দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে মানুষের প্রয়োজনে সময়ের প্রয়োজনে সরকার বিভিন্ন জনবান্ধব আইন পাশ করে থাকেন। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের সড়ক মহা সড়কে অরাজকতা চলছে। কিছুদিন পূর্বে ঢাকায় ঈগল পরিবহনের একটি বাসের চাকায় পিষ্ঠ হয়ে মৃত্যু হয় এক পুলিশ কর্মকর্তার। সংবাদমাধ্যমে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় রিপোর্ট থেকে জানা যায় বাসটি পুলিশ কর্মকর্তা ও তার মোটর সাইকেলটিকে টেনে হিচড়ে ১০০ গজ নিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই পুলিশ কর্মকর্তা উত্তম কুমারের মৃত্যু হয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত আর একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায় সম্প্রতি চট্রগ্রামে ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটির জের ধরে রেজাউল করিম নামে এক ব্যক্তিকে বাস থেকে ছুড়ে ফেলে বাসের চাকায় পিস্টে হত্যা করা হয়। কতটা নিষ্ঠুর হলে বাস চালাক বা পরিবহন শ্রমিকরা এমন ঘটনা ঘটাতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। পরিবহন শ্রমিকদের এই ঔদ্বত্যের রহস্য বাংলাদেশের নাগরিকরা জানতে চায়।
নিরাপদ সসড়কের দাবিকে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের একটি আন্দোলন দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে, মানুষ এই আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে এই আন্দোলন ছিল মানুষের নিরাপত্তার জন্য। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের পরও সড়ক -মহাসড়কে মৃত্যুর খবর প্রায়ই পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ফিটনেস ও লাইসেন্সবিহীন গাড়ী অদক্ষ চালক সহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবরাখবর প্রকাশিত হচ্ছে। দূর্বল আইনি ব্যবস্থার কারনেই যেন দেশের পরিবহন ব্যবস্থা দিনদিন এক ভয়ংকর মরণফাঁদে পরিণত হচ্ছে। দেশের সচেতন মানুষ মনে করেন সময়োপযোগী আইন ও তা বাস্তবায়নের অভাবেই সড়ক দূর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ এর এক জরিপে উঠে এসেছে বাংলাদেশে প্রতিদিন সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হন প্রায় ৬৪ জন এবং বছরে ক্ষতি হয় প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাক। আইনি দূর্বলতার কারণে সড়ক দূর্ঘটনার বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে কোন প্রতিকার পাবে না ভেবে অনেকে থানায় মামলা করেন না। অনেক ক্ষেত্রে মামলা করার পর ও আসামীরা অভিযুক্ত হলেও দূর্বল আইনের কারণে শাস্তি হয় না। বিচারহীনতায় সংস্কৃতিই এ দেশের পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের আর ও বেপরোয়া করে তুলছে। যার একটি বড় প্রমান ২৮অক্টোবর ২০১৮ইং রবিবার ভোর ছয়টা থেকে ৪৮ ঘন্টা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের অযৌক্তিক হরতাল।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলে গত ৬ আগস্ট সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ মন্ত্রিসভায় ছুড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় আইনের শাস্তি ও জরিমানার কিছু বিধান নিয়ে মালিক – শ্রমিক সংগঠনগুলো আপত্তি দিলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সভাপতিত্বে চলতি বছরের ৪ জানুয়ারী মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান ও ছিলেন। আইন পাসের পূর্বে মালিক-শ্রমিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মতামত ও নেওয়া হয়েছে। ১৯ অক্টোবর ২০১৮ আইনটি সংসদে পাস হয়। এই অবস্থায় আইনটির বিরোধীতা করে ৪৮ ঘন্টার ধর্মঘট পালন করলো সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। তাদের দাবী হলো সড়ক দূর্ঘটনার সব মামলা জামিন যোগ্য করা, দূর্ঘটনায় চালকের ৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান বাতিল করা, চালকের শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণীর পরিবর্তে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত করা। ৩০২ ধারার মামলার তদন্ত কমিটিতে শ্রমিক প্রতিনিধি রাখা, গাড়ী নিবন্ধনের সময় শ্রমিক ফেডারেশন প্রতিনিধির প্রত্যয়ন বাধ্যতামূলক করা ইত্যাদি। দেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খল এবং বিপদমুক্ত রাখতে সময়োপযোগী আইন ছিলনা আমাদের দেশে। প্রায় ৩০ বছরের পুরানো মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর ওপর ভর করে চলছে সড়ক পরিবহনের নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা, তাছাড়া পাঁচ বছরের সাজা ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান এর এই নতুন আইন ভয়াবহ কান্ডজ্ঞানহীন সড়ক দূর্ঘটনা রোধে কতটুকু ভূমিকা রাখবে তা সময়ই বলে দিবে। এর পরে ও নতুন আইন প্রয়োগ করায় নাগরিক সমাজের মাঝে এক ধরনের স্বস্তি ফিরে এসেছে বলে প্রতিয়মান হয়। কিন্তু যে সমস্ত দাবী নিয়ে ধর্মঘট পালিত হলো এ সমস্ত দাবী দাওয়া বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় আইন যেন পরিবহন শ্রমিকদের স্পর্শই করতে পারবে না। আর এ বিষয়টি বুঝতে হলে আইনের ছাত্র বা আইন বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই বলে মনে করি। ধর্মঘট চলাকালে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংবাদপত্রের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যে কারনে মৌলভীবাজারের বড়লেখা ও সুনামগঞ্জে দুটি শিশুর মৃত্যুর ও খবর পাওয়া গেছে। দাবী মানা না হলে পুনরায় ৯৬ ঘন্টার ধর্মঘটের হুমকি ও শোনা যাচ্ছে। যে কোন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন নিয়মকানুনের মধ্যেই পরিচালিত হয়ে থাকে। কোন ন্যায্য দাবী আদায়ের জন্য ধর্মঘট পালন করতে হলে ১৫ দিন পূর্বে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দেওয়ার আইনি বিধান রয়েছে। কিন্তু সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন এই ধর্মঘটের ক্ষেত্রে নোটিশ দিয়েছে বলে জানা যায়নি। শ্রমিকদের এই কর্মসূচিকে কর্মবিরতি হিসেবে চালিয়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই। বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত যানচালকদের কানধরে উঠবস করিয়েছেন পরিবহন শ্রমিকরা। ধর্মঘটের মধ্যে তারা গাড়ী বের করেছিলেন এটিই তাদের অপরাধ। স্কুল ছাত্র-ছাত্রীরা ও রেহাই পায়নি তাদের নির্যাতন থেকে। সাংবাদিক, শিক্ষক, সাধারণ নাগরিক শ্রমিকদের হয়রানীর শিকার হয়েছেন। যে কোন বৈধ এবং যৌক্তিক জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ধর্মঘট বা হরতাল চলাকালে সংবাদপত্রের গাড়ি এবং অ্যাম্বুলেন্স চলতে কোন বাধা নেই এটা সবারই জানা। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হলো ৪৮ ঘন্টার এই ধর্মঘটকে কোন অবস্থাতেই আইনসিদ্ধ বৈধ ধর্মঘট বলা যাবেনা, এটাকে বলা যায় পরিবহন নৈরাজ্য। এটা মানবাধিকার পরিপন্থি কাজ।
সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষাণার ৫ ধারায় বলা হয়েছে কাউকে নির্যাতন অথবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক অথবা অবমাননাকর আচরন অথবা শাস্তি ভোগে বাধ্য করা চলবে না। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষনায় প্রত্যেকেরই নিজ স্বার্থ রক্ষার্থে শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন ও এতে যোগদানের অধিকারের কথা যেমন বলা হয়েছে তেমনি কাউকে কোন সংঘবদ্ধ হতে বাধ্য না করার কথা ও বলা হয়েছে। মানবাধিকার হলো ব্যক্তির মানবসত্বা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। ৪৮ ঘন্টা ধর্মঘট চলাকালে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষকে বিভিন্নভাবে হয়রানীর মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিসত্বা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারের উপরে আক্রমন করা হয়েছে। মানুষকে অপমান করা, ব্যক্তি মানুষকে মূল্য না দেওয়া, গণতন্ত্রের চেতনারও পরিপন্থি। রাষ্ট্রের সর্বস্তরের নাগরিকগন যে কোন অবস্থায় যাতে অসহায়বোধ না করেন সেই সুরক্ষা দেয়া রাষ্ট্রেরই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। শ্
রমিক সংগঠনের ধর্মঘট চলাকালে অনেক মানুষই অসহায়বোধ করেছেন বলে প্রতিয়মান হয়েছে। আইন করে এ ধরনের পরিবহন নৈরাজ্য বন্ধ করা উচিত মনে করেন সচেতন মহল। এই নৈরাজ্যের কারণে মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে, মানুষ তার চলাফেরার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছেন না। দেশের নাগরিকগন তাদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারছে না। ধর্মঘটের নামে পরিবহন শ্রমিকরা মানুষের চলাচলে বাধা দিতে পারেন না। হামলা করতে পারেন না, এজন্য দোষীদের বের করে শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। অ্যাম্বুলেন্স আটকানোর কারণে শিশুদের যে নির্মম মৃত্যু হলো এর জন্য দোষীদের যথাযথ শাস্তি হওয়া দরকার। অনেক জায়গায় গাড়ীর চালক ও যাত্রীদের গায়ে পোড়া মবিল লেপ্টে দেওয়া হয়েছে। লাশবাহী গাড়ি আটক করে চালককে মারধর করার খবর ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। পরিবহন শ্রমিকদের এ ধরনের নৈরাজ্যের কারণে দেশবাসী স্তম্ভিত।
সচেতন দেশবাসী সরকারের কাছে এর প্রতিকার আশা করে। এই ধরনের অপমান নিষ্টুরতা অপরাধ মানুষ আর দেখতে চায় না। এ ধরনের নির্যাতন জুলুম করে অপরাধীরা যদি পার পেয়ে যায় তাহলে ন্যায় বিচারের বিষয়টি কাগজে কলমেই থেকে যাবে। ধর্মঘটের নামে যা আমাদের দেশে ঘটে গেল একটি আইনকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের উপর এ ধরনের নিষ্টুর আচরণ পৃথিবীর কোন সভ্য জাতি কল্পনাও করতে পারে না বলে মনে করি। দেশের নাগরিকদের স্বার্থে মানুষের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সড়ক পরিবহন আইন করেছে সরকার। এ আইনের বিরোধীতা করেছে শ্রমিক সংগঠন। এ কারণে নির্যাতন ভোগ করবেন সাধারণ মানুষ, শ্রমিকদের নিষ্টুরতার শিকার হবেন দেশের সম্মানিত নাগরিক সমাজ এটা হতে পারে না। এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। এটি আইনের শাসনের পরিপন্থি। সমাজে আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত না থাকলে সামাজিক শান্তি স্থিতিশিলতা আর্থসামাজিক উন্নতি ও প্রগতি আসে না। আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার পৃথিবীর সকল সভ্য সমাজের অগ্রগতির মূলমন্ত্র।
বাংলাদেশের মানুষ বোমা, গ্রেনেড, রামদা সংস্কৃতি আর দেখতে চায় না। দেশের মানুষ সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর বাস্তবায়ন দেখতে চায়। ধর্মঘটের নামে নৈরাজ্য ও বর্বরতার বিরুদ্ধে দেশের সচেতন মানুষ জেগে উঠেছে। বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন সহ নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে। প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনায় আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারলেই সড়ক মহাসড়ক ঘিরে সকল অরাজকতা দূর করা সম্ভব।
লেখক:
মোহাম্মদ আবু তাহের
ব্যাংকার ও কলামিষ্ট, মৌলভীবাজার।