্রস্তাব অনুসারে পাকিস্তান হিন্দস্থানের পাশাপাশি বাংলাদেশ নামেরও আরেকটি রাষ্ট্রের উদ্ভব হতো। পূর্ব বাংলাকে খন্ডিত অবয়ব নিয়ে পাকিস্তানের কলোনী হয়ে হতো না। মূলত: দুইযুগের পাকিস্তানী শাসনামলে শাসক শ্রেণীর করুণা এবং উচ্ছিষ্ট ভোগী হিসেবে পূর্বাঞ্চলে এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী এবং সাংবাদিক মহলের উদ্ভব ঘটেছিলো, যারা মনে প্রাণে বাংলাদেশের নব উত্থানকে মেনে নিতে পারে নি। তাই বাংলাদেশে গণতন্ত্র এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতাার সুযোগে যখন যেখানে আঘাত হানার প্রয়োজন ততটুকু আঘাত হানতে পিছ পা হয়নি তৎকালীন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম। এই ধারা এখনও অব্যাহত আছে। বঙ্গঁবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ,আওয়ামীলীগাররাই তাদের টার্গেটের লক্ষ্যবস্থ।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বঙ্গঁবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকারকে বিতর্কিত এবং অকার্যকর করার ক্ষেত্রে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের নীল নক্সা হিসেবে প্রশাসনিক দ্বন্ধ, সমন্বয়হীনতা এবং প্রাক পরিকল্পনা ও ভূমিকা রেখেছিলো। ১৯৭১ সনের ১৬ ডিসেম্বর পযর্ন্ত বাঙ্গাঁলী ই.পি.সি.এস. এবং সি.এস.পি অফিসার সহ পুলিশ প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তা এবং নিম্মস্তরের কর্মচারীদের বড় অংশ ছিলো পাকিস্তান পন্থী। মুসলিমলীগ পরিবারের সদস্য এবং পাকিস্তানের প্রতি অনুরক্তির পরীক্ষা উত্তীর্ণদেরেকেই পাকিস্তান আমলে চাকুরীতে নিয়োগ দান করা হতো। এসমস্থ অফিসার এবং কর্মচারীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারে নি। অবশ্য তাদের মধ্যে ব্যতিক্রমও ছিলো। যারা ব্যতিক্রমী ছিলেন তারা বাংলাদেশী বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে ছিলেন। যারা মানতে পারেনি তাদের কারণে প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতা মাথাছাড়া দিয়ে উঠেছিলো। এই সমন্বয়হীনতার পাশাপাশি ছিলো গ্রুপিং। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পযর্ন্ত যারা পূর্বপাকিস্তানে কর্মরত ছিলো সেই রিপেট্র্যয়েটিক আমলা, পাকিস্তান থেকে আগত আমলা এবং মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা কর্মচারীর মধ্যে পদ পদবীর বিন্যাস নিয়ে অমিমাংসিত বিরোধ সদ্যস্বাধীন দেশের প্রশাসনিক স্থবিরতার ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা রেখেছিলো। ১৯৭৪ সনের বড় মাপের খাদ্য ঘাটতি সংকটের পেছনে লাগাতার বন্যা জনিত শস্য হানি যেমনি ছিলো প্রধান কারণ তার পাশাপাশি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাও ছিলো অন্যতম সহায়ক। সে সময়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন বর্তমান বি.এন.পি নেতা ড.আব্দুল মঈন খানের পিতা আব্দুল মোমিন খান। পাকিস্তানপন্থী এই অফিসার খাদ্য সংকটের মাধ্যমে তৎকালীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য কূটকৌশল অবলম্বন করেছিলেন। চাল মজুদের ক্ষেত্রে তথ্য গোপন এবং আমদানী ক্ষেত্রে ধীরে চলা নীতি অবলম্বন করে খাদ্য সঙ্খটকে ঘনীভূত করেছিলেন। জনশ্রুতি আছে, বাংলাদেশ অভিমুখে আগত আমেরিকান চাল বোঝাই জাহাজকে মধ্য পথ থেকে ফিরিয়ে দেয়ার পেছনেও তার ভূমিকা ছিলো। আব্দুল মোমিন খানের মাতা ডা. আব্দুস সাত্তার , মাহবুবুল আলম চাষী সহ আরও কিছু উর্দ্ধতন কর্মকর্তা তৎকালীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য ছিলেন তৎপর। এ ক্ষেত্রে সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তাদের ভূমিকা ছিলো মুদ্রার এপিট-ওপিট সমতুল্য। বিশেষ করে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত সামরিক ও বেসামরিক অফিসারদের ভূমিকা ছিলো প্রণিধানযোগ্য। পাকিস্তানে আটকে পড়া সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তাদেরকে ভুঠ্রো সরকার মগজধোলাই করে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলো। তাদেরকে বুঝানো হয়েছিলো–স্বাধীনতার নামে বাংলাদেশকে মূলত: ভারতের অঙ্গরাজ্য করা হয়েছে। বাংলাদেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় ভারত থেকে। এ ধরণের বহু অপতথ্য গিলিয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনকারীদের মনমানস বিগড়ে দেয়া হয়েছিলো পরিকল্পিতভাবে। ফলে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে অনেকেই উল্টো পথে ধাবিত হয়েছিলো। বাংলাদেশ পট পরিবর্তন ঘটানোর জন্য পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে কাজ করেছিলো। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সামাজিক ভারসাম্যহীনতাও প্রশাসনিক স্থবিরতার পাশাপাশি সামরিক ক্ষেত্রে ও নাড়াছাড়া শুরু করেছিলো। মার্কিন দূতাবাসে সি.আই.এ কর্মকর্তা ফিলিপ চেরীকে নিয়োগ করা হয়েছিলো ষড়যন্ত্রজালকে পোক্ত করার জন্য। একই সাথে চিলিতে সামরিক অভ্যুত্থান ও সেদেশের অবিসংবাদিত নেতা প্রেসিডেন্ট আলেন্দ্রেকে হত্যার সফলরূপকার ডেভিড ইউজিন বোষ্টা কে ৭৫ সনে বাংলাদেশস্থ মার্কিন দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োজিত করা হয়েছিলো একটি অভ্যুত্থানকে তরান্বিত করার লক্ষ্যে। (এই বিতর্কিত কুটনীতিককে সে সময়ে বাংলাদেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশয়হীনভাবে গ্রহণ করার রহস্য উন্মোচিত হয়নি। তার আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশের আজন্ম বৈরী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সফরে এসে মুজিব হত্যার বিষয়টি পাকাপোক্ত করেছিলেন। অন্যদিকে পাকিস্তানের সাথে ১৯৭৪ সনে বাংলাদেশের কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হবার পর এই দেশের গোয়েন্দা সংস্থা আই. এস.আই এ দেশে এসে সরাসরি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পেরেছিলো। জনশ্রুতি আছে, ১৯৭৪ সনে পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুঠ্রো ঢাকায় যে লট বহর নিয়ে এসেছিলেন তার অধিকাংশই ছিলো গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। তার আগে, অথার্ৎ কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হবার আগ পযর্ন্ত বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার ইন্ধন তো ছিলোই। পাকিস্তানে আটকে পড়া ৩৫ হাজার সামরিক জনবল এবং সমপরিমাণ বেসামরিক কর্মকর্তা কর্মচারীকে কিভাবে মগজধোলাই করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিলো সেটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। কূটনৈতিক সম্পর্কের জের ধরে ৭৪/৭৫ সনে পাকিস্তানী জেনারেল এম.আই করিম ও জেনারেল চৌধুরী একাধিকবার ছুঠে এসেছিলেন তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক আহমদের বাসভবনে। তাদের আগমনের উপলক্ষ ছিলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ঘটানো। পাকিস্তানি এই দুই জেনারেল খনদকার মোস্তাক আহমদের বাসভবনে আসা যাওয়া করতেন পূর্বযোগসূত্রতার কারণে। প্রবাসী সরকারের মন্ত্রীত্ব কালেই তার পাকিস্তানী কানেকশনের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গঁবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার পুর্ণগঠিত হলে খন্দকার মোস্তাক আহমদ নবগঠিত সরকারের ক্যাবিনেট মন্ত্রী হন। এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক ষড়যšী¿ মহল ক্যাবিনেটে তাদের একজন আপনজন খুজে পেয়েছিলো। সংসার ভাঙ্গঁতে হলে সংসার ভুক্ত একজন “বিভীষণের ” প্রয়োজন হয়। অনুরূপভাবে সরকার উৎখাত করতে হলে সরকারের মধ্যেই একজন বিভীষণ বা মীরজাফরের গুণাবলী ছিলো বলেই মোস্তাকের প্রতি ভরসা ছিলো ষড়যন্ত্রী মহলের। ১৯৭৪/৭৫ সনে মোস্তাকের গ্রামের বাড়ী, কুমিল্লার বার্ডের ডাকবাংলা এবং গাজীপুরস্থ শাপলা হাই স্কুলে সেনাবহিনীর অভ্যুথান ইচ্ছুক মেজরদের সাথে তার গোপন বৈঠকের বিষয়টি বঙ্গঁবন্ধু হত্যা মামলার একাধিক সাক্ষীদের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে। তবে ১৫ আগস্টের অভ্যুথানের ক্ষেত্রে খন্দকার মোস্তাক মূল নায়ক না খলনায়ক ছিলেন সেটি ইতিহাসই প্রমাণ করবে।
ক্ষমতার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা জনগণকেই মূল উৎস হিসেবে গণ্য করেছেন। বিশেষত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণই মূল ক্ষমতার নিয়ামক। কিন্তু এই উৎস বা নিয়ামক শক্তির সমান্তরালে জোরপূর্বক ক্ষমতার হাতবদলের ক্ষেত্রে বন্দুকের নল শক্তিমান উৎস হিসেবে অস্বীকারের কোন উপায় নেই। বন্দুকধারী তথা সেনাবাহিনীর উদ্যত অস্ত্রের মুখে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে ক্ষমতার রক্তাক্ত পরিবর্তনের নজির আছে। তাই আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ষড়যন্ত্র মহল বাংলাদেশের ক্ষমতার গড় পরিবর্তন তথা ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার জন্য সামরিক উৎসের সন্ধান করেছিলো যথাযথভাবে। এ আলোকে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতাও ছিলো ষড়যন্ত্রকারী মহলের অনুকূলে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সেনাধিনায়ক ছিলেন নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি কর্ণেল (অব.) এম.এ.জি ওসমানী এবং চীপ অব ষ্টাফ ছিলেন অনুরূপ গণপ্রতিনিধি লে: কর্ণেল (অব.) এম.এ.রব। দেশ স্বাধীন হবার পর বাস্তবতার আলোকে ওসমানীকে জেনারেল পদে এবং এম.এ. রবকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে অবসরে দেওয়া হয়। তদস্থলে নতুনভাবে সেনাধিনায়ক এবং উপসেনাধিনায়ক পদে নিয়োগ অপরিহার্য্য হয়ে উঠেছিলো। এ নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদায়ী সেনাধিনায়কের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিলো। তাই জেনারেল ওসমানীর সুপারিশ অনুসারে সিনিওরিটি উপেক্ষো করে জিয়াউর রহমানের স্থলে কর্ণেল শফি উল্লাহকে সেনাধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। মূলত: সেনাধিনায়ক নিয়োগের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিরোধের বীজ বপন করা হয়েছিলো অলক্ষ্যে। এই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে বিষবৃক্ষে পরিণত হতে বেশিদিন দেরি হয়নি। মূলত: মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে“ওয়ার কাউন্সিল” গঠন নিয়ে ওসমানী ও জিয়ার মধ্যে বিরোধের ছায়া পড়েছিলো নতুন সেনাধিনায়ক নিয়োগের বেলায়। নতুন সেনাধিনায়ক হিসেবে জিয়াউর রহমান কে ওসমানী সাহেব মেনে নিতে নারাজ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সূচনা কালে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে প্রদত্ত ভাষণে জিয়া নিজেকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে উল্লেখ করায় জেনারেল ওসমানী জিয়াকে উচ্চাভিলাসী হিসেবেও চিহ্নিত করেছিলেন। এমতাবস্থায় জিয়াকে উপ-অধিনায়কের পদ নিয়ে তুষ্ট থাকতে হয়েছিলো। কিন্তু পদ বঞ্চনা ক্ষোভ তাকে দগ্ধ করেছিলো। এই বঞ্চনা ও ক্ষোভের প্রভাব পড়েছিলো পরবর্তীকালীন সেনা অভ্যুত্থানে।
এখানে প্রাসঙ্গিক যে, স্বাধীনতাউত্তর কালে সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি বোধ প্রচ্ছন্ন হয়ে উঠেছিলো যে, মুক্তিযুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্ট অংশগ্রহণ না করলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। জেনারেল ওসমানীর সেই সময়ের বিভিন্ন বক্তব্য থেকে এই ধারণা পল্লবিত হয়েছিলো। তাই সেনাবাহিনীর এই অবদানের বীপরীতে তাদের প্রত্যাশাও ছিলো অনেক। সাধারণ সৈনিক যেমনতেমন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাঅফিসারের মধ্যে পদ পদবীর ক্ষেত্রে রেষারেষি বা প্রতিদ্বন্দিতা ছিলো। যার ফলশ্র“তিতে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বপ্রদানকারী দুজন সেক্টর কমান্ডার যথাক্রমে মেজর রফিকুল ইসলাম ও কর্ণেল আবু ওসমান চৌধুরী প্রতিক’ল বাস্তবতার আলোকে চাকুরী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছিলেন। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অহমিকায় কোন কোন অফিসার দাম্ভিক এবং উশৃঙ্কল হয়ে উঠেছিলেন। মেজর শরীফুল হক ডালিম, মেজর নূর চেীধুরী, মেজর সুলতান শাহরিয়ার, রশীদ খান, মেজর জিয়াউদ্দিন ও মেজর বজলুল হুদাকে উশৃঙ্খলতার কারণে চাকুরী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিলো। সেনাধিনায়কের পদ থেকে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে অবসরে গিয়ে তদস্থলে জিয়াউর রহমানকে ন্যস্থ করার জন্য কর্ণেল তাহের সি.এন.সি কে চাপ প্রয়োগ করায় তাহেরকেও অবসরে যেতে বাধ্য করা হয়েছিলো। এসমস্থ অব্যাহতিপ্রাপ্ত অফিসারদেরকে উপ-অধিনায়ক জিয়াউর রহমান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছিলেন। ক্যান্টনমেন্টের টেনিসকোর্টে খেলায় অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন অফিসারদের বাসায় গোপন বৈঠকসহ নানাবিধ অপতৎপরতা তাদের অব্যাহত ছিলো। এ ব্যাপারে প্রশ্নের মুখোমুখি হলে অব্যাহতি প্রাপ্তরা উপ-অধিনায়ক জিয়াউর রহমানের নাম ভাঙ্গাতো। সেনাবাহিনীর উপ-অধিনায়ক হিসেবে বাহিনীর উন্নয়ন সংক্রান্ত যাবতীয় প্রক্রিয়া এবং দাবি দাওয়া আদায়ের দায়িত্ব ছিলো জিয়াউর রহমানের উপর। কিন্তু সেনাবাহিনীর মধ্যে বঞ্চনার বিষবাষ্প উল্কে দেওয়ার জন্য যথাসময়ে যথাযথ তৎপরতা এবং পরিকল্পনা প্রণয়ণে তার নিষ্ক্রিয়তা ছিলো প্রণিধানযোগ্য। এছাড়া সেনাবাহিনীর সমান্তরালে সেই সময়ে রক্ষীবাহিনীর উপস্থিতি ও তৎপরতা ছিলো সেনা মানসে অসন্তোষ তৈরীর অন্যতম ক্ষেত্র। সেনা বাহিনীর মধ্যে এমন একটি ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো যে, সরকার সেনাবাহিনীর চাইতে রক্ষীবাহিনীকে অধিকতর গুরুত্ব দিচ্ছে এবং সে অনুসারে সুযোগ সুবিধাও নিশ্চিত করা হচ্ছে। রক্ষীবাহিনীর পোষাককে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উর্দ্দির রং দেওয়া হয়েছে বলেও গুজব রটানো হচ্ছিলো। তার পাশাপাশি পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত সেনাবাহিনীর মধ্যে পদ পদবী এবং সুযোগ সুবিধা নিয়ে অন্তরালে দ্বন্ধ সৃষ্টি করা হয়েছিলো কৌশলে। অর্থাৎ একটি বিদ্রোহ বা অভ্যুথান সৃষ্টির ক্ষেত্রে যে সমস্ত উপাদানের প্রয়োজন ছিলো ততটুকু সম্পন্ন করা হয়েছিলো বঙ্গঁবন্ধু হত্যা এবং তার সরকার উচ্ছেদ কল্পে।
সপরিবারে বঙ্গঁবন্ধু হত্যা এবং তার সরকার উচ্ছেদের ছক অঙ্কন ৭২ সন থেকেই যে শুরু হয়েছিলো সে ব্যাপারে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তার পূর্ণাঙ্গ রূপায়নের পরিকল্পনা গতি পায় ১৯৭৫ সনের সূচনা থেকেই। বিদ্যমান শাসন পদ্ধতি ও রাজনৈতিক ধারা পরিবর্তনের লক্ষ্যে বঙ্গঁবন্ধু কতৃক বাকশাল গঠনের পর থেকেই ষড়যষ্ঠী মহল সরকার উচ্ছেদের ব্যাপারে অধিকতর তৎপর হয়ে উঠেছিলো। সরকার উচ্ছেদের ষড়যন্ত্রে প্রশাসনিক কিছু পদক্ষেপও ঘৃতাহুতি সমতুল্য ছিলো। তন্মেধ্য অন্যতম হচ্ছে দ্বিতীয় মেয়াদে সেনাধিনায়ক হিসেবে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে পুন:নিয়োগ। এই নিয়োগকে উপ-অধিনায়ক জিয়াউর রহমান বরদাস্ত করতে পারছিলেন না। প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অন্যদিকে সরকারও শফিউল্লাহর পুণ:নিয়োগ প্রত্যাহার অটল। এমতাবস্থায় জিয়াউর রহমানকে সেপ্টোম্বর মাসে অব্যাহতি দিয়ে বিদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্তও হয়েছিলো বলে তৎকালীন প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছিলেন। এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে জিয়াউর রহমানও অবহিত ছিলেন। সুতরাং সেপ্টোম্বরের আগেই যা কিছু করার তা করতে হবে এমন পরিকল্পনা নিয়েই তিনি অগ্রসর হয়েছিলেন। তার প্রমাণ মিলে বঙ্গঁবন্ধু হত্যা মামলার অন্যতম আসামী তাহের উদ্দিন ঠাকুরের জবানবন্দিতে (বঙ্গঁবন্ধু হত্যা মামলার ঐতিহাসিক রায় রবীন্দ্রনাথ এীবেদী, পৃষ্টা নং, ১০৮/১০৯) । জবানবন্দির মমার্থ নিম্মরূপ -১৪ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে তৎকালীন তথ্যপ্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর বাণিজ্য মন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক আহমদের সচিবালয়ের কার্যালয়ে পূর্ব নির্ধারিত সাক্ষাতের জন্য গেলে মোস্তাক তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে জানান, এ সপ্তাহে ব্রিগেডিয়ার জিয়া তার সাথে দুবার দেখা করেছেন। জিয়া এবং তার লোকেরা তাড়াতাড়ি কিছু একটা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন। ক্ষমতা বদলের জন্য তারা যেকোন কাজ করতে প্রস্তুত। মোস্তাক এ ব্যাপারে তার মতামত দিয়েছেন। এছাড়া কোন উপায় নেই। মোস্তাক তাহের উদ্দিন টাকুরকে ঢাকার বাইরে যেতে বারণ করেন এবং তার ডাকের জন্য অপেক্ষা করতে বলেন। বলা বাহুল্য, এ ডাক ২৪ ঘন্টার মধ্যেই এসেছিলো। তাহের উদ্দিন টাকুরের সাক্ষানুসারে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, সপরিবারে বঙ্গঁবন্ধু হত্যা এবং সরকার উচ্ছেদের ব্যাপারে বহিস্কৃত এবং কর্মরত মেজর চক্রই শুধু দায়ী নয়, তাদের সাথে উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের কেউ কেউ পরোক্ষভাবে জড়িত। ১৯৭৫ সনের জুন মাসে গাজীপুরের শাপলা হাইস্কুলে ঢাকা বিভাগীয় স্বনির্ভর সম্মেলনে উপস্থিত খন্দকার মোস্তাক আহমদের সাথে মেজর ফারুক, মেজর নূর, ও মেজর সুলতান শাহরিয়ার বৈঠক করতে গেলে খন্দকার মোস্তাক তাদেরকে প্রশ্ন করেছিলেন- তোমাদের আন্দোলনের খবর কী? তখন তারা বলেছিলো-বস সব কিছুর ব্যবস্থা করছেন। আমরা তাহার প্রতিনিধি। এই বস যে জিয়াউর রহমান ছিলেন সেটি পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে। জিয়ার সাথে আরও পদস্থ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ের বিষয়টিকে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। এখানে প্রাসঙ্গিক যে, ১৯৭৫ সনে সামরিক বাহিনীর নৈশকালীন মহড়ার সময় ছিলো অক্টোবর নভেম্বর মাসে। এই মহড়াকে জুলাই আগস্টে এগিয়ে আনা হয়েছিলো পরিকল্পনা বা ছক অনুসারে। লক্ষ্য ছিলো অভ্যুত্থানের। এই নৈশ প্যারেডকে এগিয়ে আনার জন্য অবশ্যই উর্দ্ধতন কোন সামরিক বসের যোগসাজস ছিলো। অন্যদিকে ১৫ আগস্টের যে অপারেশনাল ছক তৈরী করা হয়েছিলো সে ছক অঙ্কনের ক্ষেত্রে মেজর চক্রের সাথে উর্দ্ধতন কতৃপক্ষের কৌশলী হাতের ছোয়া যে ছিলো, তাহা অস্বীকার করা যাবে না। ছক অঙ্কনে সামান্য হেরফের হলে অভ্যুত্থান পরিকল্পনাটাই ভেস্তে যেতো। এমতাবস্থায় ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনকে সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত না করে সেনাবাহিনীর কিছু বহিস্কৃত মেজর এবং কর্মরত বিভ্রান্ত মেজর ক্যাপ্টেনদের পরিচালিত খন্ডিত অভিযান হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু এই খন্ডিত অভিযানের নেপথ্যে সেনাবাহিনীর উর্দ্ধতন একটি মহলের মৌন সমর্থন না থাকলে অভিযানের সফলতা বা লক্ষ্য অর্জন কোন ভাবেই সম্বব হতো না। এক্ষেত্রে বঙ্গঁবন্ধু হত্যা মামলার সেশন কোর্টের রায়ে বিজ্ঞ আদালতের মন্তব্যটি তাৎপর্যপূর্ণ। রায়ে উল্লেখ আছে,“ এই মামলায় প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ইহা প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ যাহারা ঢাকায় অবস্থান করিতেছিলেন তাহারা তাহাদের দায়িত্ব পালন করেন নাই, যথেষ্ট সময় পাওয়া সত্ত্বে ও। ইহা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, বঙ্গঁবন্ধুর টেলিফোনে আদেশ পাওয়ার পরও তাহার নিরাপত্তার জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নাই। সাক্ষী প্রমাণে ইহা পরিষ্কার যে, মাত্র দুটি রেজিমেন্টের খুবই অল্পসংখ্যক অফিসার ও সদস্য এই হত্যাকান্ডে জড়িত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেন এই কতিপয় সেনা সদস্যকে নিয়ন্ত্রণ। নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে নাই তাহা বোধগম্য নয়। ইহা আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সেনাবাহিনীর জন্য একটি চিরস্থায়ী কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত হইয়া থাকিবে (রবীন্দ্র নাথ ত্রিবেদী কতৃক প্রকাশিত বঙ্গঁবন্ধু হত্যা মামলার রায় পৃষ্টা নং (১২৬)। বিজ্ঞ বিচারকের উপরোক্ত মূল্যায়ণের মধ্যে বোধগম্য নয় শব্দটির প্রয়োগও যথাযথ। তবে যাহা বোধগম্য নয়, সময়ের ফাঁক গলিয়ে চর্বিত চর্বণ এবং অনুসন্ধিৎসার আলোকে এক সময় বোধগম্য নয় জনিত বিষয়টিও সহজবোধ্য হয়ে উঠে। বঙ্গঁবন্ধু হত্যা এবং পট পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যোগসাজসই প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়। ইঞ্জিনে যদি পরিকল্পিতভাবে ত্রুটি ধরানো হয় তাহলে শত চেষ্টাতেও সেই ইঞ্জিন চালু করা যায় না। ঘটনার ক্ষেত্রে ও তদ্রুপ ঘটে। ১৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটে ঢাকার সেনা ছাউনীতে “যোগসাজস” নামক ভাইরাস সক্রিয় থাকায় গোটা সত্ত্বাটি নির্জীব বা এলোমেলো হয়ে পড়েছিলো।
শুধু ১৫ আগস্ট কেনো, তার আগ থেকেই সেনাবাহিনীতে এলোমেলো অবস্থান ও কিছু একটা যে ঘটছে তাহা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো। ১৫ আগস্টকে সামনে রেখে কুমিল্লার বার্ডে, খন্দকার মোস্তাক আহমদের গ্রামের বাড়ী ও ঢাকাস্থ তার আগামসি লেনের বাসা, গাজীপুরের শাপলা স্কুল ছাড়াও ঢাকা সেনানিবাস্থ মেজর রশীদ ও মেজর সুলতান শাহরিয়ার রশীদের বাসায় অভ্যুত্থান ইচ্ছুক মেজর চক্রের গোপন বৈঠকের ব্যাপারে সামরিক গোয়েন্দা কি অবগত ছিলো না? চাকুরীচ্যুত সেনা অফিসাররা ক্যান্টনমেন্ট এরিয়াতে কিভাবে তৎপরতা চালিয়েছিলো সেটিতো বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষীদের জবানবন্দীতে উঠে এসেছে। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডি.জি.এফ.আই এর রহস্যময়তার কিছুটা বর্ণনা উঠে এসেছে লে: কর্ণেল (অব:) এম.এ হামিদের লিখিত বইয়ে। তা হচ্ছে নিম্মরূপ “মধ্যরাত অভ্যুত্থান ঘটতে যাচ্ছে মারফতে এরকম একটি আভাস জানতে পারেন ডি.জি.এফ.আই এর ব্রিগেডিয়ার রউফ, রাত অনুমান ২/৩ টার দিকে। কিন্তু কাউকে জানান নি। অজানা আশংকায় তিনি তৎক্ষণাৎ তার বাসা ত্যাগ করে পরিবার নিয়ে বাসার পেছনের মাঠে একটি গাছের নীচে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করেন। সকালে বেরিয়ে এসে ব্যর্থতা ঢাকতে অসংকল্প গল্পের অবতারণা করেন। অথচ সময় মতো সংশ্লিষ্ঠ সবাইকে সংবাদ দিলে খুব ভোরেই ঈড়ঁহঃবৎ ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হতো। গোয়েন্দা প্রধান নিশ্চিতভাবে ভোর ৫ টার আগেই আক্রমণের খবর পান। তিনি তখনও যদি সরাসরি রাষ্ট্রপ্রধানকে রেড টেলিফোনে কথা বলে শুধু সাবধান করে দিতেন তাহলে তার (বঙ্গঁবন্ধু) বেচেঁ যাওয়ার ৮০% সম্ভাবনা ছিলো)। তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা পৃষ্টা নং ৭৪)।
অন্যদিকে ১৫ আগস্টের প্রত্যুষে সেনা সদর দপ্তর ছিলো নাটকীয়তায় ভরপুর। ভোর ৫-৩০ মিনিটে সেনা গোয়েন্দা প্রধানের নিকট থেকে সেনা প্রধান শফিউল্লাহ খবর পান যে, রাষ্ট্রপ্রতির বাসভবন আক্রান্ত হয়েছে। শফিউল্লাহ তখনই ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়ত জামিলকে ফোনে সেনা মুভ করার নির্দেশ দেন। শ্ফাায়াত জামিল সেনাপতির এ নির্দেশ পেয়ে হেটে হেটে ডেপুটি চীফ জিয়াউর রহমানের বাসায় যান। জিয়াউর রহমান কি নির্র্দেশ দিয়েছিলেন সেটি প্রকাশিত না হলেও সেনাধিনায়কের নির্দেশে শাফায়াত জামিলের কমান্ডভুক্ত ৪৬ ব্রিগেড মুভের পরিবর্তে ছিলো নির্বিকার। তার পেছনে অন্য কারণও ছিলো। ৪৬ ব্রিগেডভুক্ত দুটি উশৃঙ্কল ইউনিট রাষ্ট্রপ্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে হামলা চালিয়েছিলো। ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিল কমান্ডার হিসেবে পূর্ব অবহিত থাকলে ভিন্ন কথা। অবহিত না থাকলে বিদ্রোহী ট্রুপকে নিয়ন্ত্রেণে আনা ছিলো তাৎক্ষণিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে বিরত থাকাটা ঘটনার সাথে সংযুক্তির আভাস দেয়। নতুবা উপধিনায়ক জিয়াউর রহমানের পরোক্ষ নিষেধের কারণে তিনি রহস্যজনকভাবে ব্রিগেডকে মুভ করাতে বিরত থেকে ছিলেন। জিয়াউর রহমান যে কাউন্টার এ্যাটাকের ব্যাপারে অন্যতম অন্তরায় ছিলেন তাহা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো তখনই। শাফায়েত জামিল যখন ৪৬ ব্রিগেডকে সক্রিয় করতে টালবাহানা শুরুর করেন তখন সেনা প্রধান শফিউল্লাহ সি.জি.এস খালেদ মোশারফকে নির্দেশ দেন ৪৬ ব্রিগেডকে সক্রিয় করার জন্য। তখন উপধিনায়ক জিয়াউর রহমান সেনাধিনাযকের নির্দেশের বিরোধিতা করে ভারতীয় জুজুর ভয় টেনে আনেন। বলেন, ভারত আক্রমণ করতে পারে। সুতরাং সেদিক মোকাবেলারই ব্যবস্থা নিতে হবে। ফলে পরিস্থিতি মোকাবেলায় একপ্রকার ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ সেনা প্রধান শফিউল্লাহ ব্যতীত উপধিনায়ক জিয়াউর রহমান, সি.জি.এস. খালেদ মোশারফ এবং এবং ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়েত জামিল তখন এক মেরুতে এবং শফিউল্লাহ ছিলেন অন্য মেরুর অসহায় অবস্থানকারী। ইত্যবসরে সেনা সদরে আর্বিভাব ঘটে সেনাবাহিনী থেকে বহিস্কৃত এবং অভ্যুত্থান সহযোগী মেজর ডালিমের। ডালিমের এক হুঙ্কারে মেজর জেনারেল ও ব্রিগেডিয়াররা নুয়ে পড়লেন। সেনাবাহিসীর নিয়মানুসারে অধ:স্তনরা পরিচালিত হন উর্দ্ধতনের কমান্ডে। কিন্তু এখানে ধরলো ব্যতিক্রম। বহিস্কৃত মেজর ডালিম এবং কর্তব্যরত মেজর রশীদের নির্দেশকে শিরোধার্য করে সেনাবাহিনী প্রধান, বিমান বাহিনী প্রধান এবং নৌবাহিনী প্রধান সহ উর্দ্ধতন অফিসার সেনা সদর থেকে রওয়ানা হলেন রেডিও ষ্টেশন অভিমুখে। পেছনে পেছনে থাকলো উশৃঙ্কল দুষ্ট মেজরের কমান্ড। এই দৃশ্যপটকে শিয়াল কতৃক সিংহ দলকে তাড়িয়ে নেওয়ার মতোই প্রতীয়মান হচ্ছিলো। রেডিও স্টেশনে গিয়ে তিন বাহিনী প্রধান তোতা পাখির মতো অপর হস্তের লিখিত আনুগত্য পত্র পাঠ করলেন। সেই আনুগত্য ছিলো উশৃঙ্কল সেনা চক্রের দ্বারা ঘোষিত প্রেসিডেন্টের প্রতি এবং তাদের অপকর্মের সিদ্ধতা দেওয়ার জন্য। বোধহয় একারণেই বঙ্গঁবন্ধু হত্যা মামলার সেশন জোট জজকোর্টের বিচারক যথার্থ ভাবেই বলেছেন,“ইহা আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সেনাবাহিনীর জন্য একটি চিরস্থায়ী কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত হইয়া থাকিবে”। সপরিবারে বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বাসভবনে নিহত হবার পর সেনা সদরে যে নাটকীয়তা জমে উঠেছিলো, সেই নাটকের কুশীলব যারা ছিলেন, তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী এবং বীরোত্তম ও বীরশ্রেষ্ট খেতাবধারী। মুক্তিযুদ্ধকালে তারা বিরূপ প্রতিকূলতা সাহস ও বীরত্বের সাথে মোকাবেলা করেছেনে। কিন্তু উপস্থিত প্রেক্ষাপটে সেই সাহস ও বীরত্ব নুয়ে পড়েছিলো। দু’টি রেজিমেন্টের উশৃঙ্কলতাও দাপাদাপির নিকট গোটা সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, রক্ষীবাহিনী, বিডিআর বাহিনীর তেজস্বীয়তা কিভাবে উবে গিয়েছিলো? সেনাবাহিনীর প্রথম আদর্শ হচ্ছে শৃঙ্কলাবোধ। যেহেতু ৪৬ ব্রিগেডের দুটি ইউনিট শৃঙ্খলা বোধে জলাঞ্জলি দিয়ে বিদ্রোহী অবস্থায় লঙ্কাকান্ড করেছে, সেহেতু তাদেরকে শৃঙ্খলার বন্ধনে আবদ্ধ করা জরুরী ছিলো। ৪৬ ব্রিগেডের ৪ হাজার সৈন্যের মধ্যে ৭/৮’শ জন বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলো কয়েকজন অফিসারের নেতৃত্বে। এই দুই ইউনিটকে অবশিষ্ট ইউনিট দ্বারাই নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব হতো। প্রয়োজন সাপেক্ষে সাভার এবং শেরেবাংলা নগরে অবস্থাকারী ইউনিটগুলোকে সক্রিয় করে তাদেরকে ঘেরাও করা যেতো। অন্যদিকে বিমান বাহিনীর সহযোগীতা নিয়ে আকাশ আক্রমণের পন্থা অবলম্বন ও সম্ভব ছিলো। অমনিতেই বিদ্রোহী ইউনিট তাদের কৃতদুষ্কর্মের জন্য মানসিকভাবে ভীত ও সন্ত্রস্থ ছিলো। এমতাবস্থায় কাউন্টার এ্যাটাকের মুখে প্রতিরোধের চাইতে পালানোর পন্থা অবলম্বন ছাড়া গত্যন্তর ছিলো না। এমন নজির সৃষ্টি হয়েছিলো পরবর্তীকালে। ৮১ সনে চট্রগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে নিজ অবস্থান সংহত করে জেনারেল মঞ্জুর অভ্যুথান ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষীগত করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু কুমিল্লা সহ অপরাপর সেনানিবাস থেকে সেনা বাহিনী যখন চট্রগ্রাম অভিমুখে মুভ করেছিলো তখন চট্রগ্রাম সেনা নিবাসে ত্রাহি ত্রাহি ডাক পড়েছিলো। বজ্রআটুনী তখন অমনিতেই শিথিল হওয়া শুরু করে। অনেক সৈনিক এবং অফিসার সেনানিবাস ছেড়ে সাক্ষাত পালাতে শুরু করেছিলো। যারা অবস্থান করছিলো, তারা মঞ্জুরের আনুগত্য অগ্রাহ্য করে বিদ্রাহী হয়ে উঠেছিলো। অত:পর ধৃত মঞ্জুর তারই অনুগত এক ক্যাপ্টেনের গুলিতে ধরাশায়ী হয়েছিলেন। ৭৫ সনের ১৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটে এমন বাস্তবতা অসম্বব কিছু ছিলো না। বিভ্রান্ত দুটি ইউনিটকে দমনের লক্ষ্যে নিদিষ্ট পয়েন্টগুলোতে কাউন্টার এ্যাটার্ক এবং অরুদ্ধকরণের পন্থা অবলম্বন করা হলে, প্রতিরোধের পরিবর্তে পালানোর পথই বেছে নিতো বিদ্রোহীরা। এক্ষেত্রে প্ররোচনা প্রদানকারী অফিসারদের বড় অংশ পক্ষত্যাগকারীদের নিশানার ও শিকার হতেন।
উল্লেখিত যুক্তির বীপরীতে সে সময়ে পাল্টা যুক্তিটা বড় হয়ে উঠেছিলো। যুক্তিটি ছিলো- বিদ্রোহ দমন বা কাউন্টার এ্যাটাকে শহরে লোক ক্ষয় হবে। কিন্তু ঢাকাবাসীতো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখী পরবর্তীতেও হয়েছিলো বিমান বাহিনীর কথিত বিদ্রোহের সময়। তাছাড়া ৭১ সনের ২৫ মার্চের কালোরাতে সর্বব্যাপী অভিযানের মুখেও তো মানুষ “ কালরাত্রি” অতিক্রম করেছিলো। স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে যদি ৩০ লক্ষ মানুষ মৃত্যু বরণ করতে পারে, তাহলে স্বাধীনতাকে সংহতকরণ এবং রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে আরও ৫/১০ হাজার মানুষ মরে যাওয়াটা তেমন ক্ষতিকর ছিলো না। তবুওতো কলঙ্ক তিলক এবং শৃঙ্খলাবোধের ঘাটতি থেকে জাতি নিস্কৃতি পেতো। এখানে প্রাসঙ্গিক যে, সেই মুহূর্তে একটি বোধ প্রচ্ছন্ন হয়ে উঠেছিলো যে বঙ্গবন্ধুকে যখন রক্ষা করা গেলো না, তখন আর বাড়াবাড়ি করে লাভ কী। এই ধারণা বা বোধ টিকে ফলাও করা হয়েছিলো অপশক্তিকে জায়েজ করার একটি কৌশল মাত্র। এবং এই কৌশলের জয় হয়েছিলো পরবর্তীতে। এখানে প্রাসঙ্গিক যে, ঘাতকের নিক্ষিপ্ত গুলিতে বঙ্গবন্ধু নিহত হবার সংবাদটি জানানোর জন্য একজন পদস্থ সামরিক অফিসার উপ-অধিনায়ক জিয়াউর রহমানের বাসাতে যখন প্রবেশ করেন, তখন জিয়া মুখসেভ করেছিলেন। খবরটি জানার পর ভাবলেশহীনভাবে তার জবাব দিয়েছিলেন- So what, president is dead, vice president is there to uphold the constitution জিয়ার এই উক্তিটি স্ব:স্ফর্ত না নাটকীয় ডায়লগ ছিলো, তার আলামত স্পষ্ট হয়েছিলো পরবর্তী আধা ঘন্টার মধ্যে। বঙ্গঁবন্ধু নিহত হবার পর উপ-অধিনায়ক জিয়াউর রহমান ও সি.জি.এস. খালেদ মোশারফকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন সেনাধিনায়ক শফিউল্লাহ। রাষ্ট্রপ্রতি নিহত হবার পর সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে সেনাধিনায়ক কাউন্টার এ্যাটাকের মাধ্যমে ঘাতক ও বিদ্রোহীদেরকে দমনের লক্ষ্যে সি.জি.এস. খালেদ মোশারফকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু উপ-অধিনায়ক জিয়াউর রহমান কৌশল অবলম্বন করে সেনাধিনায়কের এ নির্দেশের বিরোধিতা কিভাবে করেছিলেন, সেটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। খালেদ মোশারফ নির্দেশের বিরোধীতা না করলেও খোড়া অজুহাতে ৪৬ ব্রিগেডকে সক্রিয়করণে গড়িমসি করেছিলেন। অন্যদিকে ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলতো আগে থেকেই ব্রিগেডকে সক্রিয় করার ক্ষেত্রে রহস্যময় ভূমিকা পালন করেছিলেন। এমতাবস্থায় বিদ্রোহ দমন এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা সংরক্ষণের প্রশ্নটি অবান্তর হয়ে পড়েছিলো। সুতরাং রাষ্ট্রপ্রতির অবর্তমানে উপরাষ্ট্রপ্রতির ক্ষমতা গ্রহণ চাপা পড়ে গিয়েছিলো ষড়যন্ত্র উদ্ভুত নাটকীয়তায়। তাই খল তথা শিখন্ডি রাষ্ট্রপ্রতির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শণে রেডিও স্টেশনে ছুটে গিয়েছিলেন সেনানেতৃত্ববর্গ। কারণ ক্ষমতার মঞ্চে যখন শক্তির নাটক শুরু হয়, তখন এক দৃশ্যের পরিবর্তে আরেক দৃশ্যপট যে থাকে, প্রতীভাধর জেনারেলদের ধারণায় সেটি অবশ্যই ছিলো। তাই ক্ষমতার হিস্যা লাভে সবাই ছিলেন সহমতের ধারক।
১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক পরিবর্তন সংগঠিত হবার সাথে সাথেই সেনাধিনায়ক শফিউল্লাহ বুঝে নিতে পেরেছিলেন যে তার পদবীর আয়ুকাল শেষ। কিন্তু উপ-অধিনায়ক জিয়াউর রহমান এবং সি.জি.এস. খালেদ মোশারফের এমনটি ভাবার অবকাশ ছিলো না। জিয়াউর রহমানের তখন মাহেন্দ্রক্ষণ। অভিলাষ পূরণের সিড়ি তার পদতলে অপেক্ষামান। তারই প্রশ্রয় এবং আর্শীবাদপুষ্ট মেজর ডালিম, মেজর নূর, মেজর হুদা, মেজর শাহরিয়ার কিংবা পট পরিবর্তনের অন্যতম নায়ক। অন্যদিকে খালেদ মোশারফের পদতলের ভিত ও শক্ত। পারিবারিক সম্পর্কে অভ্যুত্থানের নায়ক মেজর সৈয়দ ফারুকুর রহমান খালেদ মোশারফের ভাগিনা। এজন্য সেনাবাহিনীতে তার দাপটও ছিলো। মেজর ফারুক মুক্তিযদ্ধের অন্তিমলগ্মে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কোন অভিসন্ধিতে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন, সেটি অস্পষ্ট ছিলো। প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারকে দুই বছরের সিনিওরিটি দেওয়া হলেও ফারুককে এই সিনিওরিটর সুযোগ দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে খালেদ মোশাররফ অনেক দেন দরবারও করেছিলেন। ১৫ আগস্টে গোলা বিহীন ট্যাংক মাঠে নামিয়ে বাজিমাৎকারী ফারুককে ১৫ আগস্ট দুপুরে ট্যাংকের গোলা সরবরাহ করেছিলেন খালেদ মোশাররফ। জয়দেবপুরে অবস্থিত ১৬ বেঙ্গঁল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর শাহজাহানের মাধ্যমে ডিপো থেকে গোলা সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছিলো। গোলা পেয়ে ফারুক আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন। অভ্যুত্থানের অপর নায়ক মেজর রশীদ ৭৫ সনের মার্চ মাসে গানারী কোর্স শেষ করে ঢাকায় ফিরলে তাকে যশোরের আর্টিলারী স্কুলে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো। ১৫ আগস্টের পরিকল্পনা মাথায় রেখে ফারুক খালেদ মোশাররফকে ধরে মেজর রশীদকে ঢাকাস্থ টু-ফিল্ড রেজিমেন্টে বদলি করে এনেছিলেন। ১৫ আগস্টের উদ্ভুত পরিস্থিতি সামাল দিতে খালেদ মোশাররফই মুখ্য ভূমিকায় নেমেছিলেন। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটকে সুনিয়ন্ত্রিত করার পাশাপাশি খালেদ মোশারফ সাভারে অবস্থানকারী রক্ষা বাহিনী যাতে মুভ করতে না পারে, এজন্য এয়ার ফোর্সের সাথে কথা বলে দুিট ফাইটার জোট পাঠিয়ে Shwo of force এর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। একই সাথে ফ্লায়িং ক্লাবের সাথে যোগাযোগ করে মেজর আসমা আমিন (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) ও ক্যাপ্টেন মুনিরকে গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারী মেজর চক্রের অন্যতম সহযোগী মেজর সুলতান শাহরিয়ার খান কতৃক আদালতে প্রদত্ত বিবৃতিতে উল্লেখ আছে যে, ১৯৭৪ সনে চাকুরী থেকে পদত্যাগের পর ১৯৭৫ সনের ১৪ আগস্ট তারিখে সি.জি.এস বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তাকে চাকুরীতে যোগদানের আহব্বান জানান (বঙ্গঁবন্ধুর হত্যা মামলার রায় –পৃষ্ঠা ৩২) । বিবৃতি যদি সত্য হয় তাহলে এখানেও প্রশ্নবোধক চিহ্ন আছে। উল্লেখিত বাস্তবতার আলোকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হবার কথা যে, সি.জি.এস খালেদ মোশাররফও ১৫ আগস্টের পরিবর্তনের পক্ষে ছিলেন। পরিবর্তনজনিত উর্দ্ধারোহণের সুযোগ তিনিও হাতছাড়া করতে রাজি ছিলেন না। উপ-সেনাধিনায়ক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজস্বার্থ এবং উচ্চভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য যে পথ খুঁজছিলেন সেটিতো স্পষ্টই ছিলো। আর্মি ইনটেলিজেনসের একজন ঝানু অফিসার হিসাবে জিয়াউর রহমান ছিলেন অসীম প্রতীভাসম্পন্ন এবং দূরদর্শী। সরকার পরিবর্তন এবং নিজের অবস্থান সংহত করার লক্ষ্যে তিনি হয়েছিলেন দ্বৈরথী। সেনাবাহিনীতে কর্মরত এবং বিদ্রোহ মনস্ক অফিসারদেরকে শনাক্ত করে তাদের এক মোহনায় টেনে আনেন নি। মেজর ফারুক, মেজর রশীদ, মেজর নূর, মেজর হুদা গংরা যারা ডানপন্থী ভাবানুরক্ত, তাদেরকে অন্য পক্ষভুক্ত রেখে সমাজতান্ত্রিক ভাব ধারার অনুসারী কর্ণেল তাহের, মেজর জিয়াউদ্দিন, গংদের কে আলাদা একটি প্লাটফর্মে রেখে জিয়া তার অভীষ্ট গন্তব্য অভিমুখে ধাবিত হয়েছিলেন। একটি গ্রুপের মাধ্যমে যদি মোক্ষ হাসিল সম্ভব না হয় তাহলে অন্য গ্রুপকে যথাসময়ে কাজে লাগানো যাবে। তার এই ফর্মুলা ছিলো যথাযথ। ১৫ আগস্টের সেনা অভ্যুত্থান তাকে সেনাঅধিনায়কের পদে অধিষ্টিত করেছিলো ঠিকই। কিন্তু লক্ষ্যে পৌছার পথ তখনও বাকী ছিলো। তন্মেধ্যে শিখন্ডি প্রেসিডেন্ট মোস্তাক এবং তার ডিফেন্স এডভাইজার জেনারেল ওসমানী মিলে আরেক ঘুঁটি চালে মেতে উঠেছিলেন। তারা জিয়াকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তাই জিয়ার পদের উপরে আরেক পদসৃষ্টি করে বি.ডি আর প্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে চীফ অব ডিফেন্স স্টাফ পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। জিয়ার জন্য এটি বজ্রাঘাত তুল্য মনে হলেও সেটিকে তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করেছিলেন স্বাভাবিকতার ছদ্মাবরণে। এসময় সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড সঙ্কট চলছিলো। বঙ্গঁভবনকে কব্জায় এনে মেজর ফারুক, মেজর রশীদ ও মেজর ডালিমকে যাবতীয় দন্ডমন্ডুর অধিকারী হয়ে বসেছিলো। এই উশৃঙ্কল চক্রকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্য সেনা অফিসারদের পক্ষে সেনাধিনায়ক জিয়াউর রহমানের উপর চাপ ছিলো। জিয়া তখন বলতেন,wait and see একথা বলে তিনি আভাসে ইঙ্গিতে এটাই বুঝাতে চাচ্ছিলেন যে,- এই খেলাই শেষ নয়, সামনে আরও খেলা আছে। আড়াই মাসের মাথায় সেই খেলা শুরু হয়েছিলো নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। তার আগেই আড়াই মাস সময়ে কর্ণেল তাহের তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ভিতকে মজবুত করতে পেরেছিলেন।
১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের জের ধরে নভেম্বরে সূচিত হলো পাল্টা অভ্যুত্থান। অভ্যুত্থানের নায়ক হলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ এবং তার সহযোগী শাফায়েত জামিল। এই দুই সেনা নায়ক পাল্টা অভ্যুত্থানের মূল চালিকা শক্তি ছিলেন, নাকি শিখন্ডি ছিলেন, সেটি অনাগত দিনের গবেষণায় বেরিয়ে আসবে। তবে মূল নায়ক ছিলেন জিয়াউর রহমান। ভূমিকার হেরফেরে তিনি তিনি ছিলেন পর্দার আড়ালে। তার কলকাঠি চালনায় কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বে কথিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা পাল্টা অভ্যুত্থানে নামে কেল্লাহ ফতেহ করে জিয়াউর রহমানকে মহানায়কের ভূমিকায় টেনে এনেছিলো। ক্ষমতার মঞ্চের এই রক্তাক্ত নাটকীয়তার দৃশ্যপট থেকে জিয়াউর রহমানের জন্য ব্যারিকেড হিসেবে গণ্য খন্দকার মোস্তাক , জেনারেল ওসমানী, চীফ অব ডিফেন্স স্টীক মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান সহ আওয়ামীলীগ সমর্থিত মন্ত্রীবর্গের পতন নিশ্চিত হয়। ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে পৌছে যান জিয়াউর রহমান। (চলবে)