ষ্টাফ রিপোর্টারঃ
পর্যটন জেলা হিসেবে বছরের পুরো সময়ই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটকরা আসতেন মৌলভীবাজার। পর্যটকদের থাকা ও খাওয়ার জন্য এখানে গড়ে উঠেছে উন্নতমানের শতাধিক হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট। এ থেকে প্রতি বছর সরকারের বড় ধরনে রাজস্ব আদায় হতো। এখানে কর্মসংস্থানও হয়েছে কয়েক হাজার লোকের। কিন্তু চলমান করোনা ভাইরাসে দীর্ঘ ৪ মাস যাবত জেলার প্রায় ৯০ শতাংশ হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট পুরো বন্ধ রয়েছে। বেকার হয়ে পড়েছেন প্রায় ৫ হাজার কর্মকর্তা কর্মচারী। যার কারনে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা। নি¤œমানের ২/১ খোলা থাকলেও বাহিরের কোনো পর্যটক নেই বললেই চলে। জরুরি প্রয়োজনে কেউ আসলে এগুলোতে থাকছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে কর্মচারীদের বড় একটি অংশকে ছাটাই করা হয়েছে। শুধু বড় বড় প্রতিষ্ঠানে রক্ষণা বেক্ষণের জন্য জনবল বেশী প্রয়োজন হয় তাদের কর্মচারীর একটি অংশ এখনো কাজ করলেও ছোট এবং মাঝারি প্রতিষ্ঠান ছাটাই করেছে গণহারে। অনেক প্রতিষ্ঠান শুধু নিরাপত্তারক্ষীদের রেখে বাকী সবাইকে ছাটাই করেছে। যারা কাজ করছেন তাদেরকেও দেওয়া হচ্ছে অর্ধেক বেতন ।
জানা যায়, ঈদের দুই মাস আগে বুকিং শেষ হয়ে যাওয়া ৭০ হোটেল-রিসোর্ট গত ইদুল ফিতরে পুরো ফাঁকা ছিল। প্রতি বছর ঈদের ছুটিতে মৌলভীবাজারে রীতিমতো ঢল নাতো পর্যটকদের। কিন্তু এবার পুরোটাই ফাঁকা ছিল। আগামী ঈদুল আজহায়ও একই অবস্থা হবে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তবে কবে স্বাভাবিক হবে কেউই বলতে পারছেন না।
ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদের ১০-১৫ দিন আগে থেকেই বুকিং হয়ে যেতো জেলার প্রতিটি হোটেল-রিসোর্ট। জেলার অন্য এলাকার পাশাপাশি পর্যটকদের সবচেয়ে বেশি ভিড় থাকতো শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জে। এসব এলাকার প্রায় ৭০টি হোটেল-রিসোর্টের ব্যবসার মৌসুম ঈদের সময়। ঈদ ঘিরে সাজানো হতো হোটেল-রিসোর্ট।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রতি ঈদে বিশেষ করে রমজানের ঈদে মৌলভীবাজারে সবচেয়ে বেশি পর্যটক দেখা যায়। কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবপুর লেইক, হামহাম জলপ্রপাত, মনিপুরী পাড়ায় এবং শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন চা-বাগান ও বাইক্কাবিল, কুলাউড়ার কালাপাহাড় ও হাকালুকি হাওরে পর্যটকরা যান। পর্যটকদের ৯৫ ভাগই থাকার জন্য কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলের প্রায় ৭০টি হোটেল-রিসোর্টকে প্রাধান্য দেন। কিন্তু এবার পুরোটাই শূন। সেই সঙ্গে হোটেল-রিসোর্ট দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় পুঁজি হারানোর ভয়ে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে হোটেল-রিসোর্ট বন্ধ থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কর্মচারী রাখতে হয়। যেহেতু কোনো আয় নেই তাই পুঁজি ভেঙে বেতন দিতে হয় কর্মচারীদের।
“এসকেডি আমার বাড়ি” রিসোর্টের পরিচালক সজল দাশ বলেন, আমার ব্যাংক লোন আছে দুই কোটি ২০ টাকা। ১১ মার্চ থেকে আমার রিসোর্ট বন্ধ। কর্মচারীদের ছুটি দিয়েছি। কিন্তু তাদের বেতন তো দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ বিলের জন্যও চাপ আসছে। সবকিছু মিলিয়ে ঋণের জালে যেভাবে আটকে যাচ্ছি। সরকারের সহযোগিতা ছাড়া বের হতে পারব না। পুঁজি হারানোর ভয়ে আছি আমরা।
শ্রীমঙ্গল শহরের গ্রিনলিফ রিসোর্টের পরিচালক এসকে দাস সুমন বলেন, গত বছর আমার রিসোর্ট ঈদের এক মাস আগেই বুকিং হয়ে যায়। আমার রিসোর্টে বিদেশিরা বেশি আসেন। ঈদের সময়টা ব্যবসার উল্লেখযোগ্য সময়। সারা বছরের প্রস্তুতি থাকে ঈদ ঘিরে। কিন্তু এ বছর করোনা সঙ্কটের কারণে সব শেষ। ঝুঁকিতে পড়েছে ব্যবসা। অন্য খাত থেকে টাকা এনে কর্মচারীদের বেতন দিচ্ছি।
তিনি বলেন, আমরা পর্যটন ব্যবসায়ীরা বছরে কোটি কোটি টাকা সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্স দেই। কিন্তু করোনার বিপদের সময় আমরা সরকারের কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না।
হোটেল মেরিনার পরিচালক নাজমুল হাসান মিরাজ বলেন, এই হোটেলটি ভাড়া নিয়ে চালাই আমি। মাসিক ভাড়া এক লাখ ২০ হাজার টাকা। কর্মচারীদের বেতনসহ মাসিক খরচ আড়াই লাখ টাকা। করোনার সঙ্কটে সব তছনছ। ঋণে জড়িয়ে পড়েছি।
মৌলভীবাজার রেস্ট ইন হোটেলের ম্যানেজার সত্যজিৎ আচার্য বলেন, ২ মাসে ১৬ লক্ষ টাকা লোকসান হয়েছে। এ মাসে সীমিত পরিসরে খোলা হয়েছে। তবে বড় ধরনের লোকসানে আছি।
লেমন গার্ডেন রিসোর্টের পরিচালক সেলিম আহমেদ বলেন, আমার মাসিক খরচ ২৭ লাখ টাকা। এত টাকা প্রতি মাসে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এভাবে আর কিছু দিন চললে দেউলিয়া হয়ে যাব। আমাদের টিকে থাকতে হলে সরকারের সহযোগিতা দরকার। বিদ্যুৎ বিল মওকুফ করা দরকার।
পর্যটকদের আগমনকে ঘিরে ব্যস্থ সময় কাটান ট্যুর গাইডরা। কিন্তু এ বছর তাদের ফোনে কল আসছে না কারও। সবাই বেকার বসে আছেন।
লাউয়াছড়ার ট্যুর গাইড সাজু মারচিয়াং বলেন, ঈদের দুই মাস আগে থেকে অনেক ফোন আসতো। কেউ কেউ বিকাশে অগ্রিম পেমেন্ট দিয়ে রাখতেন। অথচ এবার একটা ফোনও আসেনি। ট্যুর গাইড এম এ সামাদ বলেন, স্বাভাবিক অবস্থায় দেশি-বিদেশী পর্যটকদের নিয়ে কাজ করলেও এখন অনেকটা বেকার। পরিবার নিয়ে চলা অনেকটা কষ্ট হচ্ছে।
বেঙ্গল ভিজিট ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি এর চেয়ারম্যান আব্দুস ছামাদ খান বলেন, লকডাউনের পর থেকে কোনো পর্যটকরা আমার সাথে যোগাযোগ করেনি। যারা বুকিং দিয়েছিল তারাও বুকিং বাতিল করেছে। দীর্ঘ দিন যাবত কর্মহীন অবস্থায় আছি। সরকারি সহযোগীতা না পেলে এপেশায় টিকে থাকা সম্ভব হবে না।
পর্যটন সেবা সংস্থা শ্রীমঙ্গলের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক বলেন, আমার রিসোর্টগুলা গত ঈদে দুই মাস আগেই বুকিং হয়েছিল। পরিচিত অনেকজনকে সিট দিতে পারিনি বলে মন খারাপ করেছেন। কিন্তু এবার উল্টা চিত্র। শুনেছি প্রধানমন্ত্রী আমাদের প্রণোদনা দেবেন। কিন্তু কবে পাব তাও নিশ্চিত নই।
এবিষয়ে উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের প্রশিক্ষক সমন্বয়ক মোঃ নিয়াজ মোর্শেদ বলেন, করোনা ভাইরাসে এই খাতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। ওই ক্ষতি পুষিয়ে উঠার জন্য পরিকল্পনা প্রয়োজনা। বর্তমানে এ পেশার সাথে জড়িতদের বেকার না থাকার জন্য অন্য একটি পেশার সাথে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।