নাহি কাজ তো খই ভাঁজ- এ ধরণের একটি প্রবচন বাংলা ভাষায় আছে। কোনো কাম কাজ না থাকলে উনুনে আগুন চরিয়ে খঁই ভাঁজলে অন্তত অলস সময়টাকে পার করা যাবে তো। কিন্তু এখানেও তো সমস্যা। তপ্ত কড়াইয়ের ফোটন্ত্র খঁই উড়ে এসে যদি চোখ বরাবর পড়ে, তাহলে তো ঘোর বিপদ। দেশিয় রাজনৈতিক হেঁসেলে বোধ হয় খই ভাঁজার পক্রিয়া চলছে। রাজনীতিতে পক্ষ প্রতিপক্ষ নিয়েই রাজনৈতিক ধারা আবর্তিত হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে রাজনৈতিক শিল্পকলা বিকশিত হবার পাশাপাশি গনতন্ত্রে ও আসে প্রাণস্পন্দন। কিন্তু বর্তমানে বিরাজিত প্রেক্ষাপটে পক্ষ আছে কিন্তু প্রতিপক্ষ নেই। মুদ্দাকথায়, রাজনৈতিক মঞ্চে শাসক দলের স্বপ্র্রতীভ অবস্থান পরিলক্ষিত হলে ও বিরোধী দলীয় অবস্থান অনেকাংশে নি®প্রভ তথা ক্ষীনতর। এই প্রেক্ষাপটে দলের ভেতরে আড়াল কিংবা দৃশ্ম্রমান বিরোধী দল গজিয়ে উঠলে আশ্চর্য হবার কি আছে। বিস্তারিত ভাবে এ প্রসঙ্গে আসার আগে আনুসংঙ্গিক কিছু বিষয় উপস্থাপনের প্রয়োজন রয়েছে। শাসক দল আওয়ামীলিগের কেন্দ্রীয় সাধারন সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুর কাদের বিরোধী পক্ষের নিকট নানা ভাবে সমালোচিত হলেও রাজনৈতিক তাত্ত্বিক হিসেবে তার বোধিজ্ঞান অনস্বীকার্য্য। ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে গন রাজনীতির সর্পিল পথ অতিক্রম করে তিনি এ পর্যয়ে উন্নীত হয়েছেন। তার অভিজ্ঞানের পরিসর বিস্তৃত। গনতান্ত্রিক সিষ্টেম কে তিনি একটি দ্বিচক্রযানের সাথে তুলনা করে বলেছেন- সাইকেল চলতে হলে দুটি চাকার প্রয়োজন। এক চাকা সচল এবং অন্য চাকা অচল হলে চলবে কিভাবে ? তাত্ত্বিক এ বক্তব্য বরহক্ক প্রণিধান যোগ্য। গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় শাসক দলের সমান্তরালে শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্তিতি না থাকলে সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা কোন পর্যায়ে উপনীত হয়, বহমান সময়ই বোধহয় তার জ্বলন্ত উদাহরণ। রাজনৈতিক ময়দানে বিরোধী দল না থাকার সমতুল্য। এমতাবস্থায় প্রতিবাদী চেতনা নুয়ে পড়ে। অব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হবার সাহস পাচ্ছে না কেউ। কারণ, প্রতিবাদকারীকে সমর্থন দেওয়ার মতো কোনো শক্তি মাঠে নেই। কলম সৈনিকদের কলমও সাহসী হচ্ছে না। রিপোর্টের বিপরীতে যদি তুফান আসে তাহলে আশ্রয় নেবার মতো জায়গা কোথায় ?
শাসক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অবদান বা কৃর্তৃত্ব কতটুকু সে মুল্যায়নের সময় এখনো আসে নি। কিন্তু বিরোধী দল হিসাবে আওয়ামী লীগের ভূমিকা ছিল অনন্য এবং ঐতিহাসিক। জন্মের পর থেকে এই দলটি যথাযত বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে। সরকারি অনাচার এবং দমন নীতির বিরুদ্ধে নিরন্তর আন্দেলন সংগ্রাম গড়ে তুলেছে বারবার। নেতা কর্মীরা নির্যাতন নিপীড়নকে ভ্রুকুটি প্রদর্শন করে রাজপথে সৈনিক হয়েছে অফুরন্ত প্রত্যয় এবং দুর্দমনীয় সাহস নিয়ে। গনতান্ত্রিক রীতিনীতি পালনে ও তাদের চর্চা ছিল। ১৯৬৯ সনের গন অভ্যুত্থান এবং একাত্তর সনের অসহযোগ আন্দোলন যখন মার্গীয় দশায় তখনও আওয়ামীলীগ কোনো হঠকারি পদক্ষেপ গ্রহন করে জাগ্রত আন্দোলকে সন্ত্রাসী এবং বিধংসি পর্যায়ে উপনীত করেনি। তার বিপরীতে হালআমলের বিরোধী দল বিএনপি এবং তদীয় নেতৃত্বাধীন জোট এর অবস্থানটি সনাক্ত করনও প্রয়োজন। জন্ম কুষ্টি স›ধান করলে সহজ প্রতিয়মান হয় যে এ দলটি প্রকৃত বিরোধী দল হিসেবে গড়ে উঠেনি। সেনা শাসক জিয়াউর রহমান তার শাসন কে পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দল থেকে সুবিধাভোগীদেরকে টেনে এনে তাদের সমন্বয়ে একটি দলীয় অবকাঠামো খাঁড়া করেছিলেন, যেভাবে তার পূর্বসুরি আইয়ুবখান ক্ষমতাসীন অবস্থায় কনভেনশন মুসলীম লীগের জন্ম দিয়েছিলেন। দলছুট এবং সুবিধা ভোগিদেরকে নিয়ে জোরাতালির মাধ্যেমে শাসন কার্য্য পরিচালনা করা গেলেও রাজপথের মতো আন্দোলনের বন্ধুর পথ পরিক্রমন করানো যায় না। এরা তো ত্যাগী আদর্শিক ও লড়াকু নয়। ২০১৪/১৫ সনে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী সমগোত্রীয়রা লক্ষ্যনির্ধারণ করে আন্দোলনের মাঠে নেমেছিল। কিন্তু সফল হতে পারেনি। আন্দোলনের নামে মাঠে নেমে তারা যে তান্ডব লীলা শুরু করেছিল সেটিকে আন্দোলন না বলে সেবোটাজ অথবা যুদ্ধের সাথে তুলনা করা চলে। এই যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকদের যে অবস্থা হয় সেই অবস্থা ধারণ করেছে বিএনপি ও তার সমগোত্রীয়রা। ঘর এবং ঘাট ক্ষতবিক্ষত হবার পর এখন তাদের বিকলাঙ্গ এবং ফঁতুর দশা। এহেন প্রেক্ষাপটে বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়ে অন্য একটি দল যে স্বরূপে খাড়া হবে এমন আশাবাদও রাজনৈতিক অঙ্গণে অনুপস্থিত। বিরোধী রাজনৈতিক অঙ্গণে এমন মরুময় ও ল্যাজে গোবরে অবস্থা দেশীয় রাজনৈতিক সুস্থতার পরিচালক নয়। দেশ ও জাতির জন্য এটি এক হতাশাময় প্রেক্ষাপট। এই রাজনৈতিক শূন্যতার প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে তার আলামত বোধহয় শুরু হয়ে গেছে।
ক্ষমতায় থাকলে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে মোসাহেব এবং হিতাকাঙ্খীদের অভাব হয় না কোনো কালেই। শাসক দল আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবার নয়। যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই আওয়ামীলীগের সরব উপস্তিতি। সমর্থকদের পাশাপাশি গজিয়ে উঠা সংগঠন ও বাড়ছে। লীগ এখন কতটা সে হিসাব মিলানো ভার। আওয়ামী তরুণ লীগের ব্যানার দেখে প্রশ্ন উঠেছে- তাহলে যুবলীগ কী শেষ? তরুণ লীগ যদি হতে পারে তবে আওয়ামী প্রবীন লীগের ও প্রয়োজন আছে। ৬০,৭০,৮০এবং ৯০ দশকে যারা মাটি কাঁমড়ে এবং নানামুখী ভীতি উপেক্ষা করে দলীয় অবস্থানকে ধরে রেখেছিল তারা এখন প্রবীণদের খাতায়। নব্য আওয়ামীলীগ তথা তরুণ তুর্কীদের কনুই ধাক্কায় তাদের অবস্থান এখন সাইড লাইনে। তরুণ তুর্কি এবং সুবিধা ভোগীদের আসফালন দেখে দলীয় সভা নেত্রী প্রশ্ন তুলেছিলেন -এরা কারা? পরবর্তীতে দলীয় সম্পাদক তাদেরকে চিহ্নিত করেছিলেন “কাউয়া” হিসেবে। কিন্তু কাউয়া দুটি তাড়ালে দশটি ছুটে আসে। এটাইতো কাউয়া স্বভাব। উচ্ছিষ্ট ভোগ করেই তারা র্তপ্ত নয় । মূল উপাদান গ্রাস করতেও উদ্যত।
ক্ষমতাসীন দলের কলেবর প্রসারিত এবং বিরোধী দলীয় অবস্থান সঙ্কুচিত হলে যে উপসর্গ সৃষ্টি হয় সেটির নাম গৃহ বিরোধ বা অন্তর্দলীয় কোন্দল। ক্ষমতাশীল আওয়ামী লীগেরও তার ছায়া পড়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবীণ আওয়ামীলীগার বলেছেন, যেহেতু বিরোধী দল মাঠে নেই, সে কারণে দলেই বিরোধী গ্রুপের আবির্ভাব ঘটেছে। আদর্শিক কারণেই হোক কিংবা হালুয়া রুটি ভাগাভাগির দ্বন্দেই হোক দলের ভেতরে গ্রুপিং সহ প্রতিদ্বন্দির উত্থান ঘটছে। বিরোধী দলকে মোকাবেলার বিষয়টি গৌণ হয়ে উঠায় দলীয় প্রতিদ্বন্দিকে মোকাবেলা করাই এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে। কে কাকে কিভাবে কোনঠাসা বা সাইজ করবে এটাই এখন রাজনীতির উপজীব্য বিষয়। এমতাবস্থায় অনুমান করা যায়- বিভিন্ন স্থানে অপঘাতে যে সমস্থ আওায়ামীলীগ নেতা কর্মীর মৃত্যু হচ্ছে তার নেপথ্যে রয়েছে দলীয় কোন্দল। পৌর নির্বাচনে যে সকল মেয়র বা কাউন্সিলর দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে যারা অবতীর্ণ হয়েছেন বা হচ্ছেন তার নেপথ্যে রয়েছে দলীয় বিরোধের প্রভাব। এই স্থির চিত্র তো সব খানেই। দলীয় বিরোধের সূত্র ধরে নোয়াখালীর কম্পানীগঞ্জ এবং মৌলভীবাজারের রাজনগরে ঘরের আগুন এখন বাইরে চলে এসেছে। নোয়াখালীর বসুর হাট পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী হয়ে কাদের মির্জা নিজ বড় ভাই এবং দলীয় সেক্রেটারি ওবায়দুর কাদের সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের কড়া সমালোচনা করে লাইম লাইটে চলে এসেছেন। তার নীল কন্ঠ উচ্চারণ বেশ প্রণিধান যোগ্য। ধারণা করা হচ্ছে, জেলা সেক্রেটারি একরামুল কবির চৌধুরী এমপির সাথে কাদের মির্জার বিরোধ রয়েছে। এই বিরোধ এখন সংগঠনের চৌহদ্দী অতিক্রম করে সংঘাত সংঘর্ষে উপনীত হয়ে ক্ষান্ত থাকেনি। অধিকন্ত্র এক উদীয়মান সাংবাদিকের প্রাণও কেড়ে নিয়েছে।
অন্য দিকে রাজনগরে উপজেলা চেয়ারম্যান শাহাজাহান খান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান মিলন বখতের দ্ব›ধ এখন খোলামেলা রূপ নিয়েছে। রাজনগর সদরে দুপক্ষের সংঘর্ষে ১৫/২০ জন আহত হয়েছেন। সংঘর্ষ পরবর্তীতে মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ঘোষনা করেছেন, শাহাজাহান খান বিএনপি ও জামাত সমর্থনপুষ্ট। তার সাথে আওয়ামীলীগের কোনো সংশিষ্টতা নেই উল্লেখ করে উক্ত উপজেলা চেয়ারম্যানের নানাবিধ অপকর্ম তুলে ধরেন। অন্য দিকে শাহজাহান খান পাল্টা এক সম্মেলনে নিজেকে আওয়ামী ঘরানার দাবি করে প্রতিপক্ষের অপকর্মের বর্ননা দেন। রাজনগর থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহজাহান খান ছিলেন যুক্তরাজ্যে। গত উপজেলা নির্বাচনে দেশে এসে দলীয় মনোনয়ন লাভে ব্যার্থ হবার পর প্রতিদ্বন্দিতায় অবতীর্ণ হন। নির্বাচনে জেতার যেসমস্ত মেকানিজমের প্রয়োজন হয় তা অবলম্বন করার পরও তার ছিল বাড়তি আকর্ষণ। এবং সেটি হচ্ছে নয়া নবীনত্ব। অপর দুই প্রার্থীর মধ্যে একজন ছিলেন চলমান উপজেলা চেয়ারম্যান এবং অপরজন ছিলেন দুবারের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। একজন থানা সভাপতি এবং অপরজন সম্পাদক। এমতাবস্থায় উঠতি ভোটাররা পুরাতনকে ফেলে নতুনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এছাড়া চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আছকির খান সকাল এগরোটায় নির্বাচন বয়কটের ঘোষনা দিলে তার সমর্থকরা শাহজাহান খানের শিবিরে চলে আসায় তার জয় নিশ্চিত হয়েছিল । প্রতিদ্বন্দি দুই মহারথিকে পরাজিত করে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবার পর শাহজাহান খান নিজেকে হিরো এবং দাপুটে মনে করারই কথা। এবং তার নজির ও স্থাপন করেছেন ইতিমধ্যে। রাজনগরকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছেন তিনি। অন্য দিকে তার চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছেন আওয়ামীলীগ সেক্রেটারি এবং ইউপি চেয়ারম্যান মিলন বখত। তাকে সমর্থন দিচ্ছেন ৫/৬ জন ইউপি চেয়ারম্যান। উভয়ের মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দিতা সৃষ্টি হয়েছে সেটা কারো কারো মতে আধিপত্যকেন্দ্রীক। দুর্মুখদের মতে- বিভিন্ন উৎস নিয়ে ভাগ বাটোয়ারার লড়াই।এখানে সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের অবকাশ নেই। তবে ডালমে কোচ কাঁলা হ্যায় – একথা তো বলা যায় । ডালের এই কাঁলা অংশ ডাল সহ ঘটি নষ্ট করে দেওয়ার জন্য যতেষ্ট নয় কী?
লেখক- সিনিয়র সাংবাদিক