নির্মাণ শিল্পিরা বিশ্বসভ্যতার স্থপতি।
আদি যুগে মানুষ যখন পাহাড়ের গুহায় বাস করত তখন গুহা তৈরিতে যে হাতুড়-বাটাল ব্যবহৃত হত সেটা এখনও নির্মাণ শিল্পের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত। বিজ্ঞানের নানাবিদ অবিষ্কারে নির্মাণ শিল্প অবদান রাখলেও হাতুড়ি-বাটালের চাহিদা সমান্তরাল ভাবে চলছে। সেই আদি অন্ধকার যুগ থেকে একবিংশ শতাব্দির নগরসভ্যাতার বিষ্ময়কর চোখ ধাদানো দৃশ্যমান অগ্রগতিতে নির্মাণ শ্রমিকের অবদান কোনো অংশে কম নয়। শহর-নগর-বন্দর সভ্যতা বলতে মূলত দৃশ্যমান কিছু অবকাটামো বা স্থাপনার স্মৃৃতি আমাদের মানসপটে ভেসে আসে। এটাই আধুনিক সভ্যতা।
প্রাচিন ব্যবিলন, রোম ও পারস্য সভ্যতা নির্মাণ শিল্পির দান। মিশরের পিরামিড, চীনের মহা প্রাচীর, আগ্রার তাজমহল ও বাংলার পদ্মা নির্মাণ শ্রমিকের সৃষ্টি। বিমানবন্দর, টাওয়ার, রেলওয়ে, সেতু ও মহাসড়ক নির্মানের অংশ। বিভিন্ন স্থাপনা, প্রাসাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও নির্মান শৈলী নিয়ে চমকপদ কেচ্ছা-কাহিনী, আলাপ-আলোচনা, লেখা-লেখি, কবিতা- সাহিত্য, গল্প- উপন্যাস থাকলেও যাদের শ্রম-ঘাম মেধা জীবন হাড় রক্তে গড়া প্রাসাদ সে নির্মাণ শ্রমিকের কথা হর হামেসা উহ্য থেকে যায় ।
‘নির্মাণ শিল্পী’ বা ‘নির্মাণ শ্রমিক’ বহুল পরিচিত শব্দ নয়, মূলত ‘রাজমিস্ত্রী’ হিসাবে তারা বহুল পরিচিত। হয়ত প্রথমে রাজারা সম্পদের মালিক ছিল বা বাড়ি-প্রাসাদ তৈরির সমর্থ ছিল তাই সে রাজাদের ঘর বাড়ি তৈরির মিস্ত্রীকে রাজমিস্ত্রী বলা হত। আজকের মত কাজের মহুমুখি ক্ষেত্র প্রাচীন যুগে ছিল না । তখন রাজদরবারের সাথে সংশ্লিষ্টরা সমাজে ভাল অবস্থান বা সচ্চল ছিল। রাজমিস্ত্রী সে সুবাদে সমাজে ভাল অবস্থান ছিল। নির্মাণ শিল্প সব দেশে সব সময় সমভাবে বিকশিত হয় না। এর সাথে দেশের অর্থনীতি, সময় ও প্রয়োজনীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। ইউরোপের অনেক সমৃদ্ধ দেশে এখন আর অবকাঠামো তৈরির প্রয়োজন নেই। সেখানে নির্মাণ শিল্পের বাজার সংকুচিত হয়ে আসছে। বাাংলাদেশ জন্ম শিশু-কৈশর পেরিয়ে এখন যৌবনে পর্দাপন করছে। বাংলাদেশে নির্মাণ শিল্পের এখন সোনালী দিন। বাংলাদেশে সরকারি বেসরকরি খাতে প্রচুর অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে। এ ধারা সর্বোচ্চ আগামী ৪০-৫০ বছর চলবে বলে আমি মনে করি। তারপর বাংলাদেশের নির্মাণ কাজ স্থবির হয়ে আসবে। নির্মাণ শিল্পে পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এই ভাল সময়ের পূর্ণ সুযোগ ঠিকই নিচ্ছে। কারণ তারা শিক্ষিত সু-চতুর দুরন্দর ও দূরদর্শি। প্রখ্যান্তরে যে নির্মাণ শ্রমিক তাদের জীবন হাড় রক্ত মেধা দিয়ে অনাহারে অর্ধাহারে থেকে এসভ্যতার অগ্রযাত্রার ধারাকে চলমান রাখছে। অথচ তাদের জীবনমান অন্ধকারে। আগামী ৪০-৫০বছর পর নির্মাণ শ্রমিকরা পেশা পরিবর্তন করে কোথায় যাবে? তারা আকাশসম সুউচ্চ প্রাসাদের অন্ধকার ছায়ালতে হারিয়ে যেতে পারে। নির্মাণ শিল্পে ব্যবহৃত পণ্য যেমন- রড, সিমেন্ট, টাইল্স, স্যানিটারী ও ইলেকট্রিকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নির্মাণ শ্রমিকের কথা কখনো ভাবেনি। সকল পণ্যের গুনগতমান অনেকটাই নির্ভর করে সঠিক সৎ ব্যবহারের উপর। সঠিক প্রয়োগ না হলে অনেক সময় ভালো পণ্যও বাজে বলে প্রমাণিত হয়। সমাজসেবার নামে স্কুল-কলেজ, খেলা-ধোলা, টিভি-রিয়্যালিটি শো তে টাকা খরচ করে নির্মাণ শ্রমিকরে প্রতি তাদের দায় এড়াতে পারেন না। যে খাত থেকে তারা হাজার হাজার কোটি টাকা বিজনেস করছেন সে খাতের শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও আহত-নিহতদের পাশে থাকা তাদের নৈতি দায়িত্ব।
আমরা শক্তের ভক্ত নরমরে জম।
স্বাধীনতা সবার আসলেও ৪৭ বছরেও সবার অধিকার নিশ্চিত হয়নি। একটি পরিবারে, একটি সমাজে, একটি রাষ্ট্রে, সকল মানুষের যেমন সমান অবদান থাকে না, তেমনি ছাওয়া পাওয়ার ক্ষেত্রে ও সবাই সমান সচেতন-সজাগ হয় না। তাই বলে কী রাষ্ট্র সকল নাগরিককে সমভাবে দেখবে না? একজন ভালো মা অবশ্যই তার ঘুমন্ত ক্ষুদার্থ সন্তানকে সময়মত জেগে-তুলে দুধ পান করবেন, এটা যেমন মায়ের দায়িত্ব। তেমনি রাষ্ট্র সকল নাগরিকের সম অধিকার নিশ্চিতের গেরান্টি দিবে ইহা একটি কল্যাণকামী রাষ্টের দায়িত্ব। নির্মাণ শিল্পিরা বিশ্ব সভ্যতার কারিগর। রাষ্ট্রের পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত, ঘুমন্ত, হতাশাগ্রস্থ ও অভিমানি সন্তান। তাদের দেখবালের দায়িত্ব রাষ্ট্রের ও সমাজের শিক্ষিত সচেতন মানুষগুলোর নেওয়া উচিত। কোটা প্রথা ও বিভিন্ন প্রানোদনার মাধ্যেমে রাষ্ট্র বিভিন্ন সময় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়নে অবদান রাখলেও নির্মাণ শ্রমিকের বেলায় নিরবাতর হেতু কী ?
বাংলাদেশের অর্থনীতি যে কয়টি ভিতের উপর দাড়িয়ে তার একটি রেমিটেন্স বা প্রাবস আয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধির পথে এগুচ্ছে এটা এখন এক বাস্তবতা। বিশ্বের ১৬২টি দেশে ছড়িয়ে চিটিয়ে থাকা ১ কোটির বেশি প্রাবাসি যার বেশির ভাগ নির্মাণ শ্রমিক। পরিবার পরিজন রেখে মরুরতপ্ত বালুতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খেয়ে না খেয়ে রেমিটেন্স পাটিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সবচাইতে বেশি অবদান রোখছে। বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক সেকেলে অর্থনীতির রং রূপ চেহারা পাল্টিয়ে দেয়ার নেপথ্য মূল কারিগর বিদেশে অবস্থানরত নির্মাণ শ্রমিক।
বাংলাদেশ মধ্যেম আয়ের কাতারে যাচ্ছে শুনতে খুব ভাল লাগে কিন্তু ভাবতে একটু ভয় লাগে। কারণ বাংলাদেশের ৫০ লক্ষ নির্মাণ শ্রমিক, প্রতি শ্রমিকের পরিবারে চারজন সদস্য হলে দু’কোটি মানুষের নির্মাণ শ্রমিক পরিবার। এদেরকে পেছনে পেলে যে অর্জন হবে সেটাকে পূর্ণাঙ্গ অর্জন বলা যাবে না। বড়জোর সেটাকে একটি ত্রুটিপূর্ণ বা বিকলাঙ্গ অর্জন বলা যাবে। আমার ভাবতে অভাক লাগে ১৬ কোট মানুষ আমরা রাতে যখন ঘুমোতে যাই তখন নির্মাণ শ্রমিকের কঙ্কালসার হাত দিয়ে বানানো বাড়িতেই সুখের ঘুম ঘুমাই। কিন্তু তাদের কথা কেউ ভাবি না। ১৬ কোটি মানুষের দেশে একটি সংবিধান আছে যেখানে নির্মাণ শ্রমিকের নাম গন্ধও নেই।
শ্রম-পরিদপ্তরের যে শ্রমিক নীতিমালা রয়েছে সেখানে পুরো বিধি-বিধানগুলো ‘শিল্প শ্রমিক’ নামে বিদিব্ধ। ‘শিল্প শ্রমিক’ বলতে এখানে কলকারখানা শ্রমিককে বুঝিয়েছে। তাহলে নির্মাণ শ্রমিকরা কি এ দেশের কেই নন?
নির্মাণ শ্রমিকের বানানো বাড়ির ছবি যিনি আকেন তাকে শিল্পী বলা হয়। অথচ সেই নির্মাণ শ্রমিককে শিল্পী না বলে মিস্ত্রী বলা হয়। অনেকে সুন্দর করে মিস্ত্রীও বলেন না, বরং মেস্তইর বা মেস্তুুরী বলেন, যাহা বেদনা ও হতাশার। নির্মাণ শ্রমিকরা দালান অট্টালিকা প্রাসাদ বানিয়ে দিন শেষে কুড়ে ঘরে ঘুমায়। কর্মস্থলে অহত শ্রমিকদের বিশেষায়িত চিকিৎসার নিশ্চয়তা মেলেনি। সমাজের সর্বক্ষেত্রে, অন্তত শিক্ষা ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত না হলে নির্মাণ শ্রমিকের মেধাবি সন্তানদের উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।
এত সব বেদনা ও অপ্রাপ্তির মূলে রয়েছে নির্মাণ শ্রমিকের অসচেনতা অনৈক্য ও বহুদাবিভক্ত ইউনিয়ন, ফেডারেশন, কনফেডারেশর ও জাতীয় নেত্রীত্ব। গার্মেন্স শ্রমিক, মটর শ্রমিক, সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও শক্তিশালী ইউনিয়ন ও শক্তিশালী নেত্রীত্ব থাকায় তারা বিভিন্ন সময় দাবি দাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, বা ভাল অবস্থানে রয়েছে। সে তুলনায় নির্মাণ শ্রমিকরা এখনও বহুদুর পিছিয়ে রয়েছে।
তাই রাষ্ট্র, সরকার, শ্রম পরিদপ্তর ও দেশের শিক্ষিত সচেতন জন গোষ্ঠির কাছে আবেদন থাকবে নির্মাণ শ্রমিকের সার্বিক বিষয় গুলো বিবেচনায় নিয়ে যুগ উপযোগী কর্ম পরিকল্পনার মাধ্যমে এই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠিকে দেশের উন্নয়নের মূল স্রোতের সাথে সম্পৃক্ত করা।
লেখক: মোঃ তাজুল ইসলাম
দপ্তর সম্পাদক
মৌলভীবাজার জেলা নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ ইউনিয়ন