তানভীর তাওসীফ
বর্তমান সময়ের অনেক তরুণের কাছে ইউরোপে প্রবেশ যেন জীবনের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেকোনো উপায়ে ইউরোপ পৌছার জন্য দালালের খপ্পড়ে পড়ে অনেক তাজা প্রাণ ঝরেছে অকালে। ইউরোপ প্রবেশের সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ রাস্তা লিবিয়ার সর্ব পশ্চিম উপকূল থেকে ইতালির লাম্পেদুসা দ্বীপ। এই সমুদ্র পথের দূরত্ব প্রায় ৩০০ মাইল।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান বিষয়ক পরিদপ্তর ইউরোস্ট্যাটের তথ্যমতে, ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত যেসব দেশের নাগরিকেরা সবচেয়ে বেশী আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম ১০ টি দেশের মধ্যে। আমার এই প্রবন্ধটি তাদের উদ্দেশ্যে, যারা ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ইউরোপে আসার। হোক সেটা রাজনৈতিক নিপীড়ন থেকে বাচতে, অথবা উপার্জনের উদ্দেশ্যে। যারা এ পথে পা বাড়াতে চান, তারা যেন সুস্পষ্ট ধারণা নিয়ে আসতে পারেন এ উদ্দেশ্যে আমার এই লেখা। নিম্বে ইউরোপে প্রবেশের পথসমূহ এবং কি উপায়ে প্রবেশে কী পরিণতি হতে পারে তা সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
অবৈধ উপায়:
১) লিবিয়া -ইতালী সমুদ্র পথঃ এই পথে পা বাড়ানো মানেই নিজেকে অজানা মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া। লিবিয়ার বন্দরে দালালরা আপনাকে গরু ছাগলের মতো বেচাকেনা করবে। সাগরে ডুবে মরার সম্ভাবনা প্রায় ৬০-৭০ ভাগ। সম্প্রতি ইতালি একটি আইন পাশ করেছে যাতে বলা হয়েছে ‘কেউ যদি সাগর থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের উদ্ধার করে তাহলে ৫ হাজার ইউরো জরিমানা ও ৩ মাসের জেল হতে পারে।
২) মিডলইস্ট থেকে কফিলের সাথেঃ পথটা নিরাপদ হলেও অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়। কফিলকে কয়েক দফা সম্মানী দিয়েও কাজ আদায় হয় না।
৩) তৃতীয় কোন দেশ হয়ে ইউরোপে প্রবেশঃ অনেকেই আলজেরিয়া-মরক্কো হয়ে স্পেনে প্রবেশ করছেন। কেউ কেউ রাশিয়া-ইউক্রেন -রোমানিয়া হয়ে জার্মানিতে প্রবেশ করছেন। এ পথে আপনাকে দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে হতে পারে। কোন দেশের সীমানায় আঙুলের ছাপ রেখে দিলে তো আপনার বাকী জীবন টানা হেচড়ার মধ্য দিয়েই যাবে।
৪) ভিজিট ভিসাঃ বেড়াতে এসেছেন, সসম্মানে দেশে ফেরত যান। অন্যচিন্তা করেছেন তো মরেছেন।
উপরিউক্ত ৪ টি পথে প্রবেশের ফলাফল প্রায় একই। যদি আপনি ইউরোপে প্রবেশের পর আশ্রয় প্রার্থনা করেন তাহলে আপনার জন্য অবশ্যই জানা থাকা উচিৎ ; যদি ইউরোপে প্রবেশের পথে কোন দেশ আপনার আঙুলের ছাপ রেখে দেয়, তাহলে আপনি ডাবলিন প্রসেসের আওতায় পড়ে যাবেন।
আপনি অন্য যেকোনো ভিসা নিয়েই হোক, আর অবৈধভাবেই হোক, ইউরোপের যে দেশে প্রথম প্রবেশ করবেন ঐ দেশই আপনার আশ্রয় আবেদন বিবেচনা করবে। এটাও ডাবলিন প্রসেস। এ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখতে অনেক লম্বা আলোচনা প্রয়োজন। আপনারা গুগল থেকে ডাবলিন প্রসেস সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন। ডাবলিন প্রসেসের আওতাভুক্ত হলে আপনি যে দেশেই আশ্রয় আবেদন করেন না কেন, আপনাকে আপনার প্রথম প্রবেশের দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এই প্রসেসের শেষ পরিণতি ডিটেনশন সেন্টারে বন্দি, দেশে ফেরত পাঠানো। কোন কোন দেশ জোর করে ধরে দেশে পাঠিয়ে দেয়। অতি ভাগ্যবান ৫-৭ ভাগ লোকের আবেদন গৃহীত হয়েছে। আপনারই দেশ ত্যাগের নোটিশ দেয়ার পরেও যদি আপনি থেকে যান, তাহলে জীবনে অনেক ঝড় তুফান নেমে আসবে। বৈধ হতে ১০/১২ বছর লেগে যেতে পারে। কোন কোন দেশে তো বৈধ হওয়ার আর কোন উপায়ই খোলা থাকেনা।
বৈধ পথসমূহ:
১) ওয়ার্ক পারমিট ভিসা/ স্টুডেন্ট ভিসাঃ এই দুই ভিসায় যারা আসেন তারা খুব দ্রুত ইউরোপে স্থায়ী হতে পারেন৷ কিন্তু দালালদের খপ্পরে পড়ে ভিসার আশায় লাখ লাখ টাকা খুইয়েছেন অনেকেই। স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে আসা ৮০% ছাত্ররাই তাদের ছাত্রত্ব চলমান রাখে না। যারা ধৈর্যের সাথে লেখাপড়া শেষ করতে পারে তারাই সফল হয়। কিন্তু উচ্চ টিউশন ফি এবং লিভিং কস্ট সামলানোর সামর্থ্য না থাকলে রাস্তা মাপুন।
২) ফ্যামিলি ভিসাঃ ছেলেদের জন্য এ ভিসার কোন সুযোগ নাই বললেই চলে। মেয়েদের ক্ষেত্রে স্বামী বিদেশ থাকলে স্ত্রীর জন্য ইউরোপ আসা সহজ। কিন্তু স্বামীকে তার সামর্থ্যের৷ প্রমান দেখাতে হবে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারকে। তার নির্দিষ্ট আয় এবং নিজস্ব বাসা থাকতে হবে।
কেমন আছেন ইউরোপ প্রবাসীরা ?
ইউরোপে বাঙালিদের অবস্থান সবচেয়ে বেশী ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, পর্তুগাল, স্পেন, এবং জার্মানীতে। গত ৫ বছরের মধ্যে যারা ফ্রান্সে প্রবেশ করেছেন তাদের প্রায় ২০ ভাহ লোকই বেকার। প্রায় ৩০ ভাগ লোক রাস্তায় রাস্তায় হকারী করে পেট চালান। পর্তুগাল, ইতালি এবং স্পেনে কাজ খুজে পাওয়া আর হিমালয় জয় করা সমান কথা। কাজ পেলেও কখনো পুরোটাই চলে যাবে রুম ভাড়া আর খাবার খরচে। অবৈধ বাঙ্গালীদের অবস্থা এতটাই নাজেহাল যে বর্ণনা করে তাদের লজ্জায় ফেলতে চাইনা।
লেখকঃ প্রবাসী সাংবাদিক ও কলামিষ্ট