হোসাইন আহমদ: মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলায় ভুয়া বিল ভাউচার, জালিয়াতি ও তথ্য গোপন করে দেড় কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের মূলহুতা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফরোজা হাবিব শাপলা, সাঁট মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর অনুপ চন্দ্র দাশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো: বাদশা মিয়া। বিগত ৫ মাসে তারা এমন সাগর চুরি করেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এ চক্র রাজনগর উপজেলা প্রশাসনের সাধারণ তহবিলের ৮০ লক্ষ ৫১ হাজার ৪’শ ৫৫, রাজস্ব তহবিলের ৪০ লক্ষ এবং উন্নয়ন তহবিলের ৩১ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছে। সিন্ডিকেট প্রতারণা এবং চেক জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকে ব্যক্তিগত হিসাব নম্বরে এ টাকা স্থানান্তর করে ভাগবাটোয়ারা করেছেন। এ অনিয়ম রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে। সূত্র বলছে গভীরভাবে অনুসন্ধার করলে দুই কোটি টাকার অনিয়ম বেরিয়ে আসবে।
একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, চলতি বছরের ৬ মে উপজেলার টেংরাবাজার পশুর হাটের খাস আদায়ে জনবল নিয়োগে জামানতের ৫ লক্ষ টাকা প্রাপ্তি হিসাবের ক্যাশ রেজিষ্ট্রারে দেখানো হলেও উপজেলার একাউন্টে এ টাকা জমা হয়নি। ১৪৩২ সনের টেংরাবাজার পশুর হাটের ইজারামূল্যের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ আয়করের ৫ লক্ষ ৯০ হাজার ১০ টাকা’র চেক ইস্যু করা হয়। কিন্তু ব্যাংক স্টেটমেন্টে দেখা যায়, ১৮ জুন লিমন আহমদ এ টাকা ক্যাশে উত্তোলন করেছেন এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাট বাবদ ৮ লক্ষ ৮৫ হাজার ১৫ টাকা’র চেক ইস্যু করা হলেও ব্যাংক স্টেটমেন্টে দেখা যায়, উক্ত চেক পূবালী ব্যাংক টেংরাবাজার শাখায় অনুপ চন্দ্র দাশের একাউন্টে ট্রান্সফার করা হয়েছে। ইজারা পরিচালনার ব্যয় বাবদ ২১ হাজার ২’শ ৫০ টাকা অনুপ চন্দ্র দাশের নামে পরিশোধের জন্য ১৯ জুন নথিতে অনুমোদন করা হলেও ব্যাংক স্টেটমেন্টে দেখা যায় জালিয়াতি করে ২৩ জুন উক্ত চেকে ৩ লক্ষ ২১ হাজার ২’শ ৫০ টাকা অনুপ চন্দ্র দাশের একাউন্টে ট্রান্সফার করা হয়। আয়করের ৫ হাজার ৪’শ ২৭ টাকা ইস্যু করা হলেও ব্যাংক স্টেটমেন্টে দেখা যায় ২৩ জুন উক্ত চেকে ৮ লক্ষ ৫ হাজার ৪’শ ২৭ টাকা পূবালী ব্যাংক টেংরাবাজার শাখায় অনুপ চন্দ্র দাশের একাউন্টে ট্রান্সফার করা হয়। ভ্যাট বাবদ ১৫ হাজার ৩২ টাকা ইস্যু করা হলেও ব্যাংক স্টেটমেন্টে দেখা যায় ২৩ জুন ৫ লক্ষ ১৫ হাজার ৩২ টাকা এনসিসি ব্যাংক শ্রীমঙ্গল শাখায় নিহার রঞ্জন দাশের একাউন্টে ট্রান্সফার করা হয়। হাটবাজার প্রচার বাবদ ২৫ হাজার টাকা ইস্যু করা হলেও ব্যাংক স্টেটমেন্টে দেখা যায় নেছার আহমেদ নামে ২ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা ক্যাশ উত্তোলন করা হয়। এ চেকের নোটশিটের পাতা ছিড়ে ফেলেছে চক্রটি। ২৬ জুন হাটবাজার ইজারামূল্যের উপর ১০ শতাংশ আয়কর ৪ লক্ষ ৪১ হাজার ৬’শ ১১ টাকা ব্যয় দেখানো হয়। কিন্তু এই টাকা উপজেলার একাউন্টে জমা না হয়ে অনুপ চন্দ্র দাশের নামে সোনালী ব্যাংক রাজনগর শাখায় ট্রান্সফার করা হয়। ৮ জুলাই ১৪৩২ সনের হাটবাজার ইজারামূল্যের উপর ১০ শতাংশ আয়করের ৭ লক্ষ ১১ হাজার ৪’শ টাকা ব্যয় দেখানো হলেও উপজেলার তহবিলে এ টাকা জমা না করে সোনালী ব্যাংক রাজনগর শাখায় জুবেল আহমদ (এসএ এন্টারপ্রাইজ) নামে ট্রান্সফার করা হয়। ১৪৩২ সনের হাটবাজার ইজারামূল্যের উপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট বাবদ ৮ লক্ষ ১১ হাজার ৬’শ টাকা ব্যয় দেখানো হলেও বাস্তবে এ টাকা উপজেলার একাউন্টে জমা হয়নি। ব্র্যাক ব্যাংক শ্রীমঙ্গল শাখায় বিজয় পাল ঝুটনের নামে ট্রান্সফার করা হয়। ১৪৩২ সনের হাটবাজার ইজারালব্দ আয়ের ২০ শতাংশ অর্থ গৌণ খাতে জমা বাবদ ৮ লক্ষ ১৭ হাজার ৫’শ ৪০ টাকা ব্যয় দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবে এ খাতে জমা না করে নিহার রঞ্জন দাশের এনসিসি ব্যাংক শ্রীমঙ্গল শাখায় ট্রান্সফার করা হয়। ১৪৩২ সনের অস্থায়ী পশুর হাট ইজারালব্দ অর্থের ৮০ শতাংশ টাকা ২৯ জুন রাজস্ব তহবিলে জমা বাবদ ৯ লক্ষ ২৭ হাজার ৫’শ ৭০ টাকা ব্যয় দেখানো হলেও বাস্তবে এ টাকা রাজস্ব তহবিলে জমা না করে বিজয় পাল ঝুটনের নামে ব্র্যাক ব্যাংক শ্রীমঙ্গল শাখায় ট্রান্সফার করা হয়। অ-ইজারাকৃত টেংরাবাজার পশুর হাটের ইজারা মূল্য বাবদ ৭৫ লক্ষ ৩ হাজার ৫’শ ৪৬ টাকা’র মধ্যে ৭০ লক্ষ টাকা উপজেলার সাধারণ তহবিলে জমা হয়েছে।
এদিকে ২০২৪ সালের জুলাই হতে উপজেলা পরিষদ রাজস্ব তহবিলের ৪০ লক্ষ টাকা জালিয়াতি করে আত্মসাৎ করে এ সিন্ডিকেট। রাজস্ব তহবিলের পূর্বের নথি, ক্যাশ বই ও পূর্ববর্তী ব্যবহৃত চেকের মোড়া গায়েব করেছে সিন্ডিকেট চক্র। উপজেলা পরিষদের উন্নয়ন তহবিলের ৩১ লক্ষ টাকা জালিয়াতি করে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
স্বাক্ষর ও সীল জালিয়াতি করে উপজেলার টেংরাবাজার ইউনিয়ন পরিষদের অবস্থানগত সুবিধার ৫ শতাংশ হিস্যার ২ লক্ষ ৯৫ হাজার ৫ টাকা আত্মসাৎ করেছে চক্রটি। এনিয়ে টেংরাবাজার ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান রামদুলারী নুনিয়া জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।
সাগর চুরির পরপরই পরিকল্পিতভাবে ইউএনও আফরোজা হাবিব শাপলা গত ৬ অক্টোবর সিলেট বিআরটিএ ও অনুপ চন্দ্র দাশ ১২ আগস্ট বড়লেখা উপজেলায় বদিল হন। অনুপ বড়লেখায় বদলি হওয়ার ৩ মাসের মাথায় রাজস্ব তহবিল থেকে ২২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে এ অনিয়মের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেকেই জড়িত। ইউএনও আফরোজা হাবিব শাপলা রাজনগর থাকাকালিন সময়ে নার্সারী মালিকদের ৫ লক্ষ ৪ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তা ফেরতও দেন। এঘটনার পরে তার বিরুদ্ধে বিভাগী কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় তিনি বেপরোয়া হয়ে উঠেন। উর্ধ্বতন মহল থাকে সেইফ করার জন্য তৎপরতা চালান। এঘটনায়ও তাকে বাঁচানোর জন্য উর্ধ্বতন একটি মহল সক্রিয়।
এ বিষয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো: বাদশা মিয়া বলেন, “আমি এও হিসেবে ফাইলে স্বাক্ষর করেছি। আমার ও ইউএনও মহোদয়ের স্বাক্ষর নিয়ে অনুপ এভাবে জালিয়াতি করবে বুঝতে পারিনি”।
সাঁট মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর অনুপ চন্দ্র দাশ আত্মগোপনে থাকায় তার স্ত্রী ঝুমি রানী সরকার বলেন, ”ইতিমধ্যে ৭১ লক্ষ টাকা ফেরত দিয়েছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ অনিয়ম আমার স্বামী এককভাবে করেননি। টাকা আপনারা এককভাবে দিয়েছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাসা বিক্রি করে দিয়েছি। তবে রাজনগর উপজেলা অফিসের একজন স্টাফের মাধ্যমে প্রস্তাব এসেছে উনার সময়কার স্টাফরা একটা অংশ দিবেন এবং উনার সময়কার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফরোজা হাবিব শাপলা ম্যাডামের সাথে কথা হয়েছে এবং উনিও আমার সাথে যোগাযোগ রাখতেছেন।
সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংক রাজনরগ শাখার ব্যবস্থাপকদয় বলেন, উপজেলা প্রশাসন থেকে এবিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সুযোগাযোগ করা হয়নি। ব্যাংকের সকল নিয়ম মেনে টাকা দেয়া হয়েছে। এক পর্যায়ে সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার প্রতিবেদককে বলেন, ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী সাংবাদিকদের সাথে কথা বলা যায় না।
সদ্য বিদায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফরোজা হাবিব শাপলা বলেন, “এ অনিয়মের সাথে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। সে আমার স্বাক্ষর নেয়ার পর অতিরিক্ত টাকার পরিমাণ বসিয়েছে। অনুপ ব্যাংক ম্যানেজারদের সমন্বয়ে এ জালিয়াতি করেছে। বিভিন্ন ব্যক্তির নামে এতো টাকা গেল কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আমাকে একবারও ফোন করেননি। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা ঘুষ নিতে পারে, তবে তহবিলের টাকা আত্মসাৎ করার সাহস কারো নেই”।
রাজনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতেমা তুজ জোহরা বলেন, “বিষয়টা তদান্তাধীন। এই মুহুর্তে আপনাকে কোনো তথ্য দিতে পারছি না এবং মন্তব্য করতেও পারছি না”।



















