স্টাফ রিপোর্টারঃ সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা আন্ত:নগর উপবন এক্সপ্রেস ওভার স্পীডও রেললাইনের ত্রুটি’র কারনে ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। এতে ট্রেনের ৫টি বগি খাদে পড়ে। ঘটনাস্থলেই ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ২৫০ জন। রোববার রাত পৌনে ১২টার দিকে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল স্টেশন থেকে ২০০ মিটার দূরে কালা মিয়া বাজার সংলগ্ন একটি ব্রিজে এ দুর্ঘটনা ঘটে। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা গুরুত্বর। রাতে নিহতদের লাশ ও আহতদের উদ্ধারের পর সোমবার সকাল থেকে চলছে রেল লাইন মেরামতের কাজ। রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, সোমবার সন্ধার সাথে সাথে ফের ট্রেইন চলাচল স্বাভাবিক হবে।
সিলেট-ঢাকা, মৌলভীবাজার-ঢাকা ও হবিগঞ্জ-ঢাকা মহাসড়কের ভৈরব এলাকায় শাবাহাজপুর তিতাস সেতুর রেলিং ভেঙ্গে ৭ দিন ধওে যান চলাচল বন্ধ থাকায় ট্রেনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন ঢাকাগামী যাত্রীরা। ফলে ধারণক্ষমতার চেয়ে দিগুণ যাত্রী নিয়ে ট্রেনটি সিলেট থেকে ছেড়ে যায়।
জানা যায়, ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি সিলেট থেকে ছেড়ে আসার পরই অতিরিক্ত গতি বাড়ানো হয়। কুলাউড়ার বরমচাল স্টেশনে ডোকার পরপর ড্রাইভার আরোও গতি বাড়িয়ে দেয়। স্থানীয়রা বলছেন পূর্ব থেকেই ঘটনাস্থলে কয়েকটি স্লিপারে ক্লিপ ছিলনা। যার কারনে ট্রেনটি ওবার স্পিডে থাকায় এ দূর্ঘটনা ঘটে। স্লিপারে ক্লিপ বসানোর জন্য স্থানীয়রা একাধিকবার কর্তৃপক্ষকে বললেও তারা কর্ণপাত করেনি। এনিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা সৌদি আরব প্রবাসী লুৎফুর রহমান রাজু চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারী একটি পোস্ট দেন। এতে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং স্থানীয়দের সচেতন হওয়ার আহব্বান করেন। এর পরেও কোনো গুরুত্ব দেয়নি রেল কর্তৃপক্ষ।
সিলেট থেকে কুলাউড়ার লংলাগামী যাত্রী ফয়ছল আলী (২৫) জানান বিকট শব্দে প্রথমে আতংকিত হয়ে অনেক যাত্রী ভয় পায়। তিনি বলেন, প্রথমে তারা বুঝতে পারেননি। অনেক সময় আটকে থাকার পর রেল থেকে নেমে দেখতে পান পেছনের দিকে ৫টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে গেছে। তখন অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসও আসে। তারা তখন বুঝতে পারেন বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। রেল লাইনের নিকটস্থ বাসিন্দা প্রত্যক্ষদর্শী ফারুক মিয়া জানান শব্দ পেয়ে আমরা এলাকাবাসি এসে আহতদের উদ্ধার করি।
আহতদের উদ্ধার করার জন্য মসজিদে আহ্বানঃ স্থানীয়রা খবর পাওয়ার পরপরই ট্রেন যাত্রীদের উদ্ধার করার জন্য মসজিদে আহ্বান করেন। তখন চতুর্দিকে খবর ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আসার আগেই স্থানীয়রা উদ্ধার কাজ শুরু করেন।
তদন্ত কমিটি গঠন: মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ট্রেন দুর্ঘটনায় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে চিফ ম্যাকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার (পূর্বাঞ্চল) মিজানুর রহমানকে প্রধান করে ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি ও বিভাগীয় কর্মকর্তা মইনুল ইসলামকে প্রধান করে আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৪ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন রেল পথ মন্ত্রনালয়ের সচিব মোফাজ্জল হোসেন।
তিনি জানান, চিফ ম্যাকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার (পূর্বাঞ্চল) মিজানুর রহমানকে প্রধান করে ৪ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসময় দূর্ঘটনার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্তক্রমে জানা যাবে। তিনি সোমবার সকাল সোয়া ৮টায় বিশেষ ট্রেনে করে কুলাউড়া স্টেশনে পৌঁছান। এখান থেকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান।
রেলওয়ে সচিবের গঠনাস্থল পরিদর্শনঃ রেলওয়ে সচিব মোফাজ্জল হোসেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শন শেষে সাংবাবিকদেরকে ব্রিফ করে তিনি বলেন। কি কারণে ট্রেনটি দুর্ঘটনা কবলিত হয়েছে তার কারণ উদঘাটনের জন্য চার সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের চীফ ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জলিল, চীফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মিজানুর রহমান, সিএসটি মাইনুল ইসলাম, সিওপিএস সুজিত কুমার। তদন্ত কমিটি ঘটনার তিন কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
নিহতদের পরিচয়: নিহতরা হলেন কুলাউড়া উপজেলার আব্দুল বারির স্ত্রী মনোয়ারা পারভীন-(৪৫) সিলেট নাসিং কলেজের ছাত্রী সিলেট সদরের আব্দুল্লা পুরের আব্দুল বারির মেয়ে-(২০) একই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী বাগেরহাট জেলার মোল্লারহাট উপজেলা আটজুড়ি গ্রামের আকরাম মোল্লার মেয়ে সানজিদা আক্তার(২০) হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার নুর হোসেনের ছেলে কাওছার হোসেন-(২৬)।
আহতরা হাসপাতে চিকিৎসাধীন: আহতদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৭ জনকে মৌলভীবাজার ২৫০ শষ্যা বিশিস্ট হাসপাতালে আনা হয়েছে। এরমধ্যে ৩ জন এখনো চিকিৎসাধীন আছেন বলে জানা গেছে। বাকি প্রায় ২৪৩ জন আহত সিলেট, কুলাউড়া, ফেঞ্চুগঞ্জ, বড়লেখা ও অন্যান্য প্রাইভেট হাসপাতলে ভর্তি করা হয়।
কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের উপ-সহকারী কমিনিটি মেডিকেল অফিসার শাহানউজ্জামান জানান চিকিৎসা নিয়েছেন ৬৩ জন। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় মারাত্মক আঘাত থাকায় ২০ জনকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়েছে।
অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার রাশেদুল ইসলাম জানান, দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত চার জন নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজন নারী, বাকি একজন পুরুষ। লাশগুলোর পরিচয় পাওয়া গেছে এবং তাদের স্বজনরা হাসপাতালের মর্গ থেকে সনাক্ত করে লাশ নিয়ে গেছে।
মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম ও পুলিশ সুপার মো. শাহজালালসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রাতেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। নিজেরা উপস্থিত থেকে উদ্ধার ও মেরামত কাছে তত্ত্বাবধান করেন।