সরওয়ার আহমদঃ-
সময়টা অতিক্রান্ত হচ্ছে অচলায়তনের আবহে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করোনা ভাইরাসের ছোবলে বিশাল এই ধরনীতট যেনো স্থবিরতার অকেটাপাশে আবদ্ধ। এই পৃথিবী দূর্যোগের শিকার হয়েছে বারংবার। তন্মধ্যে হচ্ছে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই যুদ্ধকালীন সময়েও গতিশীলতা কমবেশী ছিলো। কিন্তু করোনা ভাইরাস আগ্রসনের মুখে তাবৎ বিশ্বের গতিশীলতা মহাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটের চাইতেও গতিহীন তথা স্থবিরতার অক্টোপাশে বাঁধা পড়েছে। বাংলাদেশীর বাস্তবতায় গত মার্চ মাস থেকেই আরোপিত বিধি নিষেধের আলোকে নেমে আসে এক প্রকার অচলায়তন। আইনশুঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর চাইতে ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের বার্তা- ঝঃধু ঐড়সব এ ক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা রেখেছে। যারা মোবাইল ব্যবহারে অভ্যস্থ তারা- ফোনের বার্তায়ই সতর্ক হয়েছেন বেশি মাত্রায়। ছোয়াচে রোগ করোনা ভাইরাস থেকে নিরুপদ্রব থাকতে উঠা বসা ও চলাফেরার গতি কমিয়ে দেয়াটাই নাকি বেহতর। এমতাবস্থায় সভা-সমাবেশ আড্ডা বৈঠক, এমনকি হাঠবাজারে গমনেও প্রতিবন্ধকতা। অর্থাৎ একপ্রকার অচলায়তনের ঘেরাটোপেই আবদ্ধ থাকতে হবে। অভাবিত এই অচলায়তনে সময়কাটে কিভাবে? চার দশকের সাংবাদিকতার জীবনে দৌড় ঝাপই ছিলো আসল চালিকা শক্তি। রাত নেই, দিন নেই- ছোটাছুটি করেছি নেশা এবং পেশার টানে। বরাবরের এই অভ্যাসে যতিরেখা টেনেছি করোনার বিধি নিষেধ। তার সাথে আছে পারিবারিক প্রতিকূলতা। সবারই একই কথা- বাড়ীতে বসে থেকো। তাদের মতামতকে কোন সময় উপেক্ষা করে শহরে ছুটে গেলেও, পরিচিত শহরকে মনে হয়েছে অপরিচিত। আড্ডা নেই, দোকান পাট আংশিক খোলা, পরিচিত রাস্তায় নেই কোলা হল। এমনি অবস্থায় গ্রামের বাড়ীর বাউন্ডারীর ভেতরে বসে থাকা, পুকুরে বড়শী ফেলে ধ্যানী দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা এবং টিভির সামনে দর্শক হয়ে দিনমান অতিক্রম যেনো অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। এই অচলায়তন অতিক্রমের পথ খুঁজেছিলাম।
অবস্থানিক ক্ষেত্রে আমি মনুপ্রকল্পের অন্তর্ভূক্ত। প্রকল্প এলাকায় ২০/২৫ বিঘা ধানী জমির মালিক উত্তরাধিকার সুত্রে। পেশাগতভাবে পিতা স্কুল শিক্ষক হলেও বাৎসরিক কামলা রেখে জমি চাষাবাদ করাতেন। এ সুবাদে কৈশোর বয়সে মাঝে মধ্যে কামলাদের সকালের খাবার নিয়ে মাঠে ছুটে যেতাম। কৈশোর উত্তীর্ণ বয়সে লাঙ্গল চালাতে গিয়ে লাঙ্গলের ধারালো ফলা দিয়ে বলদের পর্দা কিছুটা কেটে ফেলে ছিলাম। এ নিয়ে বকাঝগকাও খেয়েছিলাম। তবু হাল চালনা রপ্ত করেছিলাম। জমিতে ধানরোপন এবং ধানকাটার ট্রেনিংও নিয়েছিলাম ইদন মিয়া নামক কামলার নিকট থেকে। একজন কামলা অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় ৭৪ সনে সপ্তাহদিন হালচাষও করেছিলাম। সকাল ৭টায় মাঠে ছুটে যেতাম, ২ঘন্টা চাষাবাদ শেষে বাড়ীতে এসে গোসল করে খেয়ে-দেয়ে সাইকেলে চেপে কলেজে ছুটে যাবার স্মৃতি আজও মানস পটে অস্মান হয়েআছে। বিগত ১৯৯৪ সনে, আব্বা যখন মৃত্যু শয্যায় তখন ডেকে নিয়ে বলেছিলেন- বাপ দাদার জমিজিরাত পাখাল বা পতিত রেখোনা কোনদিন। এটি তোমার নিকট আমার অন্তিম নির্দেশ। মরহুম পিতার অছিয়ত রক্ষার্থে- কলের লাঙ্গল, ড্রামসিডার, পানির পাম্প এবং ধান মাড়াই মেশিন কিনে উত্তরাধিকার বহাল রাখার চেষ্টা করেছিলাম ৪/৫ বছর। কিন্তু “এক হাতে দুই শোল” ধরা যায় না কখনও। একদিকে সাংবাদিক এবং অন্যদিকে কৃষক থাকার দ্বিমুখীনীতি কার্য্যকর না হওয়াতে কৃষিকে ছাড়াতে বাধ্য হয়েছিলাম এক যুগ আগেই। খেতের জমি তুলে দিয়েছিলাম বর্গা চাষীদের হাতে। চলমান করোনার স্থবিরতা কাটাতে এবার ফের কৃষক হবার সিন্ধান্ত গ্রহণ যখন করি তখন গৃহিণী এবং ছেলে মেয়েদের এক বাক্য- মরার বুঝি আর পথ খুঁজে পাচ্ছো না। তাদেরকে বল্লাম- শহর বন্দর অতিক্রম করে গ্রামীণ মাঠে করোনা এখনও পৌছাতে পারেনি। এই মাঠে অবস্থান নিলে লাভ বৈ ক্ষতি কি? তোমাদের বিধি নিষেধ আমি মানবো না। মনু প্রকল্পের কাশিমপুর পাম্প হাউজের সেচ মেশিন গুলো শক্তিহীন হয়ে পড়ায় গত দেড়যুগ যাবৎ জলাবদ্ধতা ভাগ্যলিপি হয়ে উঠায় শাইল জমিও চাষাবাদ সম্ভব হতো না অনেক এলাকায়। এখন তার ব্যতিক্রম ধরেছে। গত ২০১৯ সনে পাম্প হাউজে নতুন মেশিন স্থাপন করায় জলাবদ্ধতার মাত্রা কমে এসেছে। তাই এবার বীজতলা তৈরী করে বীজ বপন করলাম। অনেকে প্রশ্ন করলো-যদি পানি না কমে তাহলে হালি বীজতো নষ্ট হবে। বল্লাম পিছুটান সবক্ষেত্রেই আছে। যারা সাহসী তারা এগিয়ে আসো। আমার দেখা দেখি অনেকে বর্ধিতমাত্রায় বীজতলা তৈরী করে বপন করলো। কারণ অন্যান্য বছর আষাঢ় মাসে যে জমিতে কোমর কিংবা সাতার সমান পানি থাকতো সেখানে হাটুজলও নেই। সুতরাং জলাবদ্ধতা যে থাকবেনা এটি প্রকল্প এলাকার চাষীরা আঁচ করতে পারায় সব সব এলাকাতেই নবোদ্যমে শাইল ধান চাষাবাদের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছিল।
আষাঢ় মাস থেকেই বাড়ী ছেড়ে মাটের দিকে ধাবিত হই। বিস্তীর্ণ ফসলী মাঠের যেদিকেই চোখ ফেলি সেদিকেই দেখি জলজ উদ্ভিদ এবং আগাছার জঙ্গল। রাখালরা যেখানে অবাধে গরু চড়াচ্ছে। খামারের হাঁস ঝাক বেধে জলকেলি করছে। বক এবং সারসের দল তারই মাঝে পায়ে পায়ে হেঁটে আধার যোগাড় করে নিচ্ছে অবলীলায়। শাওনের সূচনাতেই বিস্তীর্ণ মাঠের আগাছা এবং জলজ উদ্ভিদ অপসারণে শুরু হলো কার্যক্রম। দলবেধে কৃষকরা নেমে পড়লো আগাছা সাকে। ধান চাষাবাদে এই আগাছা যেমনি প্রদিবন্ধক, তেমনি সেটিকে জাঁকে ফেল্লে তাহা কম্পোষ্ট সারে পরিণত হয়ে জমির উর্বরা শক্তি বাড়ায়। হাল আমলের কৃষকরা সেটি জানে। তাই দেখলাম সপ্তাহদিনের মাথায় মাঠের প্লটের পর প্লট সাফ হয়ে গেলো। ৪৫ বছর আগের পরিচিত মাঠ এবং বর্তমান মাঠের মধ্যে তেমন জেরফের ধরেনি। পরিবর্তন যা কিছু হয়েছে তন্নধ্যে রয়েছে- চার দশক আগে যে কৃষাণ মাঠে ছিলো, সে চলেগেছে পরপারে। তার উত্তরাধিকারীরা এখন পেশার ঝা-া হাতে নিয়ে মাঠে সক্রিয়। যে প্লটটি আগে ছিলো বড়, এখন বংশ এবং অংশের সমীকরণে তা ছোট হয়ে এসেছে। জমির মালিকানা বদলও হয়েছে অনেক দাগ খতিয়ানে। বড় যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, সেটি হলো মাঠে এখন হাল চাষের জন্য বলদ নেই। বলদের বদলা এসেছে ট্রাক্টর।
চাষাবাদের ক্ষেত্রেও এসেছে পরিবর্তন। যে মাঠে আগে চাষ হতো শুধু রোপা আপন, সেখানে এখন স্থান জুড়ে নিয়েছে হাইব্রীড ইরি। প্রায় ৪৫ বৎসর পর মাঠে নেমে সেই আমি এবং এই আমির মধ্যে তফাৎ আবিষ্কার করলেও, আমার ধানী জমি গুলোর তেমন হেরফের ধরেনি। ব্যতিক্রম ধরেনি প্রকৃতিও। যখন অঝোরে বৃষ্টি নামে তখন বিস্তৃত মাঠের দেখেছি একরূপ। আবার দিগন্ত ব্যাপী যখন আলোর ঝালকানি দেয় তখন আরেক রূপ। নির্মল বাতাস এবং বিস্তৃত মাঠের অনুকূল আবহে কৃষক মানস নিমেষে ফুর ফুরে হয়ে উঠে। ৪৫ বৎসর আগে নৌকার গুলুইয়ে বসে যে মাঝি গলা ছেড়ে গান ধরেছিলো, সেই গানের সুর লহরী এখনও ধ্বনিত হয় কৃষকের কন্ঠে একই ব্যঞ্জনা নিয়ে। ছাতা মাথায় জমির আইলে বসে আছি। দূর থেকে কৃষাণের কন্ঠ বেয়ে নিঃসৃত হলো- সুজন বন্ধুরে, আরে ও বন্ধু, কোনবা দেশে থাকো….. অবলারে কান্দাইয়ারে কোন নারীর মন রাখো….. সুজন বন্ধুরে। কন্ঠস্বরের সাথে তবলা হারমনি কিংবা অন্য বাদ্যযন্ত্রের যোগসাজস নেই। কিন্তু অবারিত আবেগ এবং হৃদয়ের প্রশন্ততার ছোয়ায় খালি কন্ঠের গান কিভাবে মর্মস্পর্শী হয়ে উঠতে পারে, সেটি খোলামাঠে না গেলে অনুভব করার নয়। একই ভাবে মাঠ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট খালের উপর নির্মিত পাকাপুলের রেলিং এ বসে রাখাল বালকের কন্ঠ নিঃসৃত মুর্শিদী গানের কলি প্রবীণ মানসকে আকুলিত করেছে। সুনীল দিগন্তের নীচে সুবিস্তৃত মুক্ত মাঠে বিচরণের অনুভূতিই বুঝি আলাদা। এই বদ্বীপে অনেক কিছুরই অদলবদল ঘটেছে। পরিবর্তনের দোলায় অনেক কিছুই তার স্বকীয়তা হারিয়েছে। কিন্তু বাংলার মাঠ তার সত্ত্বাশ্রিত বৈশিষ্টকে আকড়ে ধরে আছে অনড় হাতে। এই মাঠে খরা দাহনের হাতছানি আসে, বানভাসি কিংবা বন্যা সবকিছুকে তছনছ করে ফেলে এবং আগাছার বিস্তার পলল মাটিকে ঢেকে দেয়। কিন্তু মৌসুমী আবাহনে মাঠ যখন তার বরপুত্র কৃষকদেরকে কাছে টেনে নেয়, তখন তাদের কর্ম্মচঞ্চল হাতের ছোয়ায় সবকিছু বদলে যায়। বাড়ন্ত সবুজ ধানের ঢেউ খেলানের সুষমায় হতাশ মানসে জেগে উঠে আশার আল্পনা, বর্তে থাকার অফুরন্ত প্রত্যয়। প্যান্ট শার্ট, পাজামা পাঞ্জাবী ছেড়ে লুঙ্গি এবং হাফ হাতা শার্ট পরিধান করে গত দু’মাস মাঠে অবস্থান শেষে এই ধারনাই শানিত হয়েছে- প্রলয় তান্ডব, বন্যার ছোবল এবং করোনার ব্যারিকেড যতই আসুক- বাংলার ভূমিপুত্র কৃষক সমাজ তার সৃজনী মানস নিয়ে মাঠে অবস্থান নিলে- কোন বালাই কোন প্রতিবন্ধকতাই ধোপে ঠাঁই পাবার নয়।