৩য় পর্ব
সরওয়ার আহমদ: মূলত: সেই সময়ে ক্ষমতার অঙ্গণে জিয়াউর রহমানের আর্বিভাব ঘটেছিলো দাহ্যপদার্থ ধারী ম্যাজেশিয়ানের মতো। ধূমায়িত প্রান্তরে আগুনের ফুলকি সৃষ্টি করে বাজিমাৎ করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু সে অগ্নি হুল্কায় নিজেকে ছাঁই ভষ্ম হতে হবে, তাহা জেনেও আগুনের খেলায় মগ্ন হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
এখন আসা যাক, খন্দকার মোস্তাক আহমদ সহ অন্যান্যদের প্রসঙ্গেঁ। ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের ক্ষেত্রে খন্দকার মোস্তাক গংরা অন্যতম কুশীলব হলেও ঘটনার নাটকীয়তার তারা খলনায়কে পরিণত হয়েছিলেন। সিধেঁল চুরির ক্ষেত্রে চোরচক্র গৃহে ঢোকার জন্য গর্ত খোড়ার পর মানুষের মাথা সদৃশ একটি কালো পাতিলকে ডান্ডার আগায় বসিয়ে গর্তে ঢোকার ট্রায়াল সম্পন্ন করে। গৃহস্থ পক্ষের লোক যদি সজাগ থাকে তাহলে মাথা সদৃশ কালো পাতিলেই আঘাত করে। যদি আঘাত না আনে তাহলে ঘরে ঢুকে উদ্দেশ্য হাসিলের প্রাথমিক গ্যারান্টি নিশ্চিত হয়। খন্দকার মোস্তাক গংরা সেই কালো পাতিল হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছিলেন। সপরিবারে বঙ্গঁবন্ধু হত্যার পর দেশময় যে অবাক বিস্ময় অনুভতি বিরাজ করছিলো সেই অনুভতির পাশাপাশি আওয়ামীলীগ ঘরানাকে বিভ্রান্তি ও ধাঁধাঁয় ফেলার লক্ষ্যে বঙ্গঁবন্ধু সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রীকে রাষ্ট্রপ্রতি এবং বঙ্গঁবন্ধুর মন্ত্রী সভায় তিন জাতীয় নেতা ব্যতিরেকে অপর সব মন্ত্রীকে মন্ত্রীপরিষদে টেনেআনা হয়েছিলো। যার ফলশ্র“তিতে আওয়ামীলীগ , শ্রমিকলীগ, ছাত্রলীগ, সহ অন্যান্য অঙ্গঁ সংঘটনের নেতাকর্মীরা তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাপিয়ে গড়তে পারে নি। ১৫ আগস্টের পরিকল্পনাবিদদের এটি ছিলো একটি সফল ও কার্যকর কৌশল। এই কৌশল বাস্তবায়িত হবার পর খন্দকার মোস্তাক তার মন্ত্রীবর্গ সহ উপদেষ্টার প্রয়োজনীয়তা ফুড়িয়ে গিয়েছিলো বলেই তারা আস্তা কুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। তবে মন্ত্রীপরিষদের সবাই যে ১৫ আগস্টের ফলভোগী ছিলেন , তা নয়। অনেকেই এসে শপথ নিয়েছিলেন তোপের মুখে এবং আত্মরক্ষার্থে। ব্যতিক্রম ছিলেন জেনারেল ওসমানী। জানুয়ারীতে বঙ্গঁবন্ধু কতৃক বাকশাল সিষ্টেম প্রবর্তনকালে ওসমানী ও ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেন নতুন এই সিস্টেমের বিরোধীতা করে জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। এ কারণে তিনি বাকশাল মন্ত্রীসভার ও সদস্য ছিলেন না। ওসমানী ১৫ আগস্টের মন্ত্রীসভার শপথের পর ২৪ আগস্ট তারিখে শপথ নিয়ে খন্দকার মোস্তাক আহমদের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হয়েছিলেন। কথিত আছে, ৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক থাকাকালে ওসমানী সাহেব মোশতাকের ছায়া মাড়াতে চাইতেন না, তার দূরভিসন্ধির কারণে। সেই ওসমানী সাহেব ৭৫ সনে মোস্তাক আহমদের সুহুদ হয়ে উঠেছিলেন। মোস্তাকের উপদেষ্টা হিসেবে জেনারেল ওসমানীর যোগদান প্রকারন্তরে ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের প্রতি সমর্থন সূচক কী নয়?
নভেম্বর অভ্যুত্থান কালে ৪ নভেম্বর মধ্য রাতে খন্দকার মোস্তাক আহমদের পতন মুহূর্তে এবং ক্যাবিনেট মিটিং শেষে বেরিয়ে আসার সময় জেনারেল ওসমানী বঙ্গভবনে মোস্তাকের সাথে কোলাকুলির সময় বলেছিলেন-.ংড়ৎৎু ড়ষফসধহ, বি যধাব ঢ়ষধুবফ ধ নধফ মধসব. খবঃ ঁং ভড়ৎমবঃ ধহফ ভড়ৎমরাব. (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা পৃষ্টা নং, ১১৩) এই উক্তিতেই কি বুঝা যায় না যে, ১৫ আগস্ট থেকে ক্ষমতার যে খেলা শুরু হয়েছিলো সেই খেলাতে জেনারেল ওসমানীও একজন খেলোয়াড় ছিলেন? বঙ্গঁবন্ধু হত্যা মামলার ৩৭ নং সাক্ষী ও বেতার প্রকোশলৗ রেজাহুল হকের সাক্ষী অনুযায়ী জানা যায়, ১৫ আগস্ট সকাল ৯ ঘটিকায় রেডিও স্টেশনের ২ নং ষ্টুডিওতে অন্যান্যদের সাথে জেনারেল ওসমানীকেও তিনি দেখতে পান। তখন ক্ষমতা ফলাওয়ের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছিলো রেডিও স্টেশন। এখানে আরেকটি ক্ষুদ্র তথ্যের সংযোজন প্রয়োজন। ১৫ আগস্ট সকালে বঙ্গঁবন্ধু মারা যাওয়ার সংবাদ অবহিত হবার পর ঢাকাস্থ এস.পি.হোস্টেলে অবস্থানরত মেজর জেনারেল অব: আব্দুর রব ( মুক্তিযুদ্ধকালীন চীফ অব স্টাফ ) হাউ মাউ করে মরা কান্নায় ভেঁঙ্গে পড়েছিলেন। এসময় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কমান্ডেড মানিক চৌধুরী এমপিও সংসদ হোস্টেলে অবস্থান করেছিলেন। মানিক চৌধুরীর ভাষ্যমতে- অবাঞ্চিত এ সংবাদে তারা কিংকর্তব্যবিমোঢ় হয়ে পড়েছিলেন। এক পর্যায়ে সকাল ১১ টার দিকে একটি বেবী ট্যাক্সী ভাড়া করে ঘোরপথে তারা উপস্থিত হয়েছিলেন জেনারেল ওসমানীর বাসভবনে। পূর্ব পরিচিতির সূত্রধরে বাসার গার্ড মেজর জেনারেল আব্দুর রব ও কমান্ডেট মানিক চৌধুরীকে বাসায় ঢুকতে বাধা প্রদান করেনি। বাসায় ঢুকেই তারা শুনতে পেরেছিলেন ওসমানী উচ্চকন্ঠে নূর, নূর উচ্চারণ করে টেলিফোনে কথা বলছিলেন। ১৫ আগস্টের ঘাতক মেজর নূর মুক্তিযুদ্ধকালে ওসমানীর এ.ডি.সি ছিলো। এবং উভয়েই সিলেট জেলার বাসিন্দা ছিলেন। মানিক চৌধুরী এবং এম.এ. রবকে দেখে ওসমানী টেলিফোন রেখে দিয়ে তাদের সাথে বোল পাল্টিয়ে ছিলেন। মেজর জেনারেল এম.এ.রব এবং কমান্ডেট মানিক চৌধুরী এখন লোকান্তরে। সেদিন ওসমানীর বাসা থেকে বেরিয়ে মানিক চৌধুরী বলেছিলেন- ডাল মে কুচ কালা হে।
১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার ব্যাপারে পরবর্তীতে ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট সেনাকর্মকর্ত্তাদের মধ্যে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য এবং রটনা মিলিয়ে ঘটনা সম্পর্কিত ধূমজাল সৃষ্টি করা হয়েছিলো। সে ধূম্রজালের বেষ্টনী এখনও ছিন্ন হয়নি। একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনপূর্বক যথাযথ তদন্ত সম্পন্ন হলে অস্পষ্টতা কেটে যাবার পাশাপাশি যোগসাজসের প্রসঙ্গটিও খোলাসা হয়ে যেতো। বেরিয়ে আসতো খোলনলচের অনেক উপাদান। তবে অস্পষ্টতার মধ্যে ও ধরে নেয়া যায় যে, নেপথ্যে যোগসাজসের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ এবং কার্যকর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলো ৪৬ ব্রিগেডের ২ টি ইউনিটের প্রধান মেজর ফারুক ও মেজর রশীদ। সম্পর্কে দুজন ভায়রা ভাই এবং একই লক্ষ্যাভিশারী। তারমধ্যে ফারুকের ক্ষোভ ছিলো ২ বছরের সিনিওরিটি নিয়ে। এ ক্ষোভের জন্যতো রাষ্ট্রপ্রতি সরাসরি দায়ী হতে পারেন না। অন্যজন মেজর খন্দকার আব্দুর রশীদ। বিদ্রোহী হবার জন্য দৃশ্যমান কোন ক্ষুব্ধতা ছিলো না তার । খন্দকার মোস্তাকের আত্মীয় বিধায় এখানে যোগসাজসের প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে বিয়োগান্তক এ ঘটনার ক্ষেত্রে যোগসূত্রতার সুতার টান ছিলো বহুদিক থেকে। ১৫ আগস্টে বঙ্গঁভবনে মন্ত্রীপরিষদের শপথ অনুষ্টানে মেজর রশীদের সাথে তার স্ত্রী জুবাইদা রশীদ ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল। মেজর রশীদ তার স্ত্রীকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে বলেছিলেন- আমাদের এই ঐতিহাসিক অভিযানে জুবাইদার অনেক অবদান আছে। কি অবদান বা ভূমিকা ছিলো সেটি এখনও অনুদঘাটিত। রশীদের স্ত্রী জুবাইদা এবং ফারুকের স্ত্রী ফরিদা রহমান দুই বোন। পারিবারিকভাবে তারা চট্রগ্রামের এ.কে.খান পরিবারভুক্ত। এ.কে খানের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ছিলো মুসলীম লীগের। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর গোটা দেশের মুসলীম লীগ পরিবার এবং সমর্থক মহল ইমেজ সঙ্খটের পাশাপাশি নানামুখী সঙ্খটের সম্মুখীন হয়েছিলো। মূলত: তারা বাংলাদেশ চায়নি এবং স্বাধীনতা বিরোধী বলে খ্যাত। হানাদার বাহিনীর সাথে ছিলো তাদের যোগসাজস। একারণে মুসলিম লীগ পরিবার এবং সমর্থকরা বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিব, আওয়ামীলীগ এবং নৌকা প্রতীককে চিরশত্র“ বলে মনে করে। বেদুইন উত্তরাধিকারের মতো বংশ পরম্পরায় এ শত্র“ভাবাপন্নতা আছে এবং থাকবে। এই উপসর্গের ব্যতিক্রম হবেন কেনো জুবাইদা রশীদ এবং ফরিদা রহমান? স্বামীর মানসিকতায় স্ত্রীর প্রভাব রেখাপাত করে আসছে যুগে যুগে। এমতাবস্থায় দুই স্ত্রী তাদের স্বামীকে বঙ্গঁবন্ধু এবং আওয়ামীলীগ বিদ্বেষী করে তুলতে পেরেছিলেন নি:সন্দেহে। এমনকি অভ্যুত্থান সংগঠিত করতেও প্ররোচিত করেছিলেন বৈকি। বিদেশী সাংবাদিকের সূত্রমতে, ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান সংগটিত হবার আগে দু বোনের মধ্যে একজন চট্রগ্রামের বিহারী আন্ধা হাফিজের নিকট ছুটে গিয়েছিলেন “বর” চাওয়ার জন্য। আন্ধা হাফিয তার দিব্য চোখে সপরিবারে বঙ্গঁবন্ধু হত্যা এবং ক্ষমতার পট পরিবর্তন দেখে না কি গ্রীণ সিগন্যাল দিয়েছিলেন। কিন্তু আন্ধা তো বর্তমানে আন্ধা, ভবিষৎতেও আন্ধা বলে গণ্য। তিনি সরকার উৎখাত এবং সপরিবারে বঙ্গঁবন্ধ হত্যার দৃশ্যপট আগে ভাগেই দেখেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে ফাসির রশিতে ফারুকের লটকানো দৃশ্য এবং রশীদের দেশান্তরী হবার ছবি কী তার নজরে আসে নি? মূলত: ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে।
মেজর সৈয়দ ফারুকুর রহমান এবং মেজর খন্দকার আব্দুর রশীদের খুঁটির জোর যে শক্ত ছিলো তাহা অস্বীকারের কারণ নেই। ১৫ আগস্ট ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত উশৃঙ্খল মেজর চক্রের মধ্যে উল্লেখিত এই দুই মেজরের সরাসরি যোগাযোগ ছিলো ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সাথে। এজন্য তারা ছিলো বেপরোয়া। নভেম্বরের পাল্টা অভ্যুত্থানে আগস্ট অভ্যুত্থানের নায়করা দেশত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকুরী নিয়েছিলো। কিন্তু ফারুক রশীদরা চাকুরী নেয় নি। নেয়ায় বোধ হয় প্রয়োজনও ছিলো না। তাদের বর্তে থাকার গ্যারান্টিতো আগেই নিশ্চিত হয়েছিলো। বরং বিদেশ থেকে দেশে এসে তারা পুন:অভ্যুত্থানের চেষ্টায় লিপ্ত ছিলো। জিয়া তাদের কেশার্গ স্পর্শ করতে পারেন নি মুরব্বী বেজার হবার আশংকায়। অথচ অভ্যুত্থানের গন্ধ পেলে জিয়া কতটুকু প্রতিশোধ পরায়ণ হতে পারেন, তার নজির বার বার রেখে গেছেন। খুঁটির জোর শক্ত থাকায় পরবর্তীতে রাষ্ট্রপ্রতি নির্বাচনে ফারুক এরশাদের সাথে প্রতিদ্বন্দিতায় নামতেও ভ্রূক্ষেপ করেন নি। কিন্তু ন্যায় দন্ডের রশি তাকে ছাড় দেয় নি, এটাই ইতিহাসের নির্ভেজাল শিক্ষা।
এখন আসা যাক ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর ঘাতকচক্রের উদ্দেশ্য বাস্তবান প্রসঙ্গে। ১৯৭৬ সনের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে বৃটিশ সাংবাধিক এ্যান্থনী মাস্কারেন হেসের নিকট লন্ডন টেলিভিশনের জন্য প্রদত্ত সাক্ষাৎকার এবং ১৯৮৩ সনে প্রদত্ত স্যাটারডে পোস্টে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে ফারুক ও রশীদ স্বীকার করেছে, যে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে ৭৫ সনের বিয়োগান্তক পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিলো তা পূরণ হয়নি। যেমন খন্দকার মোস্তাক তেমন জেনারেল জিয়া তাদের প্রদত্ত প্রতিশ্র“তি রাখে নি। জিয়া কে তারা ক্ষমতা লিপ্সু, শট এবং ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ১৫ আগস্ট এবং ৭ নভেম্বরের পটপরিবর্তনে লাভ হয়েছে উর্দ্ধতন সামরিক অফিসার চিহ্নিত আমলা এবং উচ্ছিষ্টভোগী রাজনীতিকদের। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সুতার টানে পরিচালিত বিভ্রান্ত ঘাতকদের উল্লেখিত মূল্যায়ণকে বিল¤িত বোধোদয় এবং পাপানুভুতির নির্জলা বহি:প্রকাশ বলে গণ্য করা চলে। ১৫ আগস্টের উদ্ভুত পরিস্থিতিতে উর্দ্ধংতন সামরিক অফিসার এবং উচ্ছিষ্ঠ ভোগী একশ্রেণীর রাজনৈতিক মহল প্রেক্ষাপটকে ভিন্নখ্যাতে ধাবিত করার লক্ষ্যে আওয়াজ তুলেছিলে- যা হবার তা হয়ে গেছে, এখন দেশটাকে বাঁচান। তাদের এ বুলিতে ফলও ধরেছিলো। দেশ বাচাতে গিয়ে গোটাদেশকে স্বর্গে পাঠানো হয়েছিলো না কি রসাতলে টেনে নেওয়া হয়েছিলো সেটি পরবর্তীকালীন বাস্তবতাই বলে দেবে।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সন পযর্ন্ত প্রায় দুই যুগের পরিক্রমায় দেশবাসী নিরন্তর আন্দোলন সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে যেটুকু অর্জন করেছিলো, সেই অর্জনের গৌরবান্বিত স্তম্ব গুলোকে গুড়িয়ে ফেলা হলো ১৫ আগস্টের উল্টো রথের চাকার নীচে। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সংগ্রাম করে বাঙ্গাঁলী জাতি স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথে যাত্রা শুরু করেছিলো অপ্রতিরোধ্য প্রত্যয় নিয়ে। কিন্তু তার ফল দাড়ালো কি? অকার্যকর রাষ্ট্র পাকিস্তানে যেখানে সামরিক শাসনের জগদ্দল পাথর চেপে বসেছিলো স্বাধীনতা প্রাপ্তির দশ বছর পর, সেখানে রক্তাক্ত সংগ্রাম শেষে স্বাধীনতা প্রাপ্তির সাড়ে তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশে সামরিক শাসনের বৈজয়ন্তী উড়লো তার আপন মহিমা নিয়ে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির দশ বছরের মাথায় দুই বার সামরিক শাসনের ঘোষণা জানান দিয়েছিলো তোমরা দেশবাসী অযোগ্য। গণতন্ত্র নয় “গানতন্ত্রই” হচ্ছে ক্ষমতার উপজীব্য হাতিয়ার। জনগণতান্ত্রিক সিস্টেমের পরিবর্তে মার্শাল ডেমোক্রেসীই হচ্ছে মূল ট্যাবলেট। জননেতার পরিবর্তে এখানে জেনারেলরাই হচ্ছেন খাটি দেশ প্রেমিক। তাদের বন্দনা কীর্ত্তণের জন্য ভাগাড় থেকে উঠে আসা তথাকথিত নেতাপাতিদের পঞ্চমুখ এবং উদ্বাহু জিন্দাবাদে নরকগুলজার হয়ে উঠলো। ১৫ আগস্ট সকালে মতিঝিলের নিকট এক দল কালো উদ্দিপরা লোক আবেগের আতিশর্য্যে শ্লোগান দিয়েছিলো- পাকিস্তান জিন্দাবাদ। দেশব্যাপী তখন অব্যক্ত শোক এবং বিস্ময়ের অন:শীল ধারা প্রবাহমান থাকলেও পাকিস্তান পন্থীদের ছিলো পোয়াবারো অবস্থা। রেডিওতে তখন পরিত্যক্ত “জিন্দাবাদ” এবং পাকিস্তানী ধারার হামদ ও নাথ পরিবেশন শুরু হয়ে গেছে। জিওয়ন স্পর্শে মাটি চাপা পড়া পাকিস্তানী ভাবধারা নতুন উদ্যমে মাথাচাড়া দিয়ে জানান দিলো লব্ধ এ স্বাধীনতা ছিলো মেকী। এখন আসল স্বাধীনতা ফিরে এসেছে। স্বাধীনতা বিরোধীরা মৃত জিন্নাহর পরিবার্ত জীবিত জিয়াকে তাদের আসল নেতা হিসেবে মাথায় তুলে নিয়েছিলো। সড়হবু রং হড় ঢ়ৎড়নষবস ফর্মুলার বলে রাজনীতি হয়ে উঠলো বেচাকেনার পণ্য। বিসমিল্লাহ পরিণত হলো শ্লোগানে। অতীতে ধর্মকে বর্ম হিসেবে ধারণ করে যারা রাজনৈতিক চাষাবাদকে পেশা হিসেবে গণ্য করেছিলো, সেই পরিত্যক্ত শক্তি ফের মাঠে নামলো দাপট নিয়ে। প্রগতির ধারা নুয়ে পড়লো প্রতিক্রিয়ার নখর থাকায়। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিক্ষেপ করা হলো অবহেলার নিগড়ে। তার বীপরীতে যুদ্ধাপরাধীরা কল্কী পেয়ে হলো আসল মানুষ। অর্থনীতিতে আর্বিভূত হলো লুটেরা লুস্কেনরা। স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি পরিণত হলো সেবা দাসগিরিতে। আরো বহুমাত্রিক উপসর্গ মাথাচাড়া দিয়ে জাতি সত্ত্বাকে করে তুলেছিলো ঘুণেআক্রান্ত। বঙ্গঁবন্ধু হত্যার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির চান্সেলর উইলীব্রান্ট বলেছিলেন- শেখ মুজিব হত্যার পর বাঙ্গাঁলী জাতিকে আর বিশ্বাস করা যায় না। উক্তিটির তাৎপর্য মারাত্মক। তার এই উক্তিটি সামাজিক এবং রাজনৈতিক ভাবে যেভাবে প্রযোজ্য, তেমনি সামরিক ক্ষেত্রে ও প্রয়োগযোগ্য। ১৫ আগস্টের পর থেকেই সামরিক বাহিনীতে অবিশ্বাসের বিষ বাষ্প পুঞ্জিভূত হতে থাকে। এই অবিশ্বাসের সাথে যুক্ত হয়েছিলো অভিলাষ। খন্দকার মোস্তাক আহমদ ও জেনারেল ওসমানী জিয়া এবং খালেদ মোশারফকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না বলেই মেজর জেনারেল খলিলকে চীফ অব ডিফেন্স স্টাফ নিয়োগ করে ছিলেন। জিয়াও ছিলেন মোস্তাক এবং ওসমানীর প্রতি সন্দেহপ্রবণ। খালেদ মোশারফ যেমনি জিয়াকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তদ্রুপ জিয়া ও তাকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। এজন্যই খালেদ মোশারফকে জিয়ার অনুচরদের হাতে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের খেলা চরম খেলা জমে উঠেছিলো জিয়া এবং তাহেরের মধ্যে। তাহের জিয়াকে ষোলআনা বিশ্বাস করেছিলেন। আর জিয়ার নির্দেশেই তাহেরকে ফাসি কাষ্টে ঝুলতে হয়েছিলো।
অন্যদিকে কয়েকজন মেজর ক্যাপ্টেন মিলে ক্ষমতার পটপরিবর্তন ঘটানো সম্ভব— ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের এই ধারণা সেনাবহিনীর মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলার বীজ বুনেছিলো। তাই ৭৫ সনের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৮১ সন পযর্ন্ত ঢাকা, বগুড়া, সাভার, চট্রগ্রাম, রংপুর, কুমিল্লা, যশোর ও দয়ারামপুর সেনাবাহিনীতে ১৮ টি অভ্যুত্থান সংগটিত হয়েছিলো। এসমস্ত অভ্যুত্থানে কি পরিমাণ সৈন্য এবং অফিসার নিহত হয়েছিলো সে হিসাব মিলেনি। অভ্যুত্থানকারীদের খেসারত দিতে হয়েছে ফায়ারিং ,স্কোয়াডে এবং ফাঁসির কাষ্টে। এসময় বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদেরকে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশোধ গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চক্রের ইশারায় কি তবে মুক্তিযোদ্ধা নিধনের এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিলো? মূলত: ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তন বাঙ্গাঁলীর ঐতিহ্য এবং অহংকারের স্মারক, মুক্তিযুদ্ধ, বাঙ্গালীজাতীয়তাবাদ, মুক্তচিন্তা, কৃষ্টি, সংস্কৃতিসহ জাতীয় অগ্রগতির প্রতিটি সোপানকে বিপন্ন করার লক্ষ্যে নিয়ে আর্বিভূত হয়েছিলো। এ ক্ষেত্রে তার কেন্দ্রস্থলকে গুড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যেই নারকীয় আঘাত হানা হয়েছিলো। আঘাতকারী মানবরূপী দানবদের মুখোমুখি বঙ্গঁবন্ধুর অন্তিম অবস্থান এবং সাহসী উচ্চারণ“ তোয়া কি চাস” নি:সন্দেহে হেনরিক ইবসেনের এই আপ্তবাক্যটুকুকে জানান দিয়েছিলো- ঞযব ংঃৎড়হমবংঃসধহ রহ ঃযব ড়িৎষফ রং ঃযরং সধহ, যিড় ংঃহধফং সড়ংঃ ধষড়হব. বিশ্বের অজস্ত্র কোটি মানুষের মধ্যে হাতে গোনা যে কজন শক্তিধর ও সাহসী মানুষের আর্বিভাব ঘটেছে, তাদের মধ্যে আছে একজনত বাংলা ও বাঙ্গাঁলীর শেখ মুজিব। চলবে…
১৫ আগস্টের পট পরিবর্তন: প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগসাজস
