সরওয়ার আহমদঃ গাঙ্গেঁর এই বদ্বীপের চরাচরে এক সময় নৌকার আধিক্য ছিলো বাস্তবতার আলোকে। যান্ত্রিকতার ব্যাপ্তি ঘটার আগ পর্যন্ত নদী, হাওর, এবং প্লাবন ভূমিতে নৌকার ছিলো হরেক পরিচিতি। নদীগুলোতে ব্যবসায়িক বড় নৌকার উপস্থিতি ছিলো প্রতি এলাকাতে। মাঝি মাল্লারা ছিলো নৌকার চালিকা শক্তি। উজান গাঙ্গেঁ নৌকা বেয়ে নেয়ার জন্য প্রতি নৌকাতে ২/৪ জন মাল্লা থাকতো, যারা ছন্দে ছন্দে বৈটা চালাতো জারি সারি গেয়ে। নৌকার উজান যাত্রাকে গতিশীল করার জন্য দড়াটানা সিস্টেমও ছিলো। নায়ের মাস্থুলে শক্ত রশি বেধে সেই রসির মাথায় লাটি সংযুক্ত করে মাল্লারা নদীর কিনার দিয়ে রসি টেনে উজান কদমে অগ্রসর হবার দৃশ্যপট এখন হাবিয়ে গেলেও ইতিহাসের পাতায় তা অঙ্কিত আছে। নদীর পাশাপাশি প্লাবন ভূমিতে লগি বৈঠা ধারী মাঝির পাশাপাশি পালের নৌকা ছিলো লক্ষ্যনীয়। টাঙ্গাঁনো পালে অনুকূল বাতাসের ছোয়ায় নৌকার গতি বেড়ে যেতো। বলাবাহুল্য, নদীতে থাকতো পাটের নৌকা ও ধানের নৌকা। নদীতীরবর্তী এলাকা থেকে ধান ও পাট সংগ্রহ করতো এ সমস্থ মহাজনী নৌকা। তার পাশাপাশি মৌসুমী নৌকার উপয়িতি ছিলো প্রতি শহর এবং বাজার এলাকায়। মৌসুমী নৌকাগুলোতে থাকতো হাড়ি পাতিল বাসন ইত্যাদি। আরেক শ্রেনীর নৌকার উপস্থিতি ছিলো যাতে থাকতো কাটের তৈরী খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিলসহ অন্যান্য আসবাবপত্র। গ্রামাঞ্চলের প্রসিদ্ধ বাজার গুলোতে কাঁঠাল কমলা এবং আমের নৌকারও আগমণ ঘটতো। গ্রামে যারা বিত্তবান ছিলেন, তাদের পাঁকা ঘর নির্মাণের জন্য বালির নৌকারও প্রচলন ছিলো। বর্ষা মৌসুমে বালি ভর্তি নৌকাগুলো সুবিধা জনক স্থানে বালি ফেলে রাখতো পূর্ব চুক্তি অনুসারে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বর্ষা মৌসুমে গ্রামাঞ্চলে নৌকার ব্যবহার বেড়ে যেতো। গ্রামের প্রতিটি পরিবারে একটি করে নৌকা থাকতো। মহাজনী নৌকার আদলে তৈরী এসমস্থ নৌকা ছিলো ছোট আকৃতির। এগুলোকে বলা হতো ডিঙ্গি নৌকা। বর্ষা মৌসুমে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হবার পর গৃহপালিত পশুর চারণ ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়ে আসতো। এমতাবস্থায় গরুর ঘাস সংগ্রহের জন্য গৃহস্থরা এসমস্থ নৌকা ব্যবহার করতেন। এ জন্যই বোধ হয় স্থানীয় ভাবে এসমস্থ নৌকাকে বলা হতো “ঘাসিয়ারা” নৌকা। তবে এ নৌকার ব্যবহার শুধু ঘাস কাটাতেই সীমাবদ্ধ ছিলোনা। জৈষ্ঠ্য-আষাঢ় মাসে ঢলের গানি হাওরে নামলে ঝাঁক বাধা ছোট বড় মাছ উজান বেয়ে চলে আসতো গ্রামীণ মাঠে প্রান্তরে। এ মাছ ধরার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতো উক্ত নৌকা। অভ্রান্ত নিশানার অধিকারী মাছ শিকারী “কোঁচ” হাতে নিয়ে নৌকার আগ গুলুইয়ে দাড়িয়ে মাছের দৌড় অনুমান কবে ঘাঁ বসাতেন। ঘাঁ সফল হলে নায়ের মাঝি পানিতে ডুব দিয়ে কোঁচ বিদ্ধ মাছটিকে তুলে আনতেন নায়ে। মাছ শিকারের ক্ষেত্রে শিকারীর দক্ষ তার পাশাপাশি মাঝির দক্ষতাও ছিলো সমান তালে। শিকারী হাত ইশারা করে যেদিকে নৌকা চালানোর ইঙ্গিঁত দিতেন, সেদিকেই মাঝি দ্রুতগতিতে নাও ছুটাতেন। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে নায়ের আগগুলুইয়ে রাত্রিকালে আলোর ফাঁদ তৈরী করেও শিকারীরা মাছ শিকার করতেন স্বচ্ছ জলে। বিশেষত: স্থিরনদী এবং হাওরেই ঘাসিয়ারা নৌকা দিয়ে এ প্রক্রিয়ায় মাছ ধরা হতো। গ্রাম্য ভাষায় এই প্রক্রিয়াকে বলা হতো “আলোয়া” শিকার। রাত্রি শেষে শিকারীরা ঘুমকাতর চোখে বাড়ি ফিরতেন খলই বা টুকরি ভর্তি মাছ নিয়ে। সময়ের বিবর্তনে উল্লেখিত মাছ শিকার পদ্ধতি এখন হারিয়ে যাবার পথ ধরেছে।
পর্ব-৬ দিন গুলো মোর সোনার খাঁচায় রইলো না
