সরওয়ার আহমদঃ
সুস্থ বিবেক ও প্রখর দৃষ্টির আলোকে এ কথাটি প্রশ্নাতীত ভাবে সত্য যে, ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্টে সপরিবারে বঙ্গঁবন্ধু হত্যা বিশ্ববাস্তবতার মধ্যে একটি নিকৃষ্ট ও কলংকিত ঘটনা হিসেবেই গণ্য। সাম্রাজ্যবাদের ইন্ধনে এবং তাদের দেশীয় বশংবদ তথা কেনা ভারবাহীদের যোগসাজসে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্র নায়ক হত্যা এবং ক্ষমতার পট পরিবর্তন কোন নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো সপরিবারে রাষ্ট্রনায়ক হত্যার এমন নারকীয় ও নৃশংসতম ঘটনা বিশ্বের মধ্যে বিরল এবং নজির বিহীন। ঘাতক আনুকূল্যে এই নৃশংসতম ঘটনার আইনী প্রতিকারের পথ রুদ্ধকরণের বিষয়টিও নজির বিহীন। কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতার দেয়ালও যে ভেঙ্গে যায় এবং ঘাতক তার কৃত অপরাধের সমুচিত শাস্তি বিলম্ব হলেও ভোগ করে, সেটিও প্রমানিত সত্য। নিয়তি এবং ইতিহাসের অভ্রান্ত পরিক্রমার নিকট অশুভ পরাক্রম পদানত হয়ে আসছে কাল থেকে কালান্তরের ধারায়। এই বাস্তবতা অস্বীকারের কোন বিকল্প নেই। যে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (এবং পরবর্তীকালে আইন) দ্বারা বঙ্গঁবন্ধু হত্যা মামলার পথ রুদ্ধ করা হয়েছিলো, ১৯৯৬ সনে সেই রুদ্ধ কপাট খুলে গিয়েছিলো। ইনডেমনিটি আইন বাতিল হবার পর ১৯৯৬ সনে বঙ্গঁবন্ধুৃ হত্যা মামলা শুরু হয়েছিলো আর তার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছিলো ২০০৯ সনে। মামলাটি বিচারাধীন ছিলো প্রায় একযুগ পর্যন্ত। অথচ মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী এবং ইন্ধিরা গান্ধী হত্যা মামলা নিষ্পত্তি হতে বছর দিনও সময় লাগেনি। কিন্তু বাংলাদেশের স্থপতি ও প্রেসিেিডন্ট হত্যা মামলাটি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে একযুগ বিলম্বের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থারও একটি মন্দ নজির হিসেবেই গণ্য।
১৯৯৮ সনে ঢাকার যেমন জজকোর্টে মামলাটির রায় ঘোষিত হবার পর দন্ডপ্রাপ্তদের ডের্থরেফারেন্স হাইকোর্টে পাঠানো হলে রেফারেন্সটি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চের উপর শুনানীর দায়িত্ব বর্তায়। কিন্তু বেঞ্চের তৎকালীন বিচারপতি আমীরুল কবীর ডের্থরেফারেন্সটি শুনানীর ক্ষেত্রে বিব্রতবোধ করেন। তারপর মামলাটি অপর বেঞ্চে স্থানান্তরিত হলে সেই বেঞ্চের দুই বিচারপতি রুহুল আমিন ও আব্দুল মতিন একইভাবে বিব্রতবোধ করেন। বিচারপতি পদটি অবশ্য তার আগেই বিতর্কিত হয়ে উঠেছিলো। এই দেশে দুই বারের সামরিক শাসনকে জায়েজকরণ, সামরিকশাসক কর্তৃক দল গঠনের ক্ষেত্রে বিচারপতিদেরকে ব্যবহার করা, কিংবা পাতানো নির্বাচন কে সিদ্ধ ঘোষণার ক্ষেত্রে বিচারপতিদেরকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে বসানোর দিকটি ধারণায় নিলে বিচারপতি কর্তৃক বঙ্গঁবন্ধু হত্যা মামলার শুনানীর ব্যাপারে বিব্রত বোধ কোনো অসম্ভব বিষয় নয়। যারা বিব্রতবোধ করেছিলেন তারা হয়তো পাকিস্তান পন্থী নয়তো ঘাতকচক্রের পক্ষশক্তি ছিলেন বলেই একটি দেশের স্থপতি ও প্রেসিডেন্ট হত্যা মামলার শুনানীর ক্ষেত্রে তাদের অনীহা ছিলো। অবশ্য সব বিচারপতিকে একই মানদন্ডে পরিমাপ করা সঙ্গঁত নয়। বঙ্গঁবন্ধু হত্যা মামলার ডের্থরেফারেন্স শুনানীর ক্ষেত্রে বিব্রত বোধের নাটকের পর অপর বেঞ্চে মামলাটির শুনানী হয়। শুনানী শেষে ২০০০ সনে মামলাটির বিভক্ত রায় ঘোষিত করেন বেঞ্চের দুই বিচারপতি। এমতাবস্থায় তৃতীয় বিচারপতির বেঞ্চে মামলাটি নীত হয় ২০০১ সনের ফ্রেবুয়ারি মাসে। বিচারপতি জনাব ফজলুল করিম একই সনের ৩০ এপ্রিল তারিখে তার রায়ের মাধ্যমে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। কিন্তু রায়ের বিরুদ্ধে আপীলের সুযোগ ছিলো। কিন্তু আপীল কোর্টে মামলাটি নীত হলে সেটি পড়ে থাকে হিমাগারে। কারণ তখন ক্ষমতায় এসেছিলো বি.এন.পি জামায়াত জোর্ট। হাইকোর্টের আপীল বিভাগে বিচারক সংকটের অজুহাতে বঙ্গঁবন্ধু হত্যা মামলাটি পড়ে থাকে পাঁচ বছর । তাতে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফায়দা ভোগী ছিলো বি.এন.পি, জামায়াত এবং তাদের পক্ষ শক্তি। তাই মামলাটিকে স্থির মস্তিস্কেই চেপে রাখা হয়েছিলো। কিন্তু ন্যায়ের দন্ড এবং নির্দোষ রক্তের ধারা আপনমহিমা বলে প্রতিবন্ধকতা টপকে স্বমূর্তিতে আর্বিভূত হয়। তাই ২০০৭ সনে তত্ত্ববধায়ক সরকারের আমলে পুনরায় আপীল বিভাগে মামলাটি চালু হয় এবং শেষ হয় ২০০৯ সনে। মামলায় ২০ জন আসামীর মধ্যে ১২ জন সামরিক অফিসারের মৃত্যু দন্ড দেয়া হয়। তন্মধ্যে আটক পাঁচ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়। বাকি ৭ জন পলাতক অবস্থায় বিদেশে রয়েছে।
এখানে প্রাসঙ্গিত যে, বঙ্গঁবন্ধু হত্যার পর ২১ বছর পুন:পৌণিক সামরিক এবং স্বৈরশাসনের পর ১৯৯৬ সনে বঙ্গঁবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচন বিজয়ী হয়ে আওয়ামীলীগ ক্ষমতাসীন হলে বঙ্গঁবন্ধু হত্যার বিচারের দাবীটি জাতীয় দাবি হিসেবে উত্থিত হয়। এ প্রেক্ষাপটে জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইনটি বাতিল হয়ে যায়। এমতাবস্থায় বঙ্গঁবন্ধুর রেসিডেন্সিয়াল পি.এস.আ.ফ.ম মোহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে ফৌজদারী আইনে ১৯৯৬ সনের ২ অক্টোবর তারিখে ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এই মামলাতে দৃশ্যমান আসামী হিসেবে ২৩ জনকে শনাক্ত করা হয়েছিলো। এই মামলার বিচারিক নিষ্পত্তি এবং দন্ডপ্রাপ্তদের একাংশের দন্ড কার্যকর হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তারপরও শেষ হয়ে হইলো না শেষ” এর একটি অন্তরাল আর্তি গোঠাজাতি সত্তার মধ্যে নীরবে নিভৃতে অনুরণ তুলেছে। সপরিবারে বঙ্গঁবন্ধু হত্যার ক্ষেত্রে কি কেবল দন্ডপ্রাপ্ত আসামীরাই জড়িত? তার বাইরে নেপথ্য শক্তি হিসেবে আরো কারা এবং কোনশক্তির যোগসাজস বা ইন্ধন ছিলো, তাদেরকে শনাক্তকরণ ও মুখোশ উন্মেচন কালের বাস্তবতার আলোকে প্রয়োজন। এ ব্যাপারে নির্বিকার থাকলে অনাগত দিনের ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে গবেষক, বুদ্ধিজীবী, এবং অনুসন্ধিৎসু মহলকে। সময়ের ফাঁক গলিয়ে বড় বড় ঘটনায় চেপে রাখা সূত্র বিলম্বে হলেও কালের তলানী থেকে বুদ বুদের মতো উঠে আসে অনুসন্ধানী মন্ত্রের ডাকে। সাত দশক আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান প্রকাশ্য জনসভায় আততায়ীর গুলিতে নিহত হবার পর পরিকল্পিতভাবে ঘাতককে সাথে সাথে হত্যা করা হয়েছিলো। ফলে ঘটনার মোটিভ চাপা পড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এখন বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে নেপথ্য চাল। লিয়াকত হত্যার নেপথ্যে ছিলো পাঞ্জাবী ষড়যন্ত্র এবং মার্কিন ইন্ধন। ভারতের ইউপি প্রদেশের বাসিন্দা লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হবার পর পূর্ব পাকিস্তানের একটি শূণ্য আসন থেকে উপনির্বাচনের মাধ্যমে বিনাপ্রতিদ্বন্দিতায় পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ কারণে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দের ক্ষেত্রে পূর্বাঞ্চলের প্রতি লিয়াকত আলী খান কিছুটা নমনীয় ছিলেন। পাঞ্জাবী চক্র এ নমনীয়তাকে সহ্য করতে পারছিলো না। এছাড়া মোহাজের (ভারত থেকে আসা ) নেতৃত্বকে পাঞ্জাবীরা মেনে নিবে কেনো? এ কারণে খোদ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকেও অন্তিমকালে সুনজরে দেখা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান অনেকটা স্বাধীনচেতা থাকায় পাকিস্তানের নব্যপ্রভু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত বিভিন্ন ফর্মুলাকে মেনে নিতে পারছিলেন না। ফলে মার্কিন ইন্ধনে এবং পাঞ্জাবী যোগসাজসে লিয়াকত হত্যা সংঘটিত হয়েছিলো। শুধু লিয়াকত আলী খান নন, তৃতীয় বিশ্বের স্বাধীনচেতা অন্যান্য রাষ্ট্র নায়ক হত্যা এবং সরকার উচ্ছেদ হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী ইন্ধনও দেশীয় যোগসাজসে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা এবং তার সরকার উচ্ছেদও ব্যতিক্রমী কিছু নয়।
বলা বাহুল্য, পকিস্তান সৃষ্টির পর ভূ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই রাষ্ট্রের উপর মার্কিন প্রভাব ছিলো প্রচ্ছন্ন। নানামুখী সঙ্খটের মুখে পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখাটাই ছিলো আমেরিকার মূল উদ্দেশ্য। পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের দূরত্ব এবং পূর্বের প্রতি পশ্চিমের বৈষম্য নীতিকে ধারণায় রেখে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আলাদা বরাদ্দ নিশ্চিত করেছিলো। কিন্তু তারপরও বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার ও স্থায়ত্ব শাসনের দাবী দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছিলো। এ কারণে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি মার্কিন শ্যেন দৃষ্টি ছিলো ষাটের দশক থেকেই। ১৯৭০ সনের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগের নিরঙ্কুশ বিজয়কে আমেরিকা সুনজরে দেখেনি। ১৯৭১ সনের উত্তাল মার্চ মাসে আমেরিকা তার পূর্ব-পাকিস্তান দূতাবাসের মাধ্যমে শেখ মুজিবকে জানান দিয়েছিলো- কোন বিচ্ছন্নতাবাদী আন্দোলন বা তৎপরতায় তাদের (আমেরিকা) কোন সমর্থন বা সায় থাকবে না। বঙ্গঁবন্ধু তখন মার্কিন হুশিয়ারিকে তোয়াক্কা করেননি। ৭১ সনের ২৬ মার্চ বঙ্গঁবন্ধু কতৃক স্বাধীনতা ঘোষণা এবং সর্বাত্মকভাবে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা যখন ঘটে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এবং অবস্থান স্পষ্ট হয়ে উঠে। রাজধানী ঢাকা সহ বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে হত্যাকান্ড ও নারকীয় তান্ডব চালিয়েছিলো, ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের কনসাল আর্চার ব্লাড তার সমুদয় বিবরণ মার্কিন সরকারকে অবহিত করার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবতাকে পাশ কাটিয়ে পাকিস্তানী জান্তাকে সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছিলো তার সাম্রাজ্রবাদী চরিত্র বলে। ৭১ সনের শেষ দিকে মার্কিন কংগ্রেস পাকিস্তানকে যুদ্ধ সরনঞ্জাম সরবরাহের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করলে, তৎকালীন নিক্সন সরকার সৌদিআরব এবং ইরানের মাধ্যমে পাকিস্তানে যুদ্ধ বিমান সহ সমরাস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখে। অর্থাৎ পাকিস্তানের অখন্ডতাকে ধরে রাখতে মার্কিন সরকার ছিলো কৃতসংকল্প। ৭১ সনের ডিসেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মৈত্রবাহিনীর নিকট পাকিস্তানী বাহিনীর পরাজয় যখন অবধারিত হয়ে উঠেছিলো তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোঁপসাগরে সপ্তম নৌবহর প্রেরণেও পিছপা হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ধমক ও বৈরৗপণাকে অগ্রাহ্য করে যখন স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটে, তখন মার্কিন প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার তার ব্যক্তিগত ডাইরিতে লিখেছিলেন- বাংলাদেশের অভ্যুদয় তার ব্যক্তিগত পরাজয়ের সমতুল্য। সুতরাং বাংলাদেশ ও তার প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি তৎকালীন মার্কিন সরকারের বিদ্বেষ ও প্রতিশোধ পরাণয়তা থাকবে বৈকি। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সনের ফ্রেব্রুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহে কলকতার গড়ের মাটের ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গঁবন্ধুর ভাষণের একটি উক্তিছিলো কুটনৈতিক তীর নিক্ষেপ তুল্য। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার জনগণের সমর্থন থাকায় তাদেরকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। কিন্তু আমেরিকার সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারছিনা । এ উক্তিটি নিস্কন কিসিনঞ্জারের জন্য ছিলো কাঁটা ঘায়ে নূনের ছিটা দেওয়া সমতুল্য। ১৯৭৩ সনে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গঁবন্ধুর বক্তব্য ছিলো- বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ শোষক, অন্যভাগ শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে। বক্তব্য শুনে কিউবার স্থপতি ও প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ট্রো বলেছিলেন, এখন থেকে আমি নই ,শেখ মুজিব হবেন আমেরিকার প্রধান টার্গেট। আমেরিকা তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের যে নেতার প্রতি বিরাগ ভাজন হয়ে যায়, তার বিপদ থাকে পদে পদে। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি মার্কিন বিরাগ ভাজনের আরও কারণ ছিলো। বিশ্বব্যাংকের প্রধান লগ্মিকারক হচ্ছে আমেরিকা। ১৯৭১ সনের ২৫ মার্চের আগ পর্যন্ত, পাকিস্তান সরকার বিভিন্ন খ্যাতে বিশ্বব্যাংক থেকে যে ঋণ বরাদ্দ পেয়েছিলো সেই ঋণ অর্ধেক বাংলাদেশকে পরিশোধের তাগিদ দিয়েছিলো বিশ্বব্যাংক। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার সেই ঋণ পরিশোধে শর্তারোপ করেছিলো। বলা হয়েছিলো, সাবেক পূর্ব-পাকিস্তানের যে সমস্ত প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংক ঋণ দিয়েছিলো, শুধু সেই টাকা ব্যতীত অন্য বরাদ্দের টাকা পরিশোধ সম্ভব নয়। বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্তে মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র বেজায় নাখোশ হয়েছিলো। এমতাবস্থায় সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দিলেও স্বাধীনতাকামী আওযামীলীগ সরকার তথা বঙ্গঁবন্ধু সরকার উচ্ছেদের ক্ষেত্রে মার্কিন পরিকল্পনা এবং ইন্ধন ছিলো প্রচন্ডভাবে। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পাকিস্তান সরকারের ভূমিকা ছিলো আরও বিদ্বেষভাবাপন্ন এবং ধারালো। পাকিস্তানের অখন্ডতাকে ছিন্নকরে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে পাকিস্তান শুধু বিব্রত ছিলো না, অঙ্গঁহানি এবং উপনিবেশ হারানোর বেদনায় দেশটি ছিল জর্জরিত ও ম্রিয়মান। বাংলাদেশের প্রতি পাকিস্তানের বিদ্বেষ বিষ খন্ডিত নয় বরং ব্যাপক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৯৪ হাজার যুদ্ধবন্দীর হিসাব আছে। কিন্তু কতজন পাকসেনা নিহত হয়েছে সেই হিসাব নেই । তার পরিমাণ লক্ষাধিক হবে। তাদের পরিবারবর্গ গোটা পাকিস্তানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারাতো বাঙ্গাঁলি ও বাংলাদেশের প্রতি অভিসম্পাত দেবেই। তাই শুরু থেকে অধ্যাবধি পর্যন্ত বাংলাদেশের উপর পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র জাল বিস্তৃত রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের জনক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নায়ক বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিব হত্যা এবং তার নেতৃত্বাধীন সরকার উচ্ছেদের প্রধান সংগটক হচ্ছে পাকিস্তান। ১৯৭১ সনে পাকিস্তান সরকারের হাতে আটক বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবকে যেকোন ভাবে হত্যার জন্য তৎকালীন সামরিক শাসক ইয়াইয়া খান প্রতিশ্রতিবদ্ধ ছিলো। কিন্তু বাঁধ সেধেঁছিলেন জুলফিকার আলী ভুঠ্রো। তিনি বলেছিলেন, মুজিব হত্যার দায়ভার আমরা নেবো কেনো? তাকে তার দেশের মাটিতেই হত্যা করা হবে। ভুঠ্রোর এই কথাটি কত তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী ছিলো সেটা প্রমাণিত হয়েছে ৭৫ সনে। শুধু পাকিস্তান কেনো তৎকালীন চীন সরকারেরও যোগসূত্রতা মিলবে ৭৫ সনের ট্রাজেডির ক্ষেত্রে। চীনও চায়নি পাকিস্তানের অখন্ডতা নষ্ট হোক। জাতিসংঘের সদস্য ভুক্তির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের বিপক্ষে ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করেছিলো চীন। তাই যথাযথভাবে সেই সময়ে আাওয়ামীলীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের স্লোগান ছিলো- মাও ভুঠ্রো নিক্সন, বাংলাদেশের দুশমন। এই ত্রয়ী শক্তির সাথে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রাষ্ট্রেরও পরোক্ষ যোগসাজস থাকাটা অযোক্তিক নয়। ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর নভেম্বরে যখন সেনাবাহিনীতে পাল্টা অভ্যুথান সংগঠিত হয়েছিলো, তখন পূর্বের যোগসাজসটি ভেসে উঠেছিলো। নভেম্বরের অভ্যুথানে ১৫ আগস্টের অভ্যুথানের সাথে জড়িত ১৬ জন সেনা অফিসার দেশত্যাগে বাধ্য হয়ে বিশেষ বিমান যোগে ব্যাংকক পৌছেছিলো। সেখানে পৌছার পর কর্ণেল ফারুক মার্কিন ও পাকিস্তান দূতাবাসে গিয়ে তাদের অবস্থানের কথা জানান দিয়েছিলো। পরবর্তীতে এই ১৬ জন সেনা অফিসারকে পাকিস্তানের একটি বিশেষ বিমানে করে লিবিয়া পাঠানো হয়েছিলো। লিবিয়ার ডিক্টেটর কর্ণেল গাদ্দাফী তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করেছিলো। পলাতক এই ১৬ অফিসারকে পৌছে দিয়েছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মরত সাবেক অফিসার শমসের মোবিন চৌধুরী। তিনি এখন বি.এন.পির নেতা। সুতরাং যোগসাজসের বিস্তৃতি কতদূর ছিলো সেটি এখন গবেষণার বিষয়।
১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক এবং আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনাকে নিছক একটি দুর্ঘটনা হিসেবে গণ্য করা সমীচিন নয়। এটি একটি নীল নক্সা বা পরিকল্পনার বাস্তবায়ন বলা চলে। এই পরিকল্পনা বা নীল নক্সা শুরু হয়েছিলো ১৯৭১ সনে এবং তার সাময়িক সমাপ্তি ঘটেছিলো ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্টে সপরিবারে বঙ্গঁবন্ধু হত্যা এবং সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে। ১৯৭৫ সনের ২৫ শে মার্চের পর থেকে ভারতের আগরতলা এবং কোলকাতা যেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রভূমি হিসেবে গণ্য হচ্ছিল, তেমনিভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের নেটওয়ার্ক ও কার্যকর ছিলো সমানভাবে। পাকিন্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আই.এস.আই এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি.আই.এ তৎপর হয়েছিলো সেখানে। যার ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির মধ্যে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী বিরোধ ছাড়াও বিভ্রাস্তি মাথা নাড়াছাড়া দিয়ে উঠেছিলো। প্রবাসী সরকার গঠন নিয়ে তাজুদ্দিন এবং শেখ ফজলুল হক মণির মধ্যে অন্তরাল বিরোধ, নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের ক্ষুদ্র এক অংশ কর্তৃক তাজউদ্দিন সরকারের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপনের প্রস্তুতি এবং মুক্তিবাহিনীর সমান্তরালে বি.এল.এফ তথা মুক্তিবাহিনী গঠন, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কদের পদ নিয়ে বিরোধসহ নানামুখী উপসর্গ তৈরী করে মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত ও ভিন্নমুখী করার প্রয়াস চলেছিলো উল্লেখিত গোয়েন্দা সমূহের অপতৎপরতায়। প্রবাসী সরকার গঠনের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোস্তাক আহমদ, পররাষ্ট্রসচিব মাহবুবুল আলম চাষী সহ ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার হোসেন আলীর তৎপরতা ছিলো ভিন্ন মাত্রার। ইরানী চ্যানেলের মাধ্যমে উল্লেখিত চক্র পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের কনফেডারেশন গঠন এবং আটককৃত বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তি নিয়ে কুটচাল শুরু করেছিলো। এ চক্রান্ত ফাঁস হবার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একপ্রকার নিস্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিলো। সেনা কতৃত্ব নিয়ে ষড়যন্ত্র ছিলো অন্যরকম। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো ৭১ সনের মধ্য জুলাইয়ের সেক্টর কমান্ডার সম্মেলনে। মেজর জিয়া এবং তার সহযোগী ২/৩ জন সেনা অফিসার মুক্তিযুদ্ধের সেনানিধায়ক হিসাবে নির্বচিত এম.এন.এ এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল এম. এ জি ওসমানী কে মেনে নিতে পারছিলেন না। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো, কর্মরত সেনা অফিসারদের নিয়ে একটি ওয়ার কাউন্সিল গঠন। বিষয়টি অবহিত হবার পর কর্ণেল ওসমানী প্রথম দিনের সম্মেলনে সভাপতিত্ব না করে সেনাধিনায়কদের পদ থেকে মৌখিকভাবে পদত্যাগ করেছিলেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের মধ্যস্থতায় বিষয়টি সুরাহা হয়েছিলো এবং ওসমানী পরবর্তী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন। সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলোকে পুর্ণবিন্যাস করা হয়েছিলো এবং জিয়া তার সেক্টর কমান্ডার পদটি হারিয়েছিলেন। এই স্নায়ু বিরোধে জিয়া ওসমানীর নিকট হেরে গেলেও এই বিরোধের জের ছিলো সুদূরপ্রসারী। যার প্রভাব পরবর্তী কালীন ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্টের সেনা অভ্যুত্থানে ছায়া ফেলেছিলো। (চলবে)
Post Views:
0