হোসাইন আহমদঃ
২০১৯ সালের ডিসেম্বরের দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে (কভিডো-১৯) বা করোনা ভাইরাস সংক্রামনে প্রথমে দুজন লোক মারা যান। পর্যাক্রমে ভাইরাসটি পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের পর দেশ আক্রান্ত হয়। এর আক্রমন থেকে রেহাই পায়নি পৃথিবীর শক্তিশালী দেশ গুলোও। এ পর্যন্ত প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজারের উপর লোক মারা গেছেন। আক্রান্ত হয়েছেন ২৪ লক্ষ। সর্বশেষ পর্যন্ত কত লোক মারা যাবেন, কত লোক আক্রান্ত হবেন তা অদৃশ্য। এই মহামারি কবে থামবে এখন পর্যন্ত কেউ বলতে পরছেন না। দেশের পর দেশ লকডাউন হচ্ছে। তবে এই সংক্রামন নিয়ে কঠিন দুশ্চিন্তায় রয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ^ব্যাপি একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে এর সংক্রামনে বেশি কষ্টে দিননিপাত করছেন বিশে^র কয়েক কোটি মধ্যবিত্ত ব্যক্তি ও পরিবার। তবে এর ভয়াবহতা বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে বাংলাদেশের মধ্যবিত্তদের উপর।
বাংলাদেশ করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর পর্যাক্রমে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিল্প কারখানা, গার্মেন্ট, ফ্যাক্টরীসহ সরকারী-বেসরকারী সকল ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়। কয়েক ধাপে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। যার কারনে বেকার হয়ে পড়েছেন কয়েক লক্ষ মানুষ। বিশেষ করে বিভাগীয় শহর, জেলা, উপজেলা কিংবা বড় বড় বাজারের লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন। লোকসান গুনতে হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। বিগত ২/৩ মাস যাবত তাদের সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। ওই ব্যবসায়ীদের দুই তৃতীয়াংশেরই একাধারে ২/৩ মাস ব্যবসা বন্ধ রেখে চলার সামর্থ নেয়। ব্যাংকে জমানো তাদের কোনো টাকা নেই। তারা সমাজের কারো কাছে হাত পেতে সাহায্য নিতেও পারছেন না। আবার সরকারি ত্রাণের লাইনেও দাঁড়াতে পারছে না। অনেকটা বুকের মধ্যে ব্যথা নিয়ে হোম কোয়ারেন্টেইনে অবস্থান করছেন। মুখ খোলে মনের কথা কাউকে বলছেন না। তাদের অনেকে এক বেলা খেয়ে দিন অতিবাহিত করার খবর উঠে আসছে।
করোনা ভাইরাস সংকটের শুরুতে দেশে সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক সংগঠন, ব্যাংক, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন ব্যক্তির উদ্যোগে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়। এই ত্রাণের সুবিধাভোগীরা ছিলেন সমাজের নি¤œ শ্রেণীর লোক। ঘুরে ফিরে এরাই একাধিক বার একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে ত্রাণ পেয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে একাধিকবার ত্রাণ পাওয়ায় তাদের বাসা বাড়িতে খাদ্য মজুদ করছেন। একাধিক সূত্র বলছে, অতিরিক্ত হওয়ায় কেউ কেউ আবার বাজারে বিক্রিও করছেন। নি¤œ আয়ের লোকেরা এটাকে তাদের আয়ের উৎস হিসেবে পরিগণিত করেছে। আবার কেউ কেউ এটাকে আয়ের উৎস মনে করে কমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। তবে তাদেরকে পুরোটা ত্রাণ থেকে বঞ্চিত করবেন এমনটি আমি বলছিনা।
কিন্তু এদিকে চরম ক্ষুধা, কষ্ট ও হতাশার মধ্যে দিননিপাত করছেন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা। বিশেষ করে যারা ব্যবসা ও ছোট খাটো বেসরকারি চাকুরির সাথে সম্পৃক্ত। মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা অনেক কষ্ঠের মধ্যে দিননিপাত করছেন। মধ্যবিত্তরা সমাজের এমন একটি পর্যায়ে অবস্থান করছেন যার কারনে তারা মুখ খোলে বলতেও পারছেননা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তারা কারো কাছে ঋণও পাচ্ছেন না। তাদের জমানো টাকা প্রায় শেষ। বিশ্লেষকরা বলছেন করোনা সংক্রামন আরও ২/৩ মাস স্থায়ী হলে এই শ্রেণীর লোক আরও চরম সংকটে পড়বে। বাস্তবতা হলো আমি নিজেও সাংবাদিকতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস ও রংধনু প্রিন্টার্স নামে দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করি। ব্যবসাই আমার আয়ের মূল উৎস। কিন্তু বিগত প্রায় ২ মাস যাবত ব্যবসা পুরো বন্ধ থাকায় অনেকটা কষ্টে দিন যাচ্ছে। এভাবে লক্ষ লক্ষ মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে দিন অতিবাহিত করছেন। এর মধ্যেও দোকানের ভাড়া, বাসা ভাড়া ও কর্মচারীদের বেতন দিতে হচ্ছে। করো কারো অবস্থা আমার চেয়ে আরও খারাপ। কিন্তু এটা প্রকাশ পাচ্ছে না। নিরবে নিভৃতে দিন কাটছে। লোক লজ্জায় কারো কাছে কিছু চাচ্ছেন না।
এ সকল বিষয় মাথায় রেখে বর্তমান ত্রাণ বিতরনের প্রক্রিয়ায় কিছুটা হলেও পরিবর্তন আনা জরুরি বলে আমি মনে করছি। আমি মনে করি বর্তমান পরিস্থিতিতে গরীবদের ত্রাণ দেয়া মূল বিষয় নয়। যারা বেকার দিন কাটাচ্ছেন। আয়ের কোনো উৎস নেই। তাদেরকেই ত্রাণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। কারণ বেকার লোকেরাই বেশী কষ্টে দিননিপাত করছেন। পরিবার নিয়ে তারাই বেশি দুশ্চিন্তায়। ত্রাণ বিতরনে তাদের প্রতিই বেশী গুরুত্ব দিতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক ও সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তাদের তালিকা করে গোপনে তাদের বাড়িতে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া যেতে পারে। এটা নিরবে করাই সর্বোত্তম। এই সহযোগীতার হাত অব্যাহত রাখতে হবে। তবে আশার দিক হলো কিছু ব্যক্তি বা সামাজিক প্রতিষ্ঠান ইতি মধ্যে এ উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এটা পর্যাপ্ত নয়। দাতার নাম পরিচয় গোপন রেখে তাদের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিয়ে আসছেন। এটা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। এই ধারা অব্যাহত না রাখলে আগামীতে হয়তো অনেকেই মনে কষ্ট নিয়ে মারা যাবেন।
এবিষয়ে মৌলভীবাজারের একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাথে কথা হলে তারা বলেন, গরীবদের ত্রাণ দেয়ার চেয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের দিকে এগিয়ে আসা জরুরি।
তাই আসুন করোনা ভাইরাসের মহামারিতে শুধু গরীব নয়, বেকার মানুষের পাশেও দাঁড়াই। মধ্যবিত্তদের সহযোগীতায় এগিয়ে আসি। তাদের জীবন ও জীবিকা রক্ষায় যুগান্তকারী প্রদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। তাহলেই করোনা ভাইরাসের এই মহামারি থেকে ক্ষুধা নিবারনে কিছুটা হলেও মধ্যবিত্তরা বাঁচবে।
লেখকঃ সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী
ত্রাণ বিতরন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা জরুরি
