সরওয়ার আহমদঃ
মাছে ভাতে বাঙ্গাঁলীর এই দেশে মাছের আকাল কখনও ছিলো না। প্লাবনভূমি, বিল, হাওড়, নদী, বাড়ীর পুকুর সহ এখানে সেখানে মাছ পাওয়া যেতো। গ্রাম জনপদের অধিকাংশ পরিবার মাছ ধরেই ক্ষুন্নিবৃত্তি সামলাতেন। শহরে বসবাসকারীরা বাজারের মাছের প্রতি ছিলেন নির্ভরশীল। গ্রামজনপদের বিত্তশালী রসনাবিলাসীরাও বাজারমুখী হতেন বড়মাছ কেনার লক্ষ্যে। মৌসুম এলে বাংলার রূপালী ইলিশ সব শ্রেনীর ভোক্তাকে বাজারমুখী করতো তার আপন মহিমাবলে। শ্রাবণ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত বিস্তৃত থাকতো ইলিশের আধিপত্য। চাঁদপুরের ইলিশের পাশাপাশি কুশিয়ারার ইলিশেরও যোগান ছিলো হাটবাজারে। মনু এবং কুশিয়ারার সঙ্গঁমস্থল মনুমুখ সহ উজান ভাটিতে ছেলেদের জালে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়তো। মনুমুখ বাজার এবং শেরপুরের বাজারে ধৃত ইলিশ পাওয়া যেতো। স্থানীয় ইলিশের পাশাপাশি চাঁদপুরের ইলিশেরও যোগান ছিলো হাটবাজারে। চাঁদপুর থেকে ট্রেন যোগে হিমায়িত ইলিশ ছুটে আসতো বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে। ইলিশের দামও ছিলো নাগালের ভিতরে। স্কুলের তৃতীয় চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্র হিসেবে সেই ষাটের দশকের সূচনাতে আমি নিজেও একটাকায় মধ্যম আকৃতির দুটি ইলিশ ক্রয় করেছি। বড় আকৃতির একটি ইলিশের দাম তখন ছিলো ১ টাকা। ক্রয় ক্ষমতা বিবেচনা করে মাছ বিক্রেতা ইলিশকে খন্ড খন্ড করে কেটেও বিক্রি করতো। নি¤œ বিত্তের ক্রেতারা আস্ত ইলিশ কিনতে না পারলেও কাটা ইলিশ কমদামে ক্রয় করে ইলিশের স্বাদ ভোগ করতো। ইলিশ মাছের মাজেজাও ছিলো আলাদা। এক বাড়ীতে ইলিশ ভাঁজা হলে তার গন্ধ অন্যবাড়ীতেও ছড়িয়ে পড়তো। ঘ্রাণ সমৃদ্ধ রান্না ইলিশ নিয়ে গৃহিনীরাও পড়তেন বিপাকে। ইলিশের ঘ্রাণে ঘরের পোষা বিড়ালও বেপরোয়া হয়ে উঠতো। হাঁড়ির ঢাকনা কোনক্রমে ফেলে দিয়ে মাছের টুকরা নিয়ে চম্পট দিতো বিড়াল। ভূত পেতœীরাও নাকি ইলিশের প্রতি আকৃষ্ট থাকতো। তাই রান্না করা ইলিশকে সুরক্ষিত স্থানে রাখা হতো। ইলিশ মাছের দরদাম শুনে হালআমলের পাঠকরা বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্নে দোলায়িত হতে পারেন। সেই আমলে বড় রুই, বোয়াল ২/৩ টাকায় কেনা যেত। চিংড়ি মাছের ভাগা ছিলো ২ আনা। টেংরা মাছের ভাগা ছিলো ৪ আনা। মাছ বেশি হলে ৮ আনায় উঠতো।
মাছ নিয়ে কিংবদন্তী বা সামাজিক প্রথা ছিলো ব্যাপক। বিয়ের পরদিন জামাইকে পাঠানো হতো মাছ বাজারে। জামাইর সাথে খেশকুটুম্বরাও হতেন সহযাত্রী। বাজার থেকে নতুন জামাই তার পছন্দ মতো বড়মাছ ক্রয় করতেন। সেই মাছ রান্না করানো হতো নতুন বউকে দিয়ে। এটি ছিলো শ্বশুর বাড়ীতে বউয়ের প্রাথমিক পরীক্ষার সমতুল্য। জামাইর কেনা মাছ নতুন বউ রান্না করার পর পাড়া প্রতিবেশীকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো হতো। রান্না ভালো না মন্দ হয়েছে, সেই মূল্যায়ন করতেন পাড়া প্রতিবেশীরা। নিজ গৃহে যদি ননদ থাকে, তহলেতো বিপদ। নতুন বউয়ের প্রতি তার একপ্রকার জেঁদ উকি দেবেই। ননদ মাছ তরকারির খুঁত আবিষ্কার করতে পিছ পা হয়না। এজন্য বলা হয়- ননদ কাঁটা, বিষম কাঁটা।
(——–চলবে)
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক