মোহাম্মদ আবু তাহেরঃ
রবীন্দ্রনাথের একটি মূল্যবান উক্তি দিয়ে লেখাটি শুরু করতে চাই “আমাদের বাঁচিবার উপায় আমাদের নিজেদের শক্তিকে সর্বোতভাবে জাগ্রত করা”
করোনা সংকট থেকে বাঁচার জন্য এখন বাংলাদেশের মানুষের সর্বশক্তি দিয়ে একটি সামাজিক জাগরণ সৃষ্টি করা দরকার। বাংলাদেশের অর্থনীতি বছরের পর বছর ধরে শক্তিশালী অবস্থানে যাচ্ছিল। মানুষ এ দেশকে উন্নত দেশে রূপান্তর হওয়ার স্বপ্ন দেখছিল, কিন্তু প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস মানুষের সেই স্বপ্নকে থামিয়ে দিয়েছে। মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য সরকার নতুন নতুন পরিকল্পনা ও কৌশল গ্রহণ করেছেন যা প্রশংসার দাবি রাখে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান তাঁর এক নিবন্ধে লিখেছেন “জীবন বাঁচানোর সংগ্রাম সফল হলে জীবিকার সংগ্রাম এমনিতেই সফল হবে। আর অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশ জীবিকার সংগ্রামে বেশ খানিকটা এগিয়ে রয়েছে তার গ্রামীণ অর্থনীতি তথা কৃষির জোড়ালো অবস্থার কারণে” বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় বলেছিলেন নানা দুর্ভোগে ও বাংলাদেশের মানুষ কাবু হবে না। বরং বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নিজেদের ইচ্ছা শক্তির জোরেই জয়ী হবে শেষ পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধুর মহামূল্যবান উক্তির সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। প্রয়োজনের সময় সাধ্যমত দুর্গত মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা করার দৃষ্টান্ত দেশের মানুষের রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের একটা প্রশংসা দেশী-বিদেশী জ্ঞানীগুণীরাও করে থাকেন তা হলো ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা। বন্যা জলোচ্ছ্বাস অভাব-অনটন সবকিছু ছাপিয়ে এখানে জয়ী হয় জীবন, জয়ী হয় মানবিকতা। এদেশের মানুষ অপারাজেয়। বাংলাদেশের মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই এদেশের মানুষের সাহস ও শক্তি যোগায় । ঝড় জলোচ্ছ্বাস নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করেও এদেশের মানুষ সামনের দিকে এগিয়ে যায়। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এক ভাষনে বলেছিলেন “মানুষের পরাজয় নেই তা এজন্য যে তার ভাষা আছে, তা এজন্য যে তার আত্মা আছে” বাংলাদেশের মানুষেরও পরাজয় নেই ইতিহাস তাই শিক্ষা দেয়। দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েই চলেছে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের অনেকেই সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পুলিশ সদস্যরা অসাধারণ সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তাদের সেবার প্রশংসা করেছেন। করোনাকালীন সাধারণ ছুটি ও পুলিশ সদস্যরা ভোগ করতে পারেননি। পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য পুলিশ সদস্যরা দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি তারা সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কর্মহীন অভাবী মানুষদের খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেয়া সহ করোনায় মৃতদের সজন যেখানে পালিয়ে যায় তাদেরকে সৎকারের মতো মহান ও মানবিক দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ সদস্যরা। এ পর্যন্ত পুলিশের ১২ হাজার সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন এবং ৫২ জন পুলিশ সদস্য মৃত্যুবরণ করেছেন বলে সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়। পাশাপাশি ডাক্তার, ব্যাংকার, বিচারক, জন প্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী সহ অন্যান্য পেশার অনেক মানুষ করোনা সংক্রামনে মারা গেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে করোনা ভাইরাস হয়তো পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নেবে না এর রেশ অন্তত আর পাঁচ বছর থাকতে পারে। এমতাবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবকিছু স্বাভাবিক গতিতে চলাতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য সাধারণ মানুষের মাস্ক পরা নিয়ে এখনো অনেক অসচেতনতা রয়েছে। করোনা সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে ঠিক সেভাবেই যেন মাস্ক ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে বাড়ছে অনীহা। এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। মাস্ক ব্যবহারের জন্য পুলিশ সদস্যদের আরো বেশি কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করি। যেখানে যে দায়িত্বে থাকবেন অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে মাস্ক ব্যবহারের বিষয়টি কঠোর নজরদারিতে রাখতে পারলে সর্বস্তরের মানুষ মাস্ক ব্যবহার করবে বলে মনে করি। মাস্ক না পড়লে জরিমানার বিধান কার্যকর করা দরকার বলে মনে করি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মাস্ক পড়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি মাস্ক পরবেনই না। মাস্ক পরার জন্য আগামী নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্ধীকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেছিলেন। সেই ষ্টাম্পই এখন মাস্ক পড়া শুরু করেছেন। মৃত্যু ও আক্রান্তের দীর্ঘ মিছিলে বর্তমানে কঠিন পরিস্থিতির মুখে আমাদের দেশ। অনেক মানুষ চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেনা। হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে ও ভর্তি হতে পারছে না মানুষ। ক্যান্সার আক্রাস্ত রোগী ও করোনা টেস্ট করাতে না পারায় ক্যান্সার হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেনা বলে সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়। চিকিৎসা ছাড়া কভিড নন কভিড অনেক মানুষই মরছে। কেউ রাস্তায় কেউ বাড়িতে। অন্যান্য রোগে অসুস্থ হলেও হাসপাতালে একটু চিকিৎসা পাবে কি পাবে না এই শংকা মানুষের মনে। অনেক অমানবিক ঘটনার খবর গণমাধ্যম থেকে জানা যায়। গ্রামের মানুষ করোনা রোগীর লাশ দাফন করতে বাধা দেয়। হাসপাতালে লাশ আটকে বিল চাইছে। পিতা-মাতার লাশ সস্তান নিতে চায় না। পরিবারের সদস্যরা মৃত ব্যক্তির সৎকার করে না। অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে করোনা রোগী মৃত্যু তিন ঘণ্টা পর মরদেহ থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর কোন আশঙ্কা থাকে না। রাজশাহীতে চেয়ারে বসে মারা যাওয়া এক আইনজীবির পাশে কেউ এগিয়ে যাননি করোনা রোগী মনে করে। বর্তমান সময়ে মানুষ ভীষণ অসহায়। চারদিকে এখন নিষ্ঠুরতার হাহাকার। অন্যায় আর অসঙ্গতির উল্লাস চলছে। দেশের সকল জেলায়ই শুধু নয় উপজেলা পর্যায়েও আরও বেশি করে করোনা টেষ্ট প্রয়োজন বলে মনে করি। মানুষ করোনা বা অন্য যেকোনো রোগ নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা পাবেনা স্বাধীন দেশে এটি আশা করা যায় না। চিকিৎসা সেবা পাওয়া মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। মৌলভীবাজার একটি অগ্রসরমান ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ অঞ্চল। সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে এই জেলার চা শিল্প, আগর শিল্প, বনজ ও খনিজ সম্পদ ইত্যাদি। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতিকে করেছে সমৃদ্ধ। এ জেলার প্রায় ২৫ লক্ষ মানুষের জন্য নেই কোন মেডিকেল কলেজ। এখানকার মানুষের মুখে মুখে সরকারি মেডিকেল প্রতিষ্ঠার দাবির কথা উচ্চারিত হয়। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো মৌলভীবাজারে করোনা সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। ২৫০ শয্যা হাসপাতালে করোনা রোগীর জন্য বিশেষ ইউনিট রাখা দরকার। পিসিআর ল্যাব ও আইসিইউ বেড দরকার বলে সচেতন মহল মনে করেন। সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায় ৪২ টি জেলায় করোনা ভাইরাস পরীক্ষাই হয় না। সকল বেসরকারি হাসপাতালে করোনা ও সাধারণ চিকিৎসার ব্যবস্থা আলাদাভাবে নেওয়ার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সিট থাকা সত্বেও রোগী ভর্তি না করলে এবং তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হলে শাস্তির ব্যবস্থা থাকা এখন সময়ের দাবি। যৌক্তিক ফি নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলো যাতে করোনার টেস্ট করে সরকারের পক্ষ থেকে তা কঠোর মনিটরিং করতে হবে। করোনা টেস্টের নামে কি হচ্ছে মানুষের মনে এখন বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। রিজেন্ট হাসপাতালে-দুর্নীতির কারণে মানুষের মনে এক ধরনের ভীতি কাজ করছে। সংক্রমণ বন্ধ করতে হবে মানুষকে বাঁচাতে হবে। সকল সরকারি হাসপাতালে করোনার টেস্ট ফ্রি করে দিতে হবে। তা না হলে অভাবী মানুষ টেস্ট করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। মনে রাখতে হবে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা ও বিনামূল্যে ও সহজলভ্য করার কারণে বাংলাদেশে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এক সময় বলা হতো যার হয় যক্ষ্মা তার নাই রক্ষা আর এখন বলা হয় যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই এ কথাটির ভিত্তি নাই। করোনা সংকট মোকাবেলা করার জন্য সরকার আন্তরিকর্ভাব কাজ করে যাচ্ছে। এ সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে সকল মানুষকে সচেতন হতে হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে সকলকে আন্তরিকতা ও মানবিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। হিংসা বিদ্বেষ মুক্ত থাকতে হবে। মানুষের জীবনে মানুষের ভূমিকা এতটাই প্রয়োজন চারপাশের অসংখ্য মানুষের সহযোগিতায় মমতায় ভালবাসায় আমরা বেঁচে থাকি। দায়িত্বশীলদের সেবার মানসিকতা ও মানবিকতার সাথে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। সর্বোপরি মহান আল্লাহতালার কাছে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সাহায্য ছাড়া করোনা ভাইরাসের মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়।
লেখকঃ কলামিস্ট, গবেষক ও ব্যাংকার
Post Views:
0