আবুল কালাম আজাদ:
১৬ই ডিসেম্বরের আগেই বাজতে থাকে আমাদের হৃদয়ে যে বাজনা – তাই হলো বাঙ্গালীর শ্বাশত পাওনা। পরাধীন ভারতবর্ষকে বিট্রিশ শাসক গোষ্টীর ছোবল হতে মুক্ত করতে প্রান দিতে হয়েছিল শত শত কৃষককে। অকুতোভয় দেশপ্রেমীক শহীদ তিতুমীর জানতেন- বিট্রিশ বাহিনীর শক্তিশালী কামান- বন্দুকের বিপরীতে বাঁশের কেল্লার লাটিয়াল বাহিনী তুচ্ছ- তবুও জনগনকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দিক্ষীত করে দেশকে স্বাধীন করতে ছিল তার এ আয়োজন। ইতিহাস খ্যাত দেশপ্রেমীক শের-ই বাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দত্ত, মাওলানা ভাসানী – সবার ছিল একই ধ্যান ধারনা- কিভাবে মুক্ত করা যায় এ জন্মভূমিকে। তাদের চিন্তা চেতনায় যিনি নিজেকে শিশুকাল থেকে রাঙ্গিয়ে তোলেন- তিনি আর কেউ নন- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলনে তরুন ছাত্র- যুবকের রক্তে রঞ্জিত হয় এ মাটি। পাকশাসক গোষ্টী পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয় স্বাধীনতাকামী জনগনের আন্দোলনে। তাইতো ইতিহাসের পাতায় এক অনন্য মাইলফলক- ভাষা আন্দোলন। এবিজয়ে বাঙ্গালীর চিন্তা চেতনা- বিশ্বাস এমন জায়গায় পৌছে যায় যে, স্বাধীনতা অর্জন তাদের কাছে যেন সময়ের ব্যাপার। ক্রমান্বয়ে ছাত্র জনতার প্রতিবাদী কন্ঠ যেন টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া- রুপসা থেকে পাথরঘাটা ছড়িয়ে পড়ে পাক শাসনের বিরুদ্ধে। এ চেতনার ধারাই ক্রমবিকশিত হয়ে ঘটে- ১৯৬২ ইং সালের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ সালের ১১ দফা আন্দোলন। পরবর্তীতে ৬৯ এর গনঅভূত্থান সহ নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে স্বাধীনতাকামী নেতৃত্ববৃন্দ নিশ্চিত হন একটি স্বাধীন দেশ আর পতাকার জন্য দিতে হবে অনেক প্রান- ঝরাতে হবে রক্ত। দৃপ্ত শপথে লক্ষ লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে অনুষ্টিত হয় সময়ের সাহসী আর দূর্লভ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষন- যা আজ জাতিসংঘে স্বীকৃত। পৃথিবীতে এমন নেতা- এমন ভাষন সত্যি বিরল। তাই বলতেই হয়- হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙ্গালী- অবিসংবাদিত বাঙ্গালী জাতীর নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তার বক্ততায় যেমন এ জাতীর দাবী উপস্থাপন করেন তেমনি সমঝোতা, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী জনতার দাবী, স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরুর পরবর্তী দিক নির্দেশনা, কোন লিখিত ঘোষনাপত্র ছাড়াই বজ্রকন্ঠে ঘোষনা করে যে বীরত্বের পরিচয় দেন তার সাথে কারো তুলনা হয় না। তাই তিনি ইতিহাসে বিরল- ক্ষনজন্মা জাতির পিতা হিসাবে স্থান পেয়েছেন।
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশ হয় বিরান ভূমি। দুখিনি মা হারান আদরের সন্তানকে, স্ত্রী হারান প্রিয় স্বামীকে, বোন হারান ¯েœহের ভাইকে। নারী নির্যাতন, সংখ্যালঘু নির্যাতন, নারকীয় বুদ্ধিজীবি হত্যা পাক শাসকগোষ্টীর কলংক জনক ইতিহাসে- সমস্ত বিশ্বের ধীক্কার পায় পাকবাহিনী। আমাদের পূন্যভূমি সিলেটের গৌরব বীরসেনা কর্নেল এম, এ, জি ওসমানী জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ পরিচালনা করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন- তিনি আমাদের দেশপ্রেমের অনুপ্রেরনার উৎস। মুক্তিযোদ্ধা, সাধারন জনতা, তথা নারীদের রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার মাটি। মিত্রবাহিনীর ঐকান্তিক সহযোগীতা নিয়ে বীর বাঙ্গালী বীরদর্পে যখন পরাজিত করতে থাকে পাক বাহিনীর একের পর এক দূর্গ- অবশেষে সেই ঐতিহাসিক ক্ষন- মহান ১৬ ই ডিসেম্বর ১৯৭১ এর মাধ্যমে আমরা লাভ করি এক খন্ড স্বাধীন জন্মভূমি আর লাল সবুজ পতাকা। যার মধ্যে শোভা পায় শ্যামল ভূমি আর দেশপ্রেমিকের ঝরা তাজা রক্ত।
বিদ্রোহের মন্ত্রে গড়ে ওঠা স্বাধীনতাকামী নজরুল ইংরেজ শাসকদের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন “ধান ফুরালো পান ফুরালো খাজনার উপায় কি- আর কটা দিন সবুর কর রসূন বোনেছি”। সত্যি সত্যি নজরুলের লিখা রসূনের ঝাঝে বেড়ে ওঠে এদেশের লক্ষ লক্ষ স্বাধীনতাকামী বীর বাঙ্গালী- যারা লাটি-সোটা নিয়েই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল পাকসেনাদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ডাকে। তাইতো আমাদের কানে যখন বাজে “ও আমার দেশের মাটি- তোমার তরে ঠেকাই মাথা” তখন কার না দেশেরপ্রতি শ্রদ্ধায়- ভালবাসায় ভরে উঠে না মন।
আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় অর্ধশত বৎসর পেরিয়ে গেছে। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশকে বেশিদিন নিজের হাতে গড়তে পারেন নি বঙ্গবন্ধু। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে নারকীয়- ঘৃণীত হত্যা কান্ডের মাধ্যমে আমরা হারাই জাতির জনককে। তারপর রাজনৈতিক নানা পালা বদলের মধ্যেও আজ দেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে এসেছে বহুদূর। পদ্মাসেতু- মেট্রো রেল হচ্ছে-যা ছিল অনেকটা কল্পনাতীত। তারপরও রয়েছে অরক্ষিত স্বাধীনতা তথা স্বাধীনতার অতৃপ্তি। এখনও আমাদেরকে দেখতে হয় প্রত্যন্ত গ্রামীন জনপদে বা শহরের অলিগলিতে অভূক্ত মানব সন্তান। এখনও শীতের প্রকোপে মৃত্যুর পথে যাত্রী হতে হয় কোন অসহায় বৃদ্ধকে। এখনও দেখতে হয় সুদখোর মহাজন শ্রেনী- যারা চুষে চুষে খাচ্ছে নি¤œবিত্ত মানুষকে। এখনও দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করতে হয় সোনার বাংলার অনেক জনগোষ্টিকে। চড়া সুদখোর ইউনুছ গংদের সুদের ব্যবসায় জড়িয়ে ফাঁসিতে ঝুলতে হয় বা ভিটে মাটি ছাড়তে হয় অনেক প্রান্তিক জনগোষ্টিকে। ব্যাংক লোটে বা শেয়ার কেলেংকারীতে যখন অসংখ্য জনগন সর্বশান্ত – তখন আমরা দেখি না কোন দৃশ্যমান শাস্তি। তদুপরি দশ হাজার টাকা কৃষি ঋন নিয়ে পরিশোধ করতে না পেরে অসহায় কৃষককে ওয়ারেন্টের আসামী হয়ে বাড়ি ছাড়তে হয়। এখনও আমরা দেখি সীমান্তের তারে নির্মমভাবে ঝুলে থাকা ফেলানীর লাশ। প্রতিদিন আমরা দেখি নারী নির্যাতনের শিকার হয়ে অকালে ঝরে পড়া রুমা, হেনা, অরিত্রী, তৃষ্ণা কিংবা তনুর লাশ। সড়ক দূর্ঘটনায় আহত-নিহতদের মিছিল হচ্ছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। অপুষ্টিতে এখনও ধুকছে নিস্পাপ শিশু। এমনকি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা এখনও রিক্সা চালিয়ে, দিনমজুরী করে জীবন চালানোর সংবাদ পত্রিকায় আসে। প্রতিদিন দেখতে হয় খুন, গুম আর হৃদয় আতকে উঠার মতো বিভৎস চিত্র পত্রিকার পাতায়। ১৬ ই ডিসেম্বর ২০১৮ ইং- মহান বিজয় দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হউক- সত্যিকার সোনার বাংলা যেখানে উল্লেখিত অনাচার, অবিচার, নির্যাতন আর নিপীড়ন থাকবে না। দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্টী যেন দারিদ্রমুক্ত জীবন পায়। যেখানে সেখানে তথা রেল ষ্টেশনে একজন মানুষও যেন অমানবিক জীবনযাপন করতে না হয়। সমাজে যেন সত্যিকার অর্থে ন্যায়বিচার প্রতিষ্টিত হয়। বিচারের বানী যেন নীরবে- নিবৃতে না কাঁদে। এই হোক আমাকে কামনা। প্রতিদিন ভোরের সূর্য যেন আমাদের জন্য নিয়ে আসে সোনালী জীবনের আলো। গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ- এমন দিন যদি নাও আসে তবুও তিন বেলা ডাল-ভাল খেয়ে নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা যেন জুটে সকলের ভাগ্যে- তবেই হয়ত স্বাধীনতার পরিপূর্নতার স্বাদ একটু হলেও আমাদের মনকে তৃপ্তি এনে দিবে।
লেখক: প্রধান শিক্ষক
ফিউচার ব্রাইট একাডেমী,
মৌলভীবাজার।