ইদানিং প্রতিবন্ধী শব্দটি যেন অনেকের জানা। শুধু জানা নয় সকলের কাছে এ শব্দটি একটি অধিকারের নাম যা প্রতিবন্ধীদের কার্ডে লিখা আছে- “সুবর্ন নাগরিক”। সত্যি এটি প্রতিবন্ধীদের যৌক্তিক পাওনা তবে নিঃসন্দেহে করুনায় নয় এটি তাদের সংবিধান সম্মত মৌলিক অধিকার।
মূলত বয়স, লিঙ্গ, জাতি, সংস্কৃতি বা সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী আর দশজন যে কাজ করতে পারে ইমপেয়ারমেন্টের কারনে সে কাজগুলো প্রাত্যহিক জীবনে করতে না পারার অবস্থানই হল ডিসএবিলিটি বা প্রতিবন্ধীতা। দেহের যে কোন অংশ সম্পূর্ন, আংশিক, ক্ষনস্থায়ী বা চিরস্থায়ীভাবে তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারানোই হলো ইমপেয়ারমেন্ট। গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষনের পাশাপাশি বাংলাদেশ “প্রতিবন্ধী ব্যাক্তির অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদ” অনুসমর্থন করেছে বিধায় প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন- ২০১৩ বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) প্রকাশিত International Classification of impairment, disability and handicap (ICIDH) শীর্ষক প্রকাশনায় বিকলাংগ ও প্রতিবন্ধী সমস্যাকে দূর্বলতা, অক্ষমতা ও প্রতিবন্ধী এই ৩ শ্রেনীতে ভাগ করা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন-২০০১ এর বর্ননায়ও অনুরূপ বিষয়গুলোকে নির্ধারণ করে তাদের জীবনমান উন্নয়নে নানামুখী কার্যক্রম গ্রহন করা হয়েছে। প্রতিবন্ধীদের এহেন সমস্যার সাধারন কারন হিসেবে বংশানুক্রমিক, দূর্ঘটনা ও বিষক্রিয়া এ তিনটি বিষয়কে নির্ধারন করা হয়েছে। রক্তের আত্মীয়দের মধ্যে বৈবাহিক সর্ম্পক বংশানুক্রমিক প্রতিবন্ধীতার কারন মনে করা হয়। পুষ্টির অভাব, ভিটামিনের অভাব ও আয়োডিনের অভাব ইত্যাদিকে বিষক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিবন্ধীতার কারন মনে করা হয়। প্রসুতি মায়েদের বয়সের অপরিপক্ষতা, প্রয়োজনীয় টিকিৎসার অভাব, ডায়াবেটিস ও মাদকাসক্ততার অভ্যাসকে জন্মগত কারন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উপরোক্ত কারনগুলো সর্ম্পকে আমাদের প্রসূতি মায়েদের বা পরিবারের ব্যাক্তিদের সচেতনতার যেমন রয়েছে অভাব তেমনি অভাব রয়েছে তাদেরকে সচেতন করে তোলার উদ্যোগের। যার ফলে প্রতিবন্ধিতার ব্যাপকতাকে সংশ্লিষ্ঠ দপ্তর এখনও কাংখিতপর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারছে না। যত তাড়াতাড়ি এ সংক্রান্ত সচেতনতার উদ্যোগ সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ে পৌছানো যাবে তত তাড়াতাড়ি সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে প্রতিবন্ধীতার হার।
এক সময় আমাদের সমাজে জন্মগত ভাবে প্রতিবন্ধি বা জন্মের পর দূর্ভাগ্যক্রমে প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়াদের অবহেলার চোখে দেখা হতো। পরিবারের অতি আপনজনরা ছাড়া বাকীদের কাছে তারা ছিল বোঝা। সেদিন আজ নেই, বদলেছে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারা। বর্তমান সরকারের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে অন্যান্য অধিকার বঞ্চিতদের পাশাপাশি প্রতিবন্ধীদের অধিকার বাস্তবায়ন ও মান্নোয়নে গ্রহন করেছে নানামুখী কার্যক্রম। প্রতিবন্ধীদের তালিকা সংগ্রহ করে নিজস্ব ডাক্তারী বিভাগের মাধ্যমে তার শারীরিক অক্ষমতা নির্ধারণ করে তাদের অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে সুবিধাভোগীদের তালিকায় মিয়ে এসে কার্ড প্রদান করে। পরবর্তীতে অসচ্ছলদের স্বল্পসময়ের মধ্যে মাসিক প্রদান করা হয় যা তাদের মৌলিক অধিকারেরই অংশ। বিনামূল্যে ব্যায়াম, চিকিৎসা প্রদান ও উপযুক্তদের কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করে যতটা সম্ভব সোনালী জীবনের আলো দেখানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন সমাজকর্মীরা এ কাজ করেন নিবেদিতপ্রানে। সরকারী বরাদ্দের ও ঘাটতি হয় না। শিশুজন্মের সময় অপরিপক্ষতা, প্রসব সময়ের অব্যবস্থাপনা মাথায় আঘাত ও প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অভাব ইত্যাদি কারনে শিশুর মধ্যে প্রতিবন্ধীতা দেখা দেয়। শিশুজন্মের পর উপরোক্ত কারন ছাড়া ও উচ্চ মাত্রার জ্বর, মস্তিস্কে কিছু কিছু ইনফেকশন, রোগ এবং টিউমার ইত্যাদি কারনে শিশুর মধ্যে এর প্রবনতা দেখা দেয়।
প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং অসহায়, দরিদ্র, সুবিধা বঞ্চিত প্রতিবন্ধী শিশুকিশোরদের শিক্ষা লাভের সহায়তা হিসেবে ২০০৭-২০০৮ অর্থবছর হতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে শুরুতে ১২ হাজার ২০৯ জন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে নিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হলেও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮০ হাজার জন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য ৫৪.৫০ কোটি টাকা উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। যা তাদের জীবনমান উন্নয়ন এর পাশাপাশি তাদের কে কর্মমূখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে বিরাট ভূমিকা রাখছে। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা যাতে সামান্যতম হেয় প্রতিপন্ন না হয় তার জন্য সম্পূর্ণ সুস্থ শিক্ষার্থীদের সাথে একত্রে বসে অধ্যায়নের অধিকার যথাযথভাবে নিশ্চিত করা হচ্ছে। অন্ধ শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা আবাসিক হোস্টেল স্থাপন করে বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে তাদেরকে শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। চাকুরীতে তাদের কৌটা যথাযথভাবে যেমন পালন করা হচ্ছে তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রেও তার কোন ব্যাতিক্রম হচ্ছে না। এ ধরনের উদ্যোগের আমাদের দেশে নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার এবং আমাদের দেশে ইতিমধ্যে এগুলো দৃশ্যমান সমাজসেবা কার্যক্রম জনগনের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। জাতীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহন সমাজের বিবেক নাড়া দেয় রীতিমতো। বর্তমান সরকারের এ ধরনের উদ্যোগ চোখে পড়ার মত হলেও এর দায়বদ্ধতা শুধু সরকারের নয়। সমাজের বিত্তবানদের সম্পদে অসচ্ছলদের অধিকার ধর্মীয়ভাবে যেমন স্বীকৃত তেমনি সামাজিকভাবেও অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। তাই সরকারের পাশাপাশি বিত্তবানরা ও তাদের আশপাশে অবস্থান করা প্রতিবন্ধীদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া উচিৎ সামাজিক দায়বদ্ধতা মনে করে- করুনা মনে করে নয়। এতে করে সমাজের অন্যান্যদের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতিবন্ধীরা ও জীবনে আশার আলো দেখতে পাবে। তারা সমাজের বোঝা না হয়ে সমাজের কর্মঠ জনশক্তিতে যদি নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে পারে- তবে সমাজটা আর পিছিয়ে থাকবে না। উন্নত জাতি পরিচয় দিতে আমাদের আর কোন বাধা থাকবে না।
এসব উদ্যোগের পাশাপাশি দরিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে এ ব্যাপারে সচেতন করা একান্ত প্রয়োজন। রোগের চিকিৎসার চেয়ে আরও উত্তম কাজ রোগ প্রতিরোধ। একমাত্র সচেতনতাই আমাদের সমাজকে অনেকাংশে প্রতিবন্ধীতার হাত থেকে রেহাই দিতে পারে। একাজে অত্যন্ত সহজে ব্যাপক অবদান রাখতে পারে সমাজের সমাজসেবা মূলক সংগঠন গুলো। তাদের সমাজসেবা কার্যক্রমের অন্যতম এজেন্ডা “যদি প্রতিবন্ধিতা থেকে মুক্তি” হয় তবে একাজ তেমন কঠিন নয়।
আশার কথা আমাদের দেশে একাজ বেশি কঠিন হবে না যেহেতু অনেকের মধ্যে এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরী হয়েছে। শুধুমাত্র পরিকল্পনা মাফিক সামাজিক সংগঠন, স্থানীয় সরকারবিভাগ ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় যদি আন্তরিকতার সহিত উদ্যোগী হয়ে কাজ করে তবে আমরা প্রতিবন্ধীতাকে জয় করে ফেলবো। সেদিন আর বেশী দূরে নয়।
লেখক: আবুল কালাম আজাদ
প্রধান শিক্ষক, ফিউচার ব্রাইট একাডেমী, মৌলভীবাজার।