সরওয়ার আহমদঃ
গাঙ্গেঁর এ বদ্বীপে যে অপার সম্ভাবনা বিদ্যমান সেটিতো মহাজন বাক্যে বিধৃত হয়েছে বহুআগে। হাল আমলেতো সম্ভাবনার দুয়ার আরও অবারিত হয়েছে বহুমাত্রিকতা নিয়ে। যারা এই সম্ভাবনার সিঁড়ির নাগাল পেয়েছে, তাদের উর্দ্ধারোহন হয়েছে দ্রুত গতিতে। যারা পায়নি তাদের দুনিয়া কানামাছি ভোঁ ভোঁ সমতুল্য। দশবছর আগে বিভাগীয় এক শহরের যে জায়গাটা ছিলো ময়লা আবর্জনার ভাগাড় এবং পুঁতিগন্ধময়, অতি সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখি দৃষ্টিনন্দন সুপার মার্কেট সহ অত্যাধুনিক মানের কম্যুনিটি সেন্টারের গর্বিত উপস্থিতি। এই বাস্তবতা পাল্টানো কারিগরের সাথে পরিচয়ের পর অনেক্ষণ আলাপচারিতা হলো। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম- কিভাবে কি করলেন? তিনি বল্লেন-পাপে লক্ষ্মী খিলে ধান এ জাতীয় প্রবচন এই দেশের জন্য যথাযথ এবং মানান সই। পাপের মধ্যে কিভাবে লক্ষ্মী আসে সেটি ক্ষেত্র বিশেষে অনুভবযোগ্য, আবার দৃশ্যমান ও বটে। কিন্তু খিলে ধানের বিষয়টি পরীক্ষিত এবং চক্ষুষ্মান। উষর তথা খিল জমিকে কষ্টে সৃষ্টে আবাদ করলে সেখানে সুপারবাম্পার ধান ফলে। দৃষ্টান্ততো চোখের সামনেই। ভাগাড় রূপান্তরিত হয়েছে নন্দিত স্বর্গে। ভদ্রলোক প্রবাসী। এখন প্রবাস ছেড়ে স্বদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের চিন্তাভাবনা করেছেন। বল্লেন- গোটা বিশ্বে এখন টাইট অবস্থা বিদ্যমান। রাতারাতি উর্দ্ধারোহণের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও ব্যতিক্রমী। এখানে ভাগ্যবদল ঘটানো যায় সুপারসনিক গতিতে। তার জন্য ক্ষেত্র আবিষ্কার করতে হয়। যারা মেধাবী তাদের জন্য ক্ষেত্র আবিষ্কারের দোয়ার খোলা। মেধার পক্ষে সব সম্ভব। গাঁধার জন্য কিছু নেই। যাই হোক, ভাগ্যবদল যে সহজে হয় সেটি অতীতের মেধাবী আলু, ফালু,জালু এবং বর্তমানের স¤্রাট, বাদশা, উজির নাজিরদের চোখ ঝলসানো রুশনাইর দিকে দৃষ্টিপাত করলেই সহজে বোঝা যায়। গোটা দেশ চষে বেড়ালে এদের সংখ্যা কোন ডিজিটে উপনীত হবে সেটা কৌতুহলের বিষয়। এমতাবস্থায় অপার সম্ভাবনাময় এই দেশের যতটুকু সম্ভাবনা আছে তার সিংহভাগইতো তাদের করতলে। পাবলিক মানি থেকে আরম্ভ করে কোষাগারের বরাদ্দকৃত অর্থের উপর তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ছোবল চলে আসছে অতীত থেকে অদ্যবধি পর্যন্ত। ইঁদুর যেমনি গোদামের বস্তাবন্দী ধান চাল নিজ ক্যারিশমা বলে কেঁটে নিয়ে নিজ নিজ গর্তে ভরে রাখে, তদ্রুপ রাষ্ট্রীয় তস্কররাও যে যে অবস্থায় রয়েছে সেখান থেকে সম্পদ লুন্টন করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাচ্ছে। এই অব্যাহত লোটপাট প্রক্রিয়ার পরও ক্যারিশমা বলে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের সূচক উর্দ্ধমুখী হয়ে উঠেছে, সেটি গবেষণার দাবী রাখে। শেখ হাসিনার ম্যাজিক এখানেই নিহিত। দেশব্যাপী ইঁদুর তৎপরতা এবং ইঁদুরের গর্ত বন্ধ করে দিলে ২০৪১ সন নয়, ২০৩১ সনের মধ্যেই বিশ্বমহলে বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য হতে পারতো নিঃসন্দেহে।
বলতে দ্বিধা নেই , স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকেই দেশীয় সম্ভাবনা রাহু গ্রাসের কবলে যাবার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল । ৭৫ সনের পটপরিবর্তনের পর ধীরে ধীরে তা ষোলকলায় পূর্ণতা লাভ করে। এ দেশ সম্ভাবনাময় ঠিকই । কিন্তু সম্ভাবনাকে নানা ভাবে টুটি চেপে রাখা হয়েছে নানা ভাবে । বলাবাহুল্য দেশের উলে¬খযোগ্য একটি অংশ এদেশীয় স্বাধীনতা চায়নি। তারা পাকিস্তানকেই নিজ দেশ বলে মনে করতো। এমতাবস্তায় যে দেশকে তারা চায়নি সে দেশের উন্নয়ন তাদের কাম্য হতে পারে না। সামরিক শাসকদের ছত্রছায়ায় থেকে তারা তথাকথিত দেশ প্রেমিক হয়ে ব্যক্তি এবং গোষ্টি উন্ন্য়নকেই প্রধিকার দিয়েছে । দেশ খাদ্যে স্বয়ং সম্পুর্ণ হলে বিদেশী সাহায়্যের প্রবাহ কমে আসবে – এমন মন্তব্য করেছিলেন চারদলীয় জোট সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী । শুধু খাদ্যে নয়, সব সেক্টরকেই তারা এগুতে দেয়নি উলে¬খিত ফর্মুলার কারনে । মূলত দেশকে ফোঁকলা দেখিয়ে বৈদেশিক ঋণ ও বরাদ্দকে টেনে এনে লুটপাট করে খাওয়ার কালচার তারা চালু করেছিল । এই কালচারকে পুরো মাত্রায় আত্মস্থ করেছে পার্সেন্টেজ ভোগী আমলা এবং ধান্ধাবাজ রাজনীতিকরা । দেশ উন্নয়নমূখী হলে এনজিওদের লীলাখেলা থেমে যাবার আশংকায় তারাও একই গোত্রভুক্ত হয়েছে। তাদের সাথে একাকার হয়েছে ছদ্মবেশী আরো বিভিন্ন মহল । তদেরও মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশীয় সম্ভাবনাকে লুটেপুটে খাওয়া । এদের চারিত্রিক আভাস বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন বক্তব্যে স্পষ্টভাবে অনুরণিত হয়ে ছিল । উপসংহারে শুধু বলা যায় , দেশে বর্তমানে দুটি ধারা বিদ্যমান। একটি হচ্ছে উন্ন্যনের ধারা এবং অপরটি হচ্ছে লুটপাট তথা দুর্নীতির প্রবাহ । দুটি পরস্পর দ্বান্ধিক । শেষোক্তটির ভিত শক্ত । আঁকাবাঁকা পথে চলাচলকারী পথিক কখনো সোজা পথকে পথ মনে করেনা । ঘোলাজল পানে যারা অভ্যস্থ তারা স্বচ্ছ জলকে কলসিতে ভরেনা । গ্রামীণ প্রবাদ আছে- কুকুরের পেটে উচ্ছিষ্ট ছাড়া ঘি ভাত হজম হয়না । এ আলোকে যুগযুগান্তরের পরিক্রমায় অনিয়ম , লুটপাট তথা দুর্নীতির বন্ধনে আষ্টেপৃষ্টে যে সমাজ বাঁধা , সেই সমাজ ব্যবস্থায় সুনীতি ও দেশ প্রেমের অধিষ্টান কষ্টকর তথা চ্যালেঞ্জিং বৈ কি । তাই দুর্নীতি উপড়ানোর ব্যাপারে শেখ হাসিনার ঘোষনা কি টলটলায়মান হয়ে যাবে? এ প্রশ্নটি সমাজ অন্তরালে ঘোরপাক খাচ্ছে । দুর্নীতির বিরুদ্বে জিহাদ ঘোষনাকারী সামরিক শাসক এরশাদ এবং ১/১১ এর ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের পরিণতির অভিজ্ঞতায় এ প্রশ্নটি উঠাই স্বাভাবিক । তবে উপরোক্ত দুই সরকার এবং শেখ হাসিনা সরকারকে একই মানদন্ডে পরিমাপ করা বোধয় ঠিক হবেনা । পাপে যেমন লক্ষী থাকে তেমনি সাহসেও লক্ষীর ভরসা আছে ।
লেখকঃ কলামিষ্ট ও সিনিয়র সাংবাদিক