প্রত্যেক প্রাণেরই মৃত্যু নিশ্চিত। সে অবধারিত অলঙ্গনীয় মৃত্যু যা এড়িয়ে যাওয়ার শক্তি বা সুযোগ কারও নেই। তাই বলে মৃত্যুকে well come জানানোর বিধানও নেই। মানুষ স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে জীবনের মূল্য অনেক। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্য একটি জীবনের বিয়োগে কখনও কখনও অনেক মূল্য পরিশোধ করতে হয়। আমি মনে করি পৃথিবীর সকল সম্পদের চেয়ে একটি জীবনের মূল্য বেশি। আমরা সবাই হয়তো এভাবেই মূল্যায়ন করি। তাই জীবনটা আগে।
মৃত্যু একদিন, সাবধানতা প্রতিদিন।
কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়ে সরকারের যে বিধি বিধান রয়েছে তা ঐচ্ছিক । বিষয়টির সাথে আমি অর্ধেক দ্বিমত পোষণ করি। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা, আমাদের শিক্ষা, মূল্যবোধ সার্বিক বিষয় বিবেচনায় শুধু সচেতনতাই আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়। একাধিক উন্নত দেশে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। সেখানে আমি রাতারাতি সচেতন হয়ে যাইনি। অথচ পূর্ণভাবে আমি কর্মক্ষেত্রে হেলমেট, হ্যান্ডগ্লাভস, ব্যাল্ট, সেফটি বুট, মাক্সসহ যাবতীয় জিনিস ব্যবহার করেছি। এটা ছিল বাধ্যবাধকতা; সচেতনতা নয়। আমি যে মানুষটি বাংলাদেশে যে জিনিসগুলোর নামই শুনিনি সেই মানুষটি বিদেশে গিয়ে রাতারাতি সভ্য-সচেতন হয়ে গেলাম- বিষয়টি পাগলে ও মানবে না। আসলে সেখানের আইন মানতে আমি বাধ্য ছিলাম। এখানে সচেতনতার বিষয় সম্পূর্ণ গৌণ।
দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় বাংলাদেশের নির্মাণ শিল্পের সাথে আমি সস্পৃক্ত। এ দীর্ঘ সময় আমার অসংখ্য ব্যক্তিকে জানা আছে, যারা একাধিকবার মাচাং থেকে পড়লেও তাহাদেরকে সচেতন করতে আমি ব্যর্থ হই। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো যে মাচাং থেকে একবার পড়েছে সে বারবার পড়ে। এর কারণ ঐ মানুষটি উদাসীন। আমাদের পরামর্শকে তারা সব সময় গুরুত্ব দেয় না। আমার একজন পরিচিত মিস্ত্রী আছেন তিনি মাচাং থেকে পড়লে আমি এখন আর হতাশ হই না বরং আশ্চর্য হই যে, কিভাবে তিনি বেঁচে আছেন!
বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যুর হার সবচাইতে বেশি। ছোটখাট ঘটনা তেমন আলোচনায় আসে না। বড় দূর্ঘটনায় প্রশাসনকে সাময়িক নড়েচড়ে বসতে দেখা গেলেও এক সময় সব কিছু ভুলে যান। কিন্তু সংশ্লিষ্ট পরিবারকে এই ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয় যুগ যুগ। পেশাগত ক্ষেত্রে সচেতনতা ও নিরাপত্তা বিষয়ক সরকারি এক কর্মসূচির অধীনে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে নির্মাণ প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান সাহেব ও আমি উপস্থিত ছিলাম। বছরের নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট মানুষের উপস্থিতিতে সীমিত আকারের এই তৎপরতায় আমি বড় বেশি আশাবাদী হতে পারিনি।
সচেতনতা অবশ্যই প্রয়োজন। তবে সাথে সাথে সরকারকে আইনী বাধ্য বাধকতার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে জন-নিরাপত্তার বিষয়ে আইন তৈরিতে এমন উদাসিনতা কাম্য নয়। আশার দিক হলো, কিছু বড় প্রতিষ্ঠান নিজ উদ্যোগে নিজ নিজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে সেফটির বিষয়ে সচেতন রয়েছে। সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ইহা একটি খন্ডিত চিত্র মাত্র। আমি মনে করি সরকারি আইনের অপেক্ষা না করে বিভিন্ন নগরপতিরা নিজ নিজ অঞ্চলের জন্য কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার জন্য বিধি বিধান তৈরি করে নিজ উদ্যোগে তা বাস্তবায়ন করতে পারেন। পাশাপাশি পেশাভিত্তিক শ্রমিক ইউনিয়ন, এনজিও সহ সামাজিক সংগঠনের সহায়তায় এ কার্যক্রম তরান্বিত করতে পারেন।
দৃষ্টিভঙ্গি:
মানুষের জীবনবোধ-দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়, সব মানুষই বাঁচতে চায়, জীবনের মূল্য সবার সমান, কিন্তু উপলব্ধিতে ব্যবধান আকাশ-পাতাল। একজন প্রাসাদ বানান তিনি প্রাসাদে থাকবেন তার উচ্ছাভিলাস রয়েছে। তিনি বাড়ির মালিক, তার কাছে জীবনের মর্ম এক রকম। পক্ষান্তরে আরেকজন (মিস্ত্রী) প্রাসাদ বানান দু’মুঠো ভাতের জন্য তিনি শ্রমিক। জীবনের উচ্ছাবিলাসী মর্ম সে বুঝে না। সে কাজের জন্য বাঁচে, নাকি বাঁচার জন্য কাজ করেন ।এই প্রশ্ন তার কাছে অবান্তর। এ ধরণের মানুষগুলোর কাছে সচেতনতার প্রত্যাশাও অবান্তর।
দুর্ঘটনার জন্যে আমি শ্রমিকের চেয়ে সরকার, মালিক ও প্রতিষ্ঠানকে বেশি দায়ী করতে চাই। এ বিষয়ে ত্রি-পক্ষীয় উদ্যোগ সমন্বয় ও সহযোগিতা কাম্য। একজন নামিদামী লোক দুর্ঘটনায় মারা গেলে আদালত থেকে ৫০ লক্ষ টাকার ক্ষতি পূরণের ডিক্রি আসে। অথচ শ্রমিক মারা গেলে ১ লক্ষ টাকার ক্ষতি পূরণের রায় আসে। তাও আবার পুলিশ, সাংবাদিক, ফায়ার সার্ভিস, শ্রম অধিদপ্তর, সর্বশেষ বাংলাদেশে অবস্থিত ৭টি লেবার কোর্টের যে কোন একটিতে প্যারট মারতে মারতে ৩০-৪০ হাজার গচ্চা দিয়ে প্রাপ্তি (১,০০,০০০-৩০,০০০=৭০,০০০/-) টাকা। তাও ভাগ্য যদি অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।
একটি দৃষ্টিনন্দন বিলাসী প্রাসাদের ভাজে ভাজে যে রক্ত, যে প্রাণ যায় তার ক্ষতি কিন্তু পরিবার যুগের পর যুগ বহন করে এবং এ ক্ষতি বুকে নিয়েই ভাঙা ঘরে নিশিরাত ছটপট নির্ঘুম রাত কাটায় কিন্তু কোন বিলাসী প্রাসাদ মালিক কি একবারও সেই রক্ত, সেই প্রাণের ব্যথায় ব্যথিত হয়েছেন?
লেখক:
তাজুল ইসলাম
দপ্তর সম্পাদক
মৌলভীবাজার জেলা নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ ইউনিয়ন