মোহাম্মদ আবু তাহের
করোনা ভাইরাস পাল্টে দিয়েছে মানুষের জীবন। ২৫ মার্চ ২০২০ থেকে নিজ ঘরে বন্দির মতো আমার যাপিত-জীবন। সন্তানদের ও একই অবস্থা, এর মধ্যে দু’দিন মাছ তরকারির জন্য বাজারে যেতে হয়েছে। নিয়মিত খবর দেখি, মাঝে মধ্যে ফেসবুকে আপডেট দেখি, আর কতদিন সাধারণ ছুটি থাকবে কে জানে। দেশের বিভিন্ন জেলা ও অঞ্চল একের পর এক লকডাউন হচ্ছে। অনেকেই ফোন করে খোঁজ খবর জানতে চান। আলাপ আলোচনা করে নিজেকে হালকা করতে চান। সবাইকে আশাবাদী থাকার কথা বলি। অনেক পরিচিত-অপরিচিত দরিদ্র মানুষের জন্য চিন্তা হয়। কিভাবে তারা দিনাতিপাত করছে। গ্রামের বাড়িতে ভাতিজা ইঞ্জিণিয়ার আব্দুল আজিজ, ছোট ভাই ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার দরবেশ আলী ও সমাজ সেবক মীর জামিলুন নবী ফয়ছল বর্তমান পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়া গ্রামের অভাবী মানুষদের জন্য ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ গ্রহণ করায় কিছু আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে নিজেকে সম্পৃক্ত করি। নিজে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকায় সীমিত সামর্থের মধ্যে ও মৌলভীবাজারের উন্নয়নে আমরা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড নির্বাহী কমিটি সহ বিভিন্ন সংগঠনের ত্রাণ সামগ্রি বিতরণে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছি। কিন্তু জানিনা কি হবে। মানুষের চাহিদার তুলনায় এ সহযোগিতা একেবারেই নগন্য।
পৃথিবীর মানুষ আর কখনো এরকম অবস্থার মুখোমুখি হয়নি। ১১ জানুয়ারী থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর এক লাখেরও বেশী মানুষ মৃত্যু বরণ করেছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। বিশ্বের সব চাইতে শক্তিশালী দেশ যুক্তকরাষ্ট্রের মানুষই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাসের সংক্রমন ছড়িয়ে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ঢাকা সহ দেশের অনেক এলাকায় লকডাউন করা হয়েছে। ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। মানুষের ঘরের বাইরে আসা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে সরকার। এমতাবস্থায় খেটে খাওয়া মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। অনেক মানুষের দারিদ্রকে করোনা ভাইরাস পরাজিত করতে পারেনি। অনেক মানুষদের করোনা ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। অভাবী মানুষদের সরকার খাদ্য সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক সংগঠন, সামাজিক সংগঠন জনপ্রতিনিধি সহ সমাজের বিত্তবান মানুষ ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বৈশ্বিক এই মহামারি থেকে মানুষকে যার যার অবস্থান হতে নিজের শক্তি সামর্থ দিয়ে সহযোগীতা করতে হবে। করোনার এই সংক্রমন থেকে মুক্তি পেতে হলে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। করোনা ভাইরাসের এই মহাবিপর্যয় কোনো দেশই এর ভয়াবহতা আগেভাগে বুজতে পারেনি। এ মহামারির কাছে সব দেশই কথবেশী অসহায়। দীর্ঘ দিন এই মাহামারী তান্ডব চলতে থাকলে দেশে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। তখন মানুষের হাতে টাকা থাকলেও প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী চাহিদা মোতাবেক নাও পাওয়া যেতে পারে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমন ঠেকাতে দেশে কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বন্ধ হয়েছে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। এই পরিস্থিতিতে এক সতর্ক বার্তা দিয়েছে আন্তজার্তিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম। সংস্থাটি বলেছে করোনা ভাইরাস বিশ্বজুড়ে ৫০ কোটি মানুষকে দারিদ্রের মুখে ফেলে দেবে। করোনা সংকট মোকাবেলা করতে হলে বাংলাদেশের মানুষকে আরও মানবিক হতে হবে। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, নারায়নগঞ্জের একজন বেহালা বাদকের লাশ প্রায় ৯ ঘন্টা রাস্তায় পড়ে থাকে। নরসিংদীতে ছয় মাসের অন্তঃস্বত্বা গৃববধুকে দাফনে বাধা দেয়া হয়। আমাদের সতর্ক হওয়ার জন্য এ দুটি ঘটনাই যথেষ্ট। এছাড়াও বাবার লাশ সন্তানদের পুলিশের কাছে হস্তান্তরের খবরও শোনা যায়।
এখন রাজা মহারাজা, ধনী নির্ধন পৃথীবির সব মানুষই নিজেকে অসহায় ভাবছেন। করোনা ভাইরাসের কাছে সব মানুষ নিরূপায়। এটা যেন কেয়ামতের আলামত। এমতবাস্থায় অভাবী মানুষের মাঝে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশী পূন্য অর্জন করা সম্ভব। হত দরিদ্র মানুষের দুর্দিনে সাহায্য ও সহানুভুতি ও সহমর্মিতার মানসিকতা যাদের নেই তাদের ইবাদতও আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন না। সুতরাং নামাজ রোজার সাথে সাথে জনকল্যানের মানসিকতা ও নৈতিকতার গুণাবলি অর্জন করা ও জরুরি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোতে কোনো পূণ্য নেই, কিন্তু পূন্য আছে, কেউ আল্লাহ পরকাল, ফেরেশতাগন, সব কিতাব ও নবীর প্রতি ঈমান আনয়ন করলে এবং আল্লাহ প্রেমে এতিম মিছকিন, পর্যটক, সাহায্য প্রার্থী ও দাসমুক্তির জন্য অর্থদান করলে নামাজ প্রতিষ্টা করলে যাকাত দিলে, প্রতিশ্রুতি দিয়ে রক্ষা করলে, অর্থ সংকট, দুঃখ ক্লেশ ও সংকটে ধৈয্য ধারণ করলে। এরাই তারা যারা সত্যপরায়ন এবং তারই মুত্তাকী। (সূরা আল-বাকারা-১৭৭)
হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে যে ব্যক্তি আল্লাহকে খুশি করার জন্য দুনিয়ার মানুষকে খাদ্য দান করেছে কেয়ামতের দিন তাকে খাদ্য দান করা হবে। যে আল্লাহকে খুশি করার জন্য মানুষকে বস্ত্র দান করেছে তাকে কেয়ামতের দিন বস্ত্র পরিধান করিয়ে তার লজ্জা নিবারন করা হবে।
করোনা ভাইরাসের এই মহামারীর সময়ে মানুষের পারস্পারিক মানবতা বোধ ও উদার মানসিকতাকে শানিত করা দরকার। বর্তমান অবস্থায় অভাবী ও ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের সাহায্য করা ইমানী ও মানবিক কর্তব্য। কেউ কেউ বলতে পারেন বর্তমানে আমরা ও বিপদগ্রস্থ এ অবস্থায় কিভাবে অন্য অভাবী মানুষকে সাহায্য করা যায়। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা হলো স্বচ্ছল কিংবা অসচ্চল সর্ববস্থায় যারা আল্লাহর পথে নিজেদের ধন সম্পদ ব্যয় করে, যারা নিজেদের ক্রোধ সংবরন করে এবং মানুষের অপরাধ ক্ষমা করে দেয়। সেই ভালো মানুষদের আল্লাহ তায়ালা সব সময়ই ভালোবাসেন। (সূরা আল-ইমরান আয়াত-১৩৪)।
মানব সেবার এবং জনহিতকর কাজকে সব ধর্মেই গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। ইসলামে মানব সেবাকে সর্বোত্তম গুন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে সূরা বাকারায় আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন যদি তোমরা দান সাদকাহ বা সাহায্য সহযোগিতা প্রকাশ্যে কর তা ভালো। আর যদি এমন কাজ গোপনে বা অপ্রকাশ্যে কর তাও ভালো। পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা কাছাসে আল্লাহ পাক আরো এরশাদ করেছেন-তোমরা পৃথিবীবাসীর প্রতি তেমনি অনুগ্রহ কর যেমনি আমি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আসহায় অস্বচ্ছল্য অভাবী কর্মহীন মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারলে মানব সেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
রাসূল (সঃ) হুশিয়ারী উচ্চারন করেছেন যে ব্যক্তির প্রতিবেশী তার অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে মুক্ত নয় সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা (মুসলিম)। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে অভাবী আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের সাহায্য সহযোগীতা করা জরুরি। দান সদকা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ২৭২ নম্বর আয়াতে আরো বলা হয়েছে-যে অর্থবিত্ত তোমরা দান করো, সে দান তো তোমাদের নিজেদের কল্যাণের জন্যেই। তোমরা তো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করো। অতএব দানের পুরোপুরি প্রতিদান তোমাদেরকে অবশ্যই দেয়া। তোমাদের হক কখনো নষ্ট করা হবে না। মহানবী (সঃ) বলেছেন দান ৭০টির ও বেশী বিপদ থেকে মানুষকে রক্ষা করে।
বাইবেলে বলা হয়েছে তোমার শহরে বা গোত্রে যে অসহায় এতিম বা বিধবা আছে তারা যখন তোমার কাছে আসবে তুমি যখন তাদের খাওয়াবে বা খুশি করবে। তখন সৃষ্টা তোমার হাত দিয়ে করা সকল কাজে বরকত দেবেন।
মহামতি বুদ্ধ বলেছেন, দানের অনন্ত কল্যাণ সম্পর্কে আমি যা জানি যদি মানুষ তা জানতো তাহলে কাউকে না দিয়ে সে অন্ন গ্রহণ করত না। সংকটের ও দুর্যোগের এই সময়ে অসহায় ও দরিদ্র মানুষের জন্য বরাদ্দ করা ত্রাণ আত্মসাতের ঘটনা আমাদের দেশে ঘটছে। করোনা ভাইরাসের এই মাহামারীও এক শ্রেণীর মানুষের অপকর্ম বন্ধ করতে পারেনি। দেশের মানুষ এসব মানুষের এই জঘন্য অপরাধের দৃষ্ঠান্ত মূলক শাস্তি দেখতে চায়। আসার কথা হলো সরকারের পাশাপাশি দেশের বিত্তশালী মানুষ, জনপ্রতিনিধি, সামাজিক সংগঠন সহ অনেকেই বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সাহায্য শুরু করে দিয়েছেন। রজনিকান্ত সেনের দ্বাদশ দান কবিতাটি সকলের উদ্দেশ্যে উদ্বৃত করছি। অন্নহীনে অন্নদান, বস্ত্র বস্ত্রহীনে, তৃষাতুরে জলদান, ধর্ম ধর্মহীনে, মুর্খ জনে বিদ্যাদান, বিপন্নে আশ্রয়, রোগীরে ঔষধ দান, ভয়ার্তে অভয়, গৃহ হীনে গৃহ দান, অন্ধরে নয়ন, পীড়িতে আরোগ্য দান, শোকার্তে সান্তন। স্বার্থ শূন্য হয় যদি এ দ্বাদশ দান স্বর্গের দেবতা নহে দাতার সমান। আমরা আশাবাদী হতে চাই আমেরিকা ও ইতালির মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি বাংলাদেশের হবে না। করোনার তান্ডব থেকে রহমতের মাস রমজানের মাসে আমরা মুক্তি পাবো। ভেঙ্গে পড়বেন না, নিরাশ হবেন না। সাহায্য আসবেই এটা আল্লাহর ওয়াদা। জেনে রাখো নিশ্চই আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে সূরা বাকারা-১৪
লেখকঃ কলামিষ্ট, ব্যাংকার ও গবেষক।