সরওয়ার আহমদঃ
‘দিন এলো আর দিন গেল তার চিরচেনা পথ ধরে, অনেক সূর্য্য আর বহু মেঘ সেই পথে গেলে ঝরে”। একটি জীবনকে যদি দিনের সাথে তুলনা করা যায় তাহলে জীবনে অনেক দিন আসে এবং অবলীলায় তার সমাপ্তি ঘটে অস্তমিত সূর্য্যরে মতো। প্রত্যুষের সূর্য্য যে অহমিকা নিয়ে উদয় ঘোষণা করে, গোধূলির সূর্য্য সেই অহংকারের পরিমন্ডলে যবণিকার রেখা টেনে অস্তাচলের বুকে সমর্পিত হয় প্রাকৃতিক নিয়মানুসারে। এই উদয়াস্ত পরিক্রমার মধ্যে পরিবর্তনের ছোঁয়া অবশ্যই বিদ্যমান। সৃষ্টি গতিশীল বলেই নিত্য পরিবর্তনের দোলায় দুলছে পৃথিবী, রাষ্ট্র এবং সমাজসহ ভূমন্ডলীয় অনেক কিছু। জীবনটাও পরিবর্তনশীল। সূচনা হয় শিশু অবয়বে। অতঃপর কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢত্ব এবং বার্ধক্যের সীমানা অতিক্রম করে প্রয়াণসমুদ্রে সমর্পণ। এইতো হচ্ছে জীবনরূপি সত্ত্বার পরিক্রম। এই পরিক্রমনের মধ্যে রয়েছে নানান বাঁক, রূপান্তরের ঘনঘটা এবং স্মৃতির অসংখ্য এ্যালবাম। থরে বিথরে সাজানো এই এ্যালবাম কালের সাক্ষী হয়ে কালান্তরের কথা বলে। কখনও ইতিহাসের উপজীব্য হয়ে উপাত্তের যোগান দেয়। তাছাড়া অব্যক্ত অনুভূতি মানসপটে বাক্সময় হয়ে হৃদয় মনকে আকুলিত করে।
বাস্তবতার ভিত্তি ভূমে দাঁড়িয়ে চক্ষুষ্মান অনুভূতিকে সজাগ করলে নির্বিঘেœ বলা যায়-হায় আজি যে রজনী যায় ফিরাইব তায় কেমনে। গতিশীল প্রকৃতির ঘূর্ণায়মান চাঁকাকে কোনো শক্তি বলেই থামানোর সাধ্যি কারো নেই। এই ঘূর্ণায়মান প্রেক্ষাপটের আলোকেই আগামী হয় বর্তমান এবং বর্তমান হয় অতীত। স্বস্তি কিংবা অস্বস্তির ঘেরাটোপে বর্তমান আচ্ছন্ন থাকলেও আগামী কিংবা ভবিষ্যত থাকে আশা জাগানিয়া এবং ক্ষেত্র বিশেষে কল্পনামুখর। এজন্যই অনাগত আগামীর ফাঁনুসে মানুষ বর্তে থাকার ভরসা পায়। আর অতীত! সেতো কেবলই স্মৃতিময়। অতীতের দুঃখবোধও স্মৃতির আয়নায় সমূজ্জ্বল এবং সুখানুভূতির স্পর্শে মহিমান্বিত। সুখের স্মৃতিতো আলাদা বিষয়। তাই স্মৃতির এ্যালবাম তার সব কটি জানালা খুলে দিয়ে বোধ সম্পন্নদেরকে আকুলিত করে। অনির্বচনীয় আবেগে হৃদয় গ্রন্থিকে টালমাটাল করে দিতে চায়। ফেলে আসা অতীত তাই মন্থনের দোলায় শোক জাগানিয়া এবং অনুভূতির ক্ষেত্রে ভারাক্রান্ত বলেই প্রতিয়মান।
ফেলে আসা অতীতের সবকটি দৃশ্যপট কলমী কারুকাজে বাক্সময় হয়ে উঠেনা। তারপরেও বিস্মৃতির অতল থেকে স্মৃতির মণিমানিক্য হাতড়িয়ে উপস্থাপন করলে অতীতের বাস্তবতা বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে। অতীত না থাকলে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ শিকড়হীন বৃক্ষের মতোই গন্য হবে। আত্মজীবনী উপস্থাপনের মতো ব্যক্তি এই সমাজে জন্মে কালেভদ্রে। আপন কর্মকান্ডে যারা মহিয়ান এবং সমকালের ইতিহাসে নিজস্ব মেধা এবং প্রজ্ঞা বলে যারা অবিচ্ছেদ্য অংশীদার এবং যাদের দীপ্তিতে দেশ ও সমাজ আলোকিত, কেবল তারাই আত্মজীবনী বর্ণনার অধিকারী। আমার মতো যারা ছাপোষা লেখক কিংবা সাংবাদিক, তাদের পক্ষে জীবৎ কালের দৃশ্যপট এবং পর্যবেক্ষণটাকে নির্মোহ ভাবে উপস্থাপন করলে সেটিও উপজীব্য হয়ে উঠতে পারে। বিশেষতঃ সমকালীন বাস্তবতার একটি লিখনী চিত্র হিসেবে কালের সাক্ষ্যবাহী হতে পারে। এই ধারণা থেকেই চলমান এই কলমি প্রয়াস।
(——–চলবে)
লেখকঃ সিনিয় সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
দিন গুলো মোর সোনার খাঁচায় রইলো না
