হোসাইন আহমদঃ
সবার জন্য ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে ইসলামী ফাউন্ডেশনের অধিনে মৌলভীবাজারে মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম (৭ম পর্যায়ে) পরিচালিত হচ্ছে। পুরো জেলায় প্রতি মাসে শিক্ষকদের অর্ধকোটি টাকার উপরে বেতন দেয়া হয়। কিন্তু উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উদাসিনতা ও কেন্দ্রে নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকদের দায়িত্বহীনতায় ভেঁঙ্গে পড়েছে সরকারের এই মহতি উদ্যোগ। এদিকে শিক্ষক নিয়োগেও নীতিমালা অনুসরণ করেননি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। নীতিমালার বাহিরে গিয়ে একই পরিবারের বাবা, মেয়ে ও ছেলেকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রের অস্থিত নেই তার পরেও অনেকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। শিক্ষকদের সাথে যাতে করে কেউ যোগাযোগ করতে না পরে এজন্য ইচ্ছা করে অনেকে তালিকায় মোবাইল নম্বর ভুল দিয়েছেন। ১৫ দিনের অনুসন্ধানে এমন চিত্র ফুটে উঠেছে।
জানা যায়, শিশুদের সর্বোচ্চ ৬ বছর বয়স পর্যন্ত প্রাক-প্রাথমিক এবং ৬ বছরের উপরে সহজ কুরআন শিক্ষার আওতায় পড়ানোর কথা রয়েছে। প্রাক-প্রাথমিকে ৩০ এবং কুরআন শিক্ষায় ৩৫জন শিক্ষার্থী থাকার কথা রয়েছে
ইসলামি ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা যায়, ২০২২ শিক্ষা বর্ষে মৌলভীবাজারের ৭ উপজেলায় প্রাক-প্রাথমিকে ৪’শ ১২টি এবং কুরআন শিক্ষায় ৫’শ ৭৪টি কেন্দ্র এবং প্রতিটি কেন্দ্রের আওতায় ১জন শিক্ষক রয়েছেন। প্রত্যেক্ষ শিক্ষক মাসিক বেতন পান ৫ হাজার টাকা। বছরে ২টি ঈদ বোনাজও পান শিক্ষকরা। কেন্দ্রগুলো তদারকির জন্য প্রতি উপজেলায় ১জন সুপারভাইজার, ১জন মডেল কেয়ারটেকার ও ৩জন কেয়ারটেকার রয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অনেকের নামে কেন্দ্র বরাদ্দ থাকলেও পড়ানো হয়নি এক দিনও। কোথাও কোথাও কেন্দ্রের অস্থিতও পাওয়া যায়নি। আবার কেউ কেউ প্রবাসে গিয়ে কিংবা অন্যত্র চাকুরি করে নামকাওয়াস্তে অন্য শিক্ষক দিয়ে পড়াচ্ছেন। অনেক মহিলা শিক্ষকের অন্যত্র বিয়ে হওয়ার পরেও এখনও কেন্দ্র তাদের নামে রয়েছে। স্বামীর বাড়ি থেকে প্রতি মাসে বেতনও তুলছেন। মহিলা শিক্ষকদের অধিকাংশ কেন্দ্র খাতা কলমে। কিছু কেন্দ্রে মাঝে মধ্যে পাঠদান হলেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা হাতে গুণা। আবার অনেক শিক্ষক মসজিদ কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষর জাল করে প্রত্যয়ন পত্র দেখিয়ে কেন্দ্র চালু দেখাচ্ছেন।
সরেজমিন মৌলভীবাজার পৌরসভার সহজ কুরআন শিক্ষা কেন্দ্রে ২২ মার্চ গেলে দেখা যায়, সকাল ৬.৩০ মিনিট থেকে পড়ানোর কথা থাকলেও ৭.১৫ মিনিটে চুবড়া জামে মসজিদে শিক্ষককে পাওয়া যায়নি। ৫মিনিট পর শিক্ষক আব্দুল মুকিত আসেন। এসময় মাত্র ৬জন শিক্ষার্থী ছিল। কাঁজিরগাঁও জামে মসজিদ কেন্দ্র বন্ধ পাওয়া যায়। ৭.৪৪ মিনিটে সুলতানপুর হাবিবুন নেছা মসজিদে গেলে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের ছুটি দেয়া হয়েছে। কি কারণে নির্ধারিত সময়ের আগে ছুটি দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে শিক্ষক বলেন, জরুরি একটি কাজে বাহিরে যেতে হচ্ছে। আপনি ওই কেন্দ্রের নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষক কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষক মোঃ কুতুব উদ্দিন বাড়িতে থাকায় উনার বদলি হিসেবে আমি পড়াচ্ছি। হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা (রহঃ) দরগা জামে মসজিদ কেন্দ্রে গিয়ে শিক্ষক মোস্তাক আহমদকে পাওয়া যায়নি। উনার পরিবর্তে ফয়জুল করিম পড়াচ্ছেন। নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষক কোথায় জানতে চাইলে ফয়জুল করিম বলেন, কিছু দিন হয়েছে ওমান গেছেন। আবার চলে আসবেন। ৭.৫৪ মিনিটে জামিয়া আবু বকর মাদ্রাসায় গিয়ে শিক্ষক মোছাঃ ছানোয়ারা বেগমকে পাওয়া যায়নি। এসময় মাদ্রাসা শিক্ষক জয়নাল আবেদীন বলেন, এখানে কোনো মক্তব হয়নি। রহমানবাগ জামে মসজিদে গেলে দেখা যায় এজহার নামে একটি ছেলে পড়াচ্ছে। এজহার কেন পড়াচ্ছে জানতে চাইলে নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষক মোঃ সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ওকে এমনিতেই বসিয়ে রেখেছি। শিক্ষক মোঃ সিদ্দিকুর রহমান পার্শ্ববর্তী মেহেরজান বিবি রহমানিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপারেন্টেনের দায়িত্বে রয়েছেন। ২৩ মার্চ ৭.১৪ মিনিটে মধ্য ধড়কাপন জামে মসজিদে গেলে দেখা যায় এখনও মক্তব শুরু হয়নি। ২৭ মার্চ সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নের কালারবাজার জামে মসজিদে গিয়ে কেন্দ্র বন্ধ পাওয়া যায়। মসজিদের সামনে বসে থাকা সুনা মিয়া ও হোটেলের এক কর্মচারী বলেন, ৪/৫ দিন পর মাঝে মধ্যে মক্তব হয়। বিরাবইমাবাদ জামে মসজিদ বন্ধ পাওয়া যায়। শিক্ষককের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, জরুরি কাজে ২দিন হয়েছে বাড়িতে এসেছি। ছুটি নেয়া সম্ভব হয়নি। একটি সূত্র জানায়, মৌলভীবাজার পৌরসভার পশ্চিম ধরকাপন জামে মসজিদে মোঃ শাহীদুল হকের নামে একটি কেন্দ্র রয়েছে। তিনি এক দিনও পড়াননি। মসজিদের সাবেক ইমাম নুরুল হক গোপনে তার ভাইকে নিয়োগ দিয়েছেন। এনিয়ে কমিটির মধ্যে ঝামেলা হয়। অর্ধেক বেতনে মসজিদের বর্তমান ইমাম মইন উদ্দিন পড়াচ্ছেন। একদিন না পড়িও অর্ধেক বেতন নিচ্ছেন মোঃ শাহীদুল হক। মৌলভীবাজার পৌরসভার ধরকাপন সৈয়দ বাড়ীতে মোঃ সিরাজুল ইসলামের নামে একটি কেন্দ্র রয়েছে। তার ছেলে শামছুল ইসলাম তালুকদার ও মেয়ে বুশরা আক্তারের নামেও কেন্দ্র রয়েছে। পাঠদানের নির্ধারিত সময়ে বুশরা আক্তারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমি বাবার বাসায় এসেছি। কখন পড়ান জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুনেছি সপ্তাহে ২ দিন পড়ানো হয়। কোন ২দিন জানতে চাইলে তিনি বলতে পারেন না।
এদিকে রাজনগর উপজেলার মডেল কেয়ারটেকার বুরহান উদ্দিনের মেয়ে তামান্না ফেরদৌসির নামে ঐছতগঞ্জ সুরানন্দ মক্তব রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, তামান্না ফেরদৌসির বিয়ে হয়ে স্বামীর বাড়িতে থাকেন। তালিকায় দেয়া শিক্ষক তামান্না ফেরদৌসির নম্বরে যোগাযোগ করলে তার পিতা মডেল কেয়ারটেকার বুরহান উদ্দিন কল ধরেন। তিনি প্রথমে মেয়ের বিয়ের কথা স্বীকার করলেও পরবর্তীতে অস্বীকার করেন। কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল ইউনিয়নের মহলাল দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদ্রাসা কেন্দ্রে শিক্ষিকা সামিয়া আক্তার সাম্মিকে পাওয়া যায়নি। তালিকায় দেয়া তার নম্বরে যোগাযোগ করলে শিক্ষিকার বাবা জাহাঙ্গীর আলী জানান, সে ১ মাস যাবত আমার অপর মেয়ের বাসায় ঢাকায়।
কমলগঞ্জ উপজেলার বড়গাছ মক্তব (রেল গেইট) কেন্দ্রে বিকেল ২ ঘটিকা থেকে ৪:৩০ মিনিট পর্যন্ত পাঠদানের সময় থাকলেও ৩:৪৩ মিনিটে মক্তবে শিক্ষার্থী ও শিক্ষিকাকে না পেয়ে কেন্দ্রের শিক্ষিকা রোশনা আক্তারের সাথে যোগাযোগ হলে তিনি বলেন আমার পরিবর্তে অন্য শিক্ষক পড়ান। আরো জানা যায় রোশনার বোন রোনা বেগমের নামেও প্রাক প্রাথমিকের একটি কেন্দ্র রয়েছে। এমন নয় ছয়ের চিত্র পুরো জেলায়।
এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজারের উপ-পরিচালক মোঃ আনোয়ারুল কাদির বলেন, বিষয় গুলো অবগত ছিলাম না। আপনাদের মাধ্যমে অবগত হলাম। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব। কেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা মাসের পর মাস শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেননা। বন্ধ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এক পরিবারের বাবা, ছেলে ও মেয়ের নামে কেন্দ্র রয়েছে। এ সমস্থ অনিয়মের দায়বার কার? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুপারভাইজার, মডেল কেয়ারটেকার, কেয়ারটেকার ও শিক্ষকদের।