সরওয়ার আহমদঃ স্থানীয় সরকার তথা ইউ/পি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে বাদপ্রতিবাদ এবং ক্ষোভ বিদ্রোহের খরব প্রতিদিনের নিডিয়াকে আলোড়িত করার পাশাপাশি নির্বাচনী মাঠকে ক্রযশ: সংঘাত মুখর করে তুলছে। প্রতিহিংসামূলক নির্বাচনী সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ৫০ জনেরও অধিক। আহতের সঠিক পরিমান বলা যাবে না। যেহেতু প্রধান প্রতিদ্বন্দি বিরোধীদল বি.এন.পি নির্বাচন বর্জন করেছে, সেহেতু শাসক দল আওয়ামীলীগের ভিতরেই বাদ প্রতিবাদ এবং ক্ষোভ বিদ্রোহ ঘুরপাক খাচ্ছে। মাঠ রাজনীতিতে বিরোধীদল যেখানে কোনঠাসা ও ¤্রয়িমান, সেখানে শাসক দলের মধ্যেই বিরোধীদলের উত্থান ঘটলে আশ্চর্য্য হবার কিছু নাই। এমতাবস্থায় আভ্যন্তরীন দ্বন্দ এবং প্রতিযোগীতার মুখে কে কাকে কোনঠাসা করবে এই ফন্দি ফিকির দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। ঐতিহ্যবাহী সংগঠন আওয়ামীলীগের জন্য এটি অবশ্যই সুখবর নয়। ইউ.পি নির্বাচন উপলক্ষ্যে চেয়ারম্যান পদের মনোনয়ন নিয়ে কণুই মারামারি ও রণ উম্মাদনাকে অগ্নিকান্ড পূর্ব ধু¤্র উদগীরণের মতোই প্রতীয়মান হচ্ছে।
দেশ স্বাধীন হবার পর ইউ.পি নির্বাচন হয়েছে কয়েক দফা বা অনেক। নির্বাচনে যারা প্রার্থী হয়েছিলেন তাদের বড়অংশেরই দলীয় সম্পৃক্ততা ছিলো। কিন্তু দলীয় পরিচিতিকে সাইনবোর্ড হিসেবে ধারণ করে নির্বাচনী বৈতরনী পায়ের ব্যাপারে তারা তেমন আগ্রহী ছিলেন না। কোন ইউনিয়নে দলীয় সমর্থক একাধিক প্রার্থী থাকলে দলীয় নেতৃবৃন্দ সমযোতার মাধ্যমে এক প্রার্থী রেখে অন্যদেরকে সরে দাড়ানোর ব্যাপারে চেষ্টা তদবির করেছেন। সমঝোতায় না এলে পারম্পরিক প্রতিদ্বন্দিতার মাধ্যমে নিজের জনপ্রিয়তার বলে একজন নির্বাচিত হয়েছেন। নি¤œ স্তর তথা ইউনিয়ন পরিষদে এ ধরণের নির্বাচনই সর্বজন গ্রাহ্য হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু এই সিষ্টেমে ব্যতিক্রম ধরানো হয়েছে দলীয় মোড়কের প্রবর্তন করে। ফলশ্রæতিতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেবে দল। তার সাথে দলীয় প্রতীকও বরাদ্দ দেয়া হবে। অর্থাৎ তৃণমূল পর্য্যায়ে দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই এ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু ক্রিয়ার বিপরীতে প্রতিক্রিয়া এবং হিতের পরিবর্তে বিপরীত বলে একটি কার্য্যকারণ আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। প্রায়োগিক পদ্ধতিতে কৃত্রিমতা থাকায় চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত হবার পর তৃণমূল সহ চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চত হওয়ার পর তৃণমূল সহ দলীয় নানান স্থরে অসন্তোষ ছাড়াও গাল গল্প এখন বিকশিত রূপ ধারণ করছে। জনান্তিকে প্রশ্ন উঠেছে- চেয়ারম্যান প্রার্থীর ঘাঠে কি নৌকা ভিড়ে তেল তদবির ছাড়া? পাঁচ বছর আগে অনুষ্ঠিত ইউ.পি নির্বাচন কালে মনোনয়ন বাগিয়ে আনতে নি¤œস্তর থেকে উচ্চ স্তর পর্য্যন্ত কোন প্রার্থীর কত খরচ হয়েছে গোপনীয়তার ফাক গলিয়ে তাহা কিছুটা হলেও বেরিয়ে এসেছিলো। এবারও তেল তদবিরে কার কত খসবে সেটিও অনাগত দিনে ভেসে উঠবে বৈ কি। অন্যদিকে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিতের পাশাপাশি “নৌকা প্রতীক” পাওয়ার লোভটাই যেনো প্রার্থীদেরকে বেশি মাত্রায় তাড়িত করছে। এই প্রতীক বাগাতে পারলে জয়ের আধাপথ নিশ্চিত হয়ে যাবে এমন একটি ধারণাও বদ্ধমূল রয়েছে। নৌকা প্রতীক নিয়ে এমন টানা হেচড়া সমর্থক এবং শুভানুধ্যায়ী মহলের মানসে কালো বলি রেখার উল্কী আকছে। নৌকা প্রতীকতো ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ। ১৯৫৪ সনের ঐতিহাসিক নির্বাচনে নৌকা স্বাধিকারের প্রতীক হয়ে উঠেছিলো। বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদের মরাগাঙ্গে নৌকা প্রতীক বান ডেকেছিলো। ১৯৭০ সনের সাধারণ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক স্বাধীনতার বার্তাবহ হয়ে বাঙ্গালী জাতিকে উজ্জীবিত করেছিলো। পরবর্তীকালীন নির্বাচন সমূহে নৌকা প্রতীকের ভূমিকা কি কমছিলো? সামরিক এবং স্বৈরাচার বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নৌকা প্রতীক প্রতিপক্ষের হৃৎকম্পের বিষয় হয়ে উঠেছিল। এই প্রতীকের অগস্ত্য যাত্রা এখন কোন দিকে? সংসদ কিংবা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক মানানসই। কিন্তু ইউ.পি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের ব্যবহার সাধারণ বোধগম্যদের নিকটও বেখাপ্পা ঠেকছে। নৌকার কান্ডারী চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন আসছে। আয়ুবী বেসিক ডেমোক্রেসীর আমল থেকে অদ্যাবধি পর্য্যন্ত ইউ,পি চেয়ারম্যান পদের মূল্যায়ণ করলে ইতিবাচকের চাইতে নেতিবাচকের প্রভাবই বেশী বলে গণ্য। কাবিখা, টেষ্ট রিলিক, এল,জি,এস,পি, বিধবা ও বয়স্কভাতা, কর্মসৃজন প্রকল্প, রিলিফ সামগ্রী বন্টন সহ সরকারী অপরাপর বরাদ্দের নয়ছয়ের আবর্তমাঝেই থিতু হয়ে আছে এই পদ কিংবা পদবী। এই পদবীকে ঘিরে তৃণমূলের উন্নয়নের লক্ষ্যেই নাকি ইউ.পি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীক বরাদ্দের আয়োজন। ধারনাটি মন্দ নয়। কিন্তু তেতুলগাছে আঙ্গুর ফল কি ধরে? গত ৫০ বছরে স্থানীয় সরকার তথা ইউ,পির অধীনে যে পরিমান বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তার অর্ধেকও যদি বাস্তবায়িত হতো তাহলে গ্রাম জনপদের চেহারা থাকতো অন্য রকম। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, শাসকদল আওয়ামীলীগের মনোনয়ন নিয়ে তোলপাড় চলছে তৃণমূল পর্য্যায়ে। ইউ,পি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাই এবং মনোনয়ন প্রদানে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অবকাশ বোধ হয় দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেই। কেন্দ্রীয় পর্য্যায়ে একটি বোর্ড সম্ভবত বিষয়টি নিশ্চিত করছে। কিন্তু এ প্রক্রিয়াতে নিশ্চয়ই গড়মিল ধরেছে বিধায় বিতর্কিত প্রার্থীরা মনোনয়ন পাচ্ছেন। স্বাধীনতা বিরোধীদের উত্তরাধিকারী এবং জামাত বি,এন,পি থেকে আগতরাও মনোনয়ন লাভ করছেন। মনোনয়ন যদি যথাযথ হতো তাহলে প্রথম ধাপে নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নকে চ্যালেঞ্জ করে ৪০ জনের অধিক বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারতো না। দ্বিতীয় ধাপেও উল্লেখযোগ্য হারে বিদ্রোহী প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। নিশ্চয়ই তারা জনপ্রিয়তার বলে নির্বাচিত হয়েছেন। জনগণ তাদেরকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করলেও দলীয় মনোনয়ন বোর্ড হয়ত সেভাবে মূল্যায়ণ করে নি। এসমস্ত জনপ্রিয় প্রতিনিধিদেরকে কি ফেলে দেওয়া যায়? দলীয় সিন্ধান্ত উপেক্ষা করে যারা নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছে তাদেকে যদি দল থেকে বহিষ্কার করা হয় তাহলে সেটিও হবে আত্মঘাতী। এরাতো তৃণমূল পর্য্যায়ে দলীয় ষ্টেকতোল্ডার। তাদের সংখ্যা হবে কয়েক হাজার। এসমস্থ খুটিকে যদি উপরে ফেলা হয় তাহলে লোম ছাটতে গিয়ে কম্বলের অবস্থা বিপন্ন হয়ে যাবে। অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনে ঐতিহ্যবাহী নৌকা প্রতীকের পক্ষে নিজের গাটের কড়ি খর্চ করে যারা শ্রম ঘাম ঝরায় অবস্থা বৈদণ্যে এবং অস্তিত্বের প্রশ্নে তারা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে নৌকার বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছে কোন প্রকার তোয়াক্কা না করেই। প্রত্যেক জেলা এবং উপজেলাতে এই দৃশ্যপট প্রকাশ্য হয়ে উঠছে। বলা বাহুল্য প্রত্যেকটি রাজনৈতিক সংগঠনের ভিত্তি হচ্ছে তৃণমূল। বিশেষত: আওয়ামীলীগের বিপর্য্যয় টেকাতে তৃণমূলই বার বার প্রতিরোধী দেয়াল হিসেবে গণ্য হয়েছে। ইউ,পি নির্বাচনে আত্মঘাতী তাড়নায় এবং দলীয় মনোনয়নের নামে এই সুরক্ষিত দেয়ালে কি হাতুরী শাবল পেঠানো হচ্ছে?