সরওয়ার আহমদঃ
যায় দিন ভালো, আয় দিন খারাপ- এই প্রবচনের সাথে হিসাব মিলালে দেখা যাবে গত বছরের তুলনায় এবার নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য দ্রব্যের মূল্য উর্দ্ধমুখী। এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে নি¤œবিত্ত থেকে আরম্ভ করে মধ্যবিত্ত পর্য্যন্ত সাধারণ ভোক্তারা রীতিমতো কাবু। এক বছরের ব্যবধানে এমন কি ওলটপালট অবস্থার সৃষ্টি হলো যে সকল পণ্যের দাম উর্দ্ধমুখী হবে? গত বছর এই মৌসুম নতুন আলুর কেজি যেখানে ছিলো ৩৫/৪০ টাকা, সেই নতুন আলো কেজি মূল্য এবার ৬০/৬৫ টাকা। একই ভাবে মূলা, লাউ, শীম সহ অন্যান্য শাক সবজীর দাম বাড়ানো হয়েছে। অন্যান্য পণ্য সামগ্রীর বেলায়ও মূল্য বৃদ্ধির মৃদুমন্দ বাতাসে ব্যবসায়িক কায়েমী স্বার্থের পোয়াবারো অবস্থান। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ নিয়ে নানামুণির নানা মত থাকতে পারে। তৈলাধার পাত্র নাকি পাত্রধার তৈলের মতো রহস্য নির্ণয়ে গবেষণা সেলও সৃজন করা যায়। তবে এক্ষেত্রে গ্রামীণ অশীতিপর এবং অশিক্ষিত বুড়োর কথার সারাংশকেই বেহতর মনে করা যায়। তার মতে তিরিশ টাকার পেয়াজকে “বাঙ্গাল” ২৩০ টাকায় যখন কিনতে পারছে এবং পেয়াজের সিন্ডিকেট করে যদি ব্যবসায়ীরা লালে লাল হতে পারে, তাহলে নিত্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা লুটে নিতে ক্ষতি কি? ৩৫ টাকা কেজির লবন ৮০ টাকায় কিনার জন্য একশ্রেনীর ভোক্তা যখন দৌড় ঝাঁপ দিতে পারে তাহলে আলু পটলের দাম বাড়ানোটা তেমন অস্বাভাবিক কোথায়? সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!
সকল পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির ব্যাপারে গ্রামীণ বুড়ো যে সূত্র আবিস্কার করেছেন সেই সূত্রটিই বোধহয় যথাযথ। মূল্য বৃদ্ধির মূল উপলক্ষ হচ্ছে পেঁয়াজ। এদেশীয় পেঁয়াজের ভোক্তাদের নির্ভরযোগ্য বাজার ভারত যেদিন থেকে পেঁয়াজ রফতানী বন্ধ ঘোষনা করলো- সেদিন থেকেই আমদানী কারক এবং ডিষ্ট্রিবিউটরদের মুনাফার সেঞ্চুরীর সূত্রপাত। পিঁয়াজের দেশীয় চাহিদার পরিমাণ সম্পর্কে তারা সুঅবগত থাকায় সরবরাহের লাগামকে তখন থেকেই কষে ধরে তারা মুনাফার মৃগয়াক্ষেত্র তৈরী করেছিলো। এমন খবরও আছে যে, বিক্রয়কৃত পিয়াজকে মহাজনঘর থেকে পুনরায় কিনে এনে স্টক বাড়ানো হয়েছে মুনাফার সেঞ্চুরীকে মনোপলি করার লক্ষ্যে। মজুদকৃত পঁচা পিয়াজকে খালে ফেলে দেয়া হয়েছে, তবু বাজারে সরবরাহ করা হয়নি। অন্যদিকে সরকারি উদ্যোগে বাজার মনিটরিং করা হলেও কোথায় পেয়াজ ষ্টক করা হয়েছে, কারা পঁচা পিয়াজ খালে নালায় ফেলে দিয়েছে, সেটির শনাক্ত করণ সম্ভব হয়নি। যেদেশের প্রশাসন জঙ্গীঁদের এক্সক্লুসিভ ও সন্ত্রাসীদের অস্ত্র উদ্ধারে পারঙ্গঁম, সেই প্রশাসন, মজুদদার ও মুনাফাবাজদের ষ্টকভান্ডার কোথায় আছে, সেটি আবিস্কারে কি অক্ষম? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বলা যেতে পারে- ডালমে কুঁচকালা হে…/ হয়তো সরকারের ভেতর থেকেই সরকারের সুকীর্ত্তিকে স্যাবোটাজ করার জন্য হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে পিঁয়াজকে। তাই পিঁয়াজ নিয়ে লুকোচুরি খেলা চলেছে। বাজারে কি পিঁয়াজের অভাব আছে? টাকা থাকলে মনকেমণ পেঁয়াজ কিনা যায়। ৭৪ সনে দোকানে দোকানে চালের বস্তার পর বস্তার উপস্থিতি ছিলো। কিন্তু মানুষ মরেছে না খেয়ে। এই দেশতো সেই দেশই আছে। দোকানে দোকানে পিঁয়াজ আছে কিন্তু দামের আগুণে ধার ভিড়তে পারছেনা ভোক্তা মহল। পিঁয়াজের লেজুড় ধরে আলু, পটল, শাক সবজি এমনকি অন্যান্য ভোগ্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ঘটছে। এবং সেটি হচ্ছে দুর্ভেদ্য সিন্ডিকেটের কারণে। সরকারের চাইতে সিন্ডিকেটের শক্তি কমনয়। সেকারণে তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করা সম্ভব হচ্ছেনা। ঠিক একই কারণে দেশের ভোক্তা সমাজও তাদের হাতে জিম্মি হতে বাধ্য।
পিঁয়াজের অবধারিত সঙ্কট মোকাবেলায় সরকার এল.সির মাধ্যমে বিদেশ থেকে পিঁয়াজ আমদানীর সুযোগ করে দেওয়ার পরও ক্রাইসিস মোকাবেলা সম্ভব হচ্ছেনা। অভিযোগ উঠেছে, কোন কোন আমদানী কারকরাও সিন্ডিকেটের পন্থা অবলম্বন করে মুনাফাবাজীর পন্থা অবলম্বন করছে। এই প্রেক্ষাপটে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ আমাদানী কারকদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা এটিকে হয়রানি বলে অভিযোগ তুলেছেন। এটা নাকি গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুন্নের সমতুল্য। গণতন্ত্রে ও সংবিধানে স্বাধীনভাবে ব্যবসা পরিচালনার নিশ্চয়তা আছে। সংবিধান এবং গণতন্ত্রে মিটিং মিছিল একনকি হরতালের গ্যারান্টিও আছে। কিন্তু এই অধিকারবলে- মানুষ পুড়ানো, ভাংচুর, সরকারি সম্পদ বিনষ্টকরণ সহ দেশকে স্থবির করে দেওয়ার মদমত্ত খেলাওতো এ জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। এখন ব্যবসায়িক স্বাধীনতার নামে সঙ্কটসৃষ্টি করে ভোক্তাদের পকেটের টাকাকে ছিনিয়ে নেওয়ার নাম যদি হয় গণতন্ত্রিক অধিকার, তাহলে রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের থিওরী পাল্টানো জরুরী হয়ে উঠেছে।
অধিকারতো সবার আছে। কিন্তু সিন্ডিকেটের করাল গ্রাসের নিকট কত অধিকার ধামাচাপা পড়ে আছে সেখবর ক’জন রাখে? সারা বছর পরিশ্রম করে কৃষক যে ধান উৎপাদন করে, সে ধানের মুনাফা লুঠে নেয় সিন্ডিকেট। সিন্ডেকেট নির্ধারিত দামের বাইরে কৃষকরা ধান বিক্রি করতে পারেনা। একই অবস্থা সবজি উৎপাদকেরও। বাজারি সিন্ডিকেটের দাপাটে গ্রামীণ সবজি বিক্রেতারা শহরে উঠতে পারে না। শহরে উঠলেই পথ দখলের অভিযোগে পুলিশ তাদেরকে পিটায়। তাই সস্তা মূল্যের নাগাল পায়না ভোক্তা মহল। মাছ চাষীরা বাজারে মাছ বিক্রি করতে পারেনা একই কারণে। আড়তে গেলে “ফেলে দেস তো মোরে দে” আওয়াজ তুলে আড়তদার। ফলে লাভের হিস্যা যায় আড়ত চক্রের পকেটে। এভাবে পরখ কারলে দেখা যাবে, ব্যবসা পদ্ধতির ৮০% নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সিন্ডিকেট মাধ্যমে। এতদ্দেশীয় ভোক্তা সমাজ দৃশ্যত: সিন্ডিকেট জালেই আবদ্ধ। এখানে ভোক্তা অধিকার শুধু ঠুঁটো জগন্নাথ মাত্র।