বিশেষ প্রতিনিধিঃ
মৌলভীবাজারে প্রশাসনের চোখে আঙ্গুল দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙ্গিয়ে সুদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে একটি শক্তিশালী চক্র। সুদ ব্যবসায়ীদের ছুবলে পড়ে ইতিমধ্যে জেলার অনেক সহজ সরল মানুষ ভিটা মাটি হারিয়ে এখন রাস্তায় দিননিপাত করছেন। এদিকে অল্প দিনে সুদের ব্যবসা করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছেন অনেকেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিগত ৫ মাস পূর্বে গলায় ধড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন সদর উপজেলার জগন্নাতপুর গ্রামের দিলু মিয়া। একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, দিলু মিয়া’র আত্মহত্যার পিছনেও সুদে টাকা লেনদেনের বিষয় জড়িত ছিল। একটি সূত্র জানায়, সুদের লভ্যাংশ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নের ছয়টি পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করছে উপজেলার দাদন স¤্রাট আসুক মিয়া। এর বাহিরেও তিনি অনেক হতদরিদ্র পরিবারের মেয়েদের নিয়ে শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন হোটেল ও রিসোর্টে রাত্রি যাপন করার অভিযোগ উঠেছে। তার সুদের জাল পুরো উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত। নাম গোপন রাখার শর্তে রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নের এক ইউপি সদস্য বলেন, আসুকের সুদের জালে পুরো ইউনিয়ন জুড়ে। তার কাছ থেকে সুদে টাকা এনে খেটে খাওয়া মানুষ আরও নিঃস্ব হচ্ছে। দাদন স¤্রাট আসুক মিয়া’র মুঠোফোনে কল দিয়ে অভিযোগের সত্যতা জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদককে কিছুই বলতে পারেননি। এক পর্যায়ে বলেন, আপনি নিউজ করেননা আমি সন্ধ্যা পরে এসে আপনার সাথে দেখা করছি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলার কুলাউড়া ডিগ্রী কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো আনোয়ার হোসেন বক্স ও তার সহযোগী ইয়াকুব আলী’র কাছ থেকে সুদে ৫ লক্ষ টাকা নেন একই উপজেলার দক্ষিণ হিঙ্গাজিয়া গ্রামে আব্দুল মুকিত। পরবর্তীতে মুকিত আনোয়ার হোসেন বক্স ও ইয়াকুব আলী কাছ থেকে আরও ৫ লক্ষ ২০ হাজার টাকা সুদে এনে তাদের দেয়া প্রথম ৫ টাকার মাসিক লভ্যাংশ পরিশোধ করেন। পরবর্তীতে মুকিত ও তার পরিবারের সদস্যরা সময় মতো সুদের লভ্যাংশ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন বক্স ওই পরিবারের উপর বিভিন্ন রকম নির্যাতন চালান। এ থেকে মুক্তি পেতে মুকিতের বড় ভাই প্রবাসী আব্দুল মুমিন চলতি মাসের ১৬ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার পুলিশ সুপার বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। বর্তমানে কুলাউড়া সার্কেলে অভিযোগটি তদন্তধীন অবস্থায় আছে। অভিযোগে তিনি আরও বলেন, ১০ লক্ষ ২০ হাজার টাকার লভ্যাংশ বেড়ে যাওয়ায় মুকিত টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারী ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন বক্স ক্ষুব্ধ হয়ে মুকিতের দোকানে হামলা করেন। এসময় আনোয়ার ও তার সহযোগীরা একটি চেক ও নগদ কিছু টাকা লুট করে নিয়ে যান। জানা যায়, এই সুদের টাকাকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষের মধ্যে আদালতে একাধিক মামলা চলছে। বিষয়টি সমাধানের জন্য স্থানীয়রা একাধিকবার বসেও ব্যর্থ হয়েছেন। ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন বক্স তাদের কাছে ১৫ লক্ষ টাকা পাবেন বলে আদালতে একটি মামলাও দায়ের করেছেন (মামলা নং ৫৬৭)। ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন বক্স দলীয় প্রভাবকাটিয়ে ওই পরিবারকে নানাভাবে হয়রানি করে আসছে। অভিযোগকারী আব্দুল মুমিন ৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে হিঙ্গাজিয়া বাজারে যাওয়ার সময় আনোয়ার বক্স ও তার সহযোগীরা তাকে মারপিট করেন। পরবর্তীতে তিনি এ ঘটনায় কুলাউড়া থানায় একটি জিডি করেন (জিডি নং ৫৬৪)। এবিষয়ে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন বক্স সুদে টাকা লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, আব্দুল মুকিতের সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকায় ২ বারে ১৫ লক্ষ টাকা ঋণ দিয়েছি। পরবর্তীতে টাকা চাইতে গেলে সে অস্বীকার করে। স্থানীয়রাও এ বিষয়ে অবগত আছেন। শেষ পর্যন্ত টাকা পরিশোধ না করায় মামলা করেছি। এবিষয়ে কুলাউড়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাওছার দস্তগীর বলেন, আনোয়ার হোসেন বক্স এর দায়ের করা মামলার প্রেক্ষিতে কুলাউড়া থানার তৎক্ষালিন এসআই জহিরুল ইসলাম তালুকদার একটি তদন্ত প্রতিবেদন দিয়ে ছিল। ওই তদন্ত প্রতিবেদনটি সত্য না মিথ্যা এটা যাছাইবাছাই চলছে। তবে তাদের সার্বিক বিষয় তদন্ত করার জন্য পুলিশ সুপার মহোদয়ের কাছে আরও সময় চেয়েছি।
এদিকে রাজনগর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের গবিন্দপুর গ্রামের সুদ ব্যবসায়ী আলিম মিয়া’র কাছ থেকে সুদে টাকা এনে অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়েছেন। স্থানীয়রা জানান, জুনেদ মিয়া সুদ ব্যবসায়ী আলিম মিয়ার কাছ থেকে ১ লক্ষ টাকা সুদে নেন। পরবর্তীতে ভিটা বিক্রি করে ওই ১ লক্ষ টাকার সুদসহ ২ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়। জুনেদ মিয়া প্রতিবেদককে বলেন, সর্বত্র হারিয়ে এখন ভাইর কিছু জায়গায় কোনো রকম পরিবার নিয়ে জীবন যাবন করছেন। কিছু জায়গার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছি। মৌলভীবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য নেছার আহমদ ১০ হাজার টাকা অনুদান দিলে এটা দিয়ে কোনো রকম চিকিৎসা চলছে। একই এলাকার আইয়ূব আলীও আলিম মিয়ার কাছ থেকে সুদে ১০ হাজার টাকা এনে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। আইয়ূব আলী’র মেয়ের সাথে কথা হলে তিনি সুদে টাকা লেনদেনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এবিষয়ে জানতে প্রতিবেদক আলিম মিয়ার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি সুদে টাকা লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ ব্যবসার সাথে জনপ্রতিনিধি, সরকার দলের নেতাকর্মী, স্বর্ণ ব্যবসায় ও এলাকার মাতব্বর সহ কয়েক শতাধিক মানুষ জড়িত। যার ফলে এটা দিন দিন চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। জেলার অনেক গ্রামগঞ্জে এটা এখন অপেন সিক্রেট। স্থানীয়দের অভিযোগ প্রশাসনকে একাধিকবার অবগত করার পরেও এপর্যন্ত কোনো কার্যকরি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে এটা দিন দিন লাগামহীন ভাবে বাড়ছে।
এব্যবসার সাথে জড়িত আছেন, সদর উপজেলার জগন্নাতপুর এলাকার, শাহাবাজ মিয়া, ইমাম হোসেন, আলিক মিয়া, কনকপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য আশিক মিয়া, রাজনগর উপজেলার সিহাব মিয়া, মুহিদ মিয়া, মিলাদ মিয়া, লাখা বেগম, বকশি কোনা গ্রামের আছাদ মিয়া, দুধ মিয়া, আসুক মিয়া, পাঁচগাঁও ইউনিয়নের কুটি ওরফে হাত কাটা কুটি, মখলু, হুশিয়ার ও ওয়াহিদ মিয়া। তবে কনকপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য আশিক মিয়া অস্বীকার করেন।
জেলার সচেতন নাগরিকরা বলছেন, এখনই দাদন ব্যবসা বন্ধ করা না গেলে সুদের জালে জড়িয়ে পড়বে পুরো জেলার অসহায় মানুষ। যার ফলে বাড়বে খুন, সংঘর্ষ, মামলা-হামলা, চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি মতো বড় বড় ঘটনা। এজন্য এখনই দাদন ব্যবসা বন্ধে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
Post Views:
0