সরওয়ার আহমদঃ শুরু থেকেই মনুপকল্প একটি লোকসানী প্রকল্প হিসেবে গণ্যছিলো। আশির দশকের সূচনাতে প্রকল্পটি যখন চালু হয়- তখন ধারণা করা হয়েছিলো যে, গোটা প্রকল্প জুড়ে আউস, এমন এবং বোর ধান সমান তালে ফলবে। যার ফলশ্রুতিতে ধন ধান্যে ভরে উঠবে অধিভূক্ত এলাকা। কিন্তু প্রকল্পটি চালু হবার পর বাঁধ কাটা বন্যা এবং জলাবদ্ধতার প্রকোপ এমনভাবেই ডানা মেলেছিলো যে, এলাকার মানুষ প্রকল্পটিকে অভিশাপ হিসেবেই গণ্য করেছিলো। বন্যা যেমন তেমন- জলাবদ্ধতা প্রতিবছর এমনভাবে আস্তানা গেড়েছিলো যে, সাবেকী শাইল জমিতেও চাষাবাদের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছিলো না। এই কৃত্রিম জলাবদ্ধতার ক্ষেত্রে কাশিমপুর পাম্প হাউজের অক্ষমতা এবং হাওড়ের জল মহাল গ্রহীতাদের পরোক্ষ কূটচালকেই চিহ্নিত করা হয়েছিলো। সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষক মহলের বিক্ষোভ এবং বিভিন্ন সংগঠনের তৎপরতায় উর্দ্ধতন মহলের নজর পড়ে পাম্প হাউজের প্রতি। যার ফলে পুরাতন মেশিন অপসারণ করে গত ২০১৯ সনে নতুন মেশিন স্থাপন করার প্রেক্ষাপট পাল্টে যেতে শুরু করে প্রেক্ষাপট। পাম্প মেশিন সার্বক্ষণিক চালু থাকায় গত ২০১৯ সনেই মৌসুমী রোপা আমন চাষাবাদ বৃদ্ধি পেয়েছিলো। এবারের অবস্থা আরও ভিন্নতর। পানি সেচ অব্যাহত থাকায় জলাবদ্ধ জমির পরিমাণ কমতে থাকে। এমতাবস্থায় প্রকল্প এলাকার কৃষককূল নবোদ্যমে রোপা আমন চাষাবাদে এগিয়ে আসে। বলা যায় আষাঢ়ের শেষ থেকে ভাদ্র মাস পর্য্যন্ত চাষাবাদে অব্যাহত থাকায় দুই উপজেলা (মৌলভীবাজার সদরের ৩ ইউনিয়ন এবং রাজনগরের ৭টি ইউনিয়ন) ৭ হাজার হেক্টর অতিরিক্ত জমিতে রোপা আমন চাষাবাদ সম্পন্ন হয়েছে। যে জমিতে কোন কালেই রোপা আমন চাষাবাদ হতো না সে সমস্থ জমিতেও এবার নির্বিঘেœ চাষাবাদ সম্পন্ন হয়েছে। কৃষি বিভাগের ধারণা ৭ হাজার হেক্টর জমিতে অতিরিক্ত ৩৫ হাজার টন ধান উৎপাদন হবে। এলাকার চাষী যেমন তেমন গোটা সিলেট বিভাগের জন্য এটি একটি সুখবর। কিন্তু তার পেছনেও ষড়যন্ত্রের জাল বোনা শুরু হয়েছে। পাম্প হাউজের পানি নিষ্কাশন বন্ধরাখার জন্য একটি মহল মানব বন্ধন করেছে। এই খবরটিও ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। বাড়তি ৩৫ হাজার টন ধান উৎপাদন খবরটি যতটুকু প্রচারিত হয়েছে তার চাইতে পানি সেচ বন্ধ রাখার জন্য মানববন্ধনের খবরটি ত্রিগুণ মাত্রায় বেশী প্রচারিত হয়েছে। এখানেই “অবাক বাংলাদেশ” এর স্বরূপ উদঘাটন হতে পারে। নেতিবাচক এই সংবাদের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- কাশিমপুর পাম্প হাউজের পানি সেচ অব্যাহত থাকায় প্রকল্প এলাকার পানি স্তর নিচে রয়েছে। যার ফলে পাম্প হাউজের সিস্কব্যান্ড এবং ত্রিব্যান্ড গেট দিয়ে কচুরী পানা বেরিয়ে কুশিয়ারা নদীতে নিস্কাশিত হতে পারছেনা। এই কচুরী পানার বিস্তার নাকি ৫ হাজার হেক্টর জমি ব্যাপি। কচুরী পানার বিস্তার অব্যাহত থাকলে শুস্ক মৌসুমে ইরি বোর চাষাবাদ সম্ভব হবেনা- উল্লেখিত পরিমান জমিতে। এখানে প্রাসঙ্গিক যে, কৃষি বিভাগ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাতে একটি যৌথ জরীপ আছে। সেই জরীপ অনুসারে গোটা প্রকল্প এলাকার জলমগ্ন এবং চাষযোগ্য জমির পরিমান হচ্ছে- ১২ হাজার হেক্টর। তন্মধ্যে এবার ধান চাষাবাদ হয়েছে ৭ হাজার হেক্টর জমিতে। আর পতিত অবস্থায় আছে স্থান ভেদে পাঁচ হাজার হেক্টর জমি। এবার কচুরী পানার বিস্তার শক্তি কি এতোই প্রবল হয়ে উঠেছে যে, পাঁচ হাজার হেক্টর জমিকে গ্রাস করে ফেলেছে? অবস্থা যদি তাই হতো- তাহলে হাওর এবং হাওর কিনারের মাঠ ও গ্রামগুলোতে কেবল কচুরী পানার জঙ্গলই দেখা যেতো। বাস্তবে কি তাই? “চক্ষুমেলিয়া” দেখলে পরিলক্ষিত হবে- প্রকল্প এলাকার বিস্তীর্ণ মাঠ সমূহে এবার উঠতি রোপা আমনের ঢেউ খেলানো অবয়ব। যারা পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে শুরু কচুরী পানার বিস্তার দেখছেন, তারা কি সরজমিনে উপস্থিত হয়ে ফিতা ফেলে মাপ দিয়েছেন? জোঁক মাপ দিলে অবাস্তবতার ফাঁনুসই শুধু পরিলক্ষিত হবে। এই অবস্থায় এতো দাপা দাপির নেপথ্যে কারণ নিহিত আছে অবশ্যই। হাওড়ে পানি বেশী থাকলে সেই পানি হাওর ডিঙ্গিয়ে গ্রাম গ্রামান্তরের মাঠকে প্লাবিত করে। এই প্লাবন ভূমি মৎস্য চাষাবাদ ও প্রজননের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে উঠে। যা এবার সম্ভব হয়নি। হাওড়ের জলমহাল গ্রহীতাদের জন্য বিষয়টি বিষ ফোঁড়ার মত। তাই নেপথ্যে থেকে বর্দ্ধিত ধান চাষাবাদের বিপরীতে কচুরী পানাকে টেনে আনা হয়েছে। এই সরল বিষয়টি আহাম্মকও সমজে নিতে পারে। সাংবাদিক হিসেবে বিষয়টি নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি জানান- কুশিয়ারার ¯্রােত সব সময়ই আপইয়ার্ডে রয়েছে। ¯্রােত নামলে প্রকল্প এলাকার পানি ফুলিয়ে কচুরীপানা নদীতে ফেলে দেয়া হবে। সে সময় এখনও আসেনি। তাহলে আগাম এই হৈ চৈ এর রহস্য কি? উদ্বৃত্ত চাষাবাদ এবং বাড়তি ধান উৎপাদন কি মহল বিশেষের নাকে বিষ ফোঁড়া হয়ে উঠেছে?